
আজ ১৪ মার্চ, কাল মার্কসের মৃত্যুবার্ষিকী। দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে তিনি মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক অনন্য স্থান অধিকার করে আছেন। তাঁর চিন্তাধারা শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির লক্ষ্যে গড়ে উঠেছিল, যা পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ভিত্তি তৈরি করে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন বাংলাদেশে শ্রেণী বৈষম্য থাকার পরেও মার্কসবাদ সফল হতে পারেনি ? ভবিষ্যতে কি তাঁর দর্শন ব্যবহার করে আমাদের অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানো সম্ভব ?
কাল মার্কসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো "ঐতিহাসিক বস্তুবাদ (Historical Materialism)" ও "বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের (Scientific Socialism) ভিত্তি স্থাপন" । তিনি দেখিয়েছিলেন, সমাজের বিকাশ একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যেখানে অর্থনৈতিক সম্পর্কই মূল চালিকাশক্তি। মার্কসের মূল তত্ত্বসমূহ : ১- শ্রেণী সংগ্রাম: ইতিহাস মূলত শ্রমিক ও মালিক শ্রেণির দ্বন্দ্বের ইতিহাস। ২-পুঁজিবাদের সংকট:পুঁজিবাদ একসময় শ্রমিকদের এতটাই শোষণ করবে যে, তারা বিপ্লব করতে বাধ্য হবে। ৩- প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব: সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে পুঁজিবাদ ধ্বংস হবে এবং পরবর্তীতে সাম্যবাদী সমাজ গড়ে উঠবে, যেখানে সম্পদের মালিকানা হবে সম্মিলিত।
মার্কস বিশ্বাস করতেন, পুঁজিবাদ টিকবে না, কারণ এটি আত্মধ্বংসী। তবে বাস্তবে আমরা দেখেছি, পুঁজিবাদ বারবার পরিবর্তিত হয়ে টিকে গেছে। কল্যাণমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা (Welfare State) গড়ে ওঠায় শ্রমিকদের জীবনমান আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে। প্রযুক্তির উন্নতির ফলে উৎপাদন ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, কিউবা, ভিয়েতনামের মতো দেশে, কিন্তু সেগুলোও সময়ের সাথে সাথে পুঁজিবাদী নীতির দিকে ঝুঁকেছে।
বাংলাদেশে পুঁজিবাদ বিরোধী আবহ থাকলেও কমিউনিজম শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে পারেনি। মার্কসবাদ মূলত শিল্প শ্রমিকদের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতি দীর্ঘদিন কৃষিনির্ভর ছিল, ফলে শ্রমিক শ্রেণির চেতনা তৈরি হতে সময় লেগেছে। স্বাধীনতার পর সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির আদলে বাকশাল চালু করা হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন, সামরিক শাসন ও দুর্নীতি এটিকে ব্যর্থ করে দেয়। বিশ্বায়নের কারণে বাংলাদেশ পুঁজিবাদী অর্থনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। ফলে মার্কসবাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়নি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলে বড় একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছে, যারা বিপ্লবের বদলে স্থিতিশীলতা চায়।
বাংলাদেশে এখনো শ্রমিকদের শোষণ, বেকারত্ব ও আয় বৈষম্য বিদ্যমান। মার্কসবাদ পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব না হলেও কিছু নীতিকে গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন : ১- বেকারত্ব দূর করতে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় শিল্প গড়ে তোলা উচিত। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে উৎপাদনমুখী শিল্প গড়ে তুললে কর্মসংস্থান বাড়বে। ২- ধনী-গরিবের বৈষম্য কমাতে সম্পদ পুনর্বণ্টন করা যেতে পারে। উচ্চ আয়ের মানুষের ওপর উচ্চ কর আরোপ করে দরিদ্রদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যেতে পারে। ৩- শ্রমিকদের অধিকারের সুরক্ষার জন্য ভাবা উচিত। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, কর্মপরিবেশ ও ট্রেড ইউনিয়নের শক্তিশালী ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে।
কাল মার্কসের তত্ত্ব শতভাগ বাস্তবায়িত না হলেও তার ভাবনা এখনো প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশে একদিকে পুঁজিবাদী অর্থনীতি দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে, অন্যদিকে আয় বৈষম্যও বাড়ছে। ভবিষ্যতে যদি রাষ্ট্র পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের সমন্বিত একটি নীতি গ্রহণ করে, তাহলে বেকারত্ব কমানো ও দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব। তাই, মার্কসবাদকে সরাসরি গ্রহণ বা বর্জন না করে এর উপযোগী দিকগুলোকে বাস্তবায়ন করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মার্চ, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:২১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



