somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কাফেরদের রক্ত এত বেশি প্রবাহিত হয়েছিল যে নদীর পানি রঙিন হয়ে গিয়েছিল

১৭ ই আগস্ট, ২০২৫ রাত ১০:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সুলতান মাহমুদ গজনী (৯৭১-১০৩০ খ্রি.), ইতিহাসের এমন একটি নাম যা আজও বিতর্কের জন্ম দেয়। কেউ তাকে দেখেন ইসলামের একজন মহান যোদ্ধা ও বিজেতা হিসেবে, আবার সমালোচকরা তাকে চিহ্নিত করেন একজন নিষ্ঠুর লুটেরা ও ধ্বংসকারী হিসেবে। যখন আমরা তার জীবন ও কাজকে নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করি, তখন দেখতে পাই তার মূল লক্ষ্য ছিল ধর্ম নয়, বরং অর্থ ও ক্ষমতা অর্জন।

গজনীর শাসক হিসেবে সুলতান মাহমুদ তার রাজ্যকে এক বিশাল সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত করেন। তার শাসনামলে গজনী ছিল একটি ছোট, পার্বত্য শহর। এই শহরকে একটি সমৃদ্ধ, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত করার উদ্দেশ্যেই তিনি ভারতে বারবার আক্রমণ চালান। "ক্যামব্রিজ হিস্টোরি অফ ইন্ডিয়া" অনুযায়ী, গজনীর এই সমৃদ্ধির প্রধান উৎস ছিল ভারত থেকে লুট করা সোনা, রুপা এবং অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ। মাহমুদ প্রতিটি আক্রমণকে ‘জিহাদ’ বা ধর্মযুদ্ধ হিসেবে উপস্থাপন করলেও, তার আসল লক্ষ্য ছিল ভারতের বিপুল সম্পদ লুট করা। ভারতের তৎকালীন রাজনৈতিক বিভাজন এবং দুর্বল হিন্দু রাজাদের মধ্যেকার কোন্দল তাকে সহজেই বিজয় এনে দেয়।

সুলতান মাহমুদকে অনেকে ধর্মপ্রচারক বললেও, তার কর্মকাণ্ড প্রকৃত ধর্মীয় নীতির সঙ্গে মেলে না। ১০০০ থেকে ১০২৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি ভারতে ১৭ বার অভিযান চালান। সোমনাথ মন্দিরে তার একমাত্র আক্রমণেই প্রায় দুই কোটি দিনার লুট হয়। ইতিহাসবিদদের হিসাব অনুযায়ী, তার মোট লুটের পরিমাণ ছিল ট্রিলিয়নের কাছাকাছি। এই লুট শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক ক্ষমতা দৃঢ় করার হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। তার সেনাবাহিনী লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে বা বন্দী করে বিক্রি করে, যা মানবিক মূল্যবোধের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তার দরবারের ইতিহাসবিদ আল-উতবি তার "তারিখ-ই-ইয়ামিনি" গ্রন্থে লিখেছেন যে "কাফেরদের রক্ত এত বেশি প্রবাহিত হয়েছিল যে নদীর পানি রঙিন হয়ে গিয়েছিল এবং মানুষ তা পান করতে পারছিল না।"

প্রকৃত ধর্মপ্রচারকরা মসজিদ-মাদ্রাসা তৈরি করেন এবং শান্তিপূর্ণভাবে ধর্ম প্রচার করেন। এর বিপরীতে, মাহমুদ ভারতে একটিও মসজিদ বা মাদ্রাসা তৈরি করেননি। ভারতীয় মুসলিমদের কল্যাণেও তিনি কোনো কাজ করেননি। তার একমাত্র কাজ ছিল মন্দির ধ্বংস করা এবং সম্পদ লুট করা। আল-বালাজুরি-এর "কিতাব ফুতুহ আল-বুলদান" গ্রন্থে উল্লেখিত আছে যে, আরব ব্যবসায়ীরা ৬১২ খ্রিস্টাব্দে ভারতের প্রথম মসজিদ কোডুঙ্গাল্লুর-এ তৈরি করেছিলেন, যা শান্তিপূর্ণ ধর্মপ্রচারের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। সোমনাথের শিবলিঙ্গের টুকরোগুলো গজনীর জামি মসজিদের সিঁড়িতে বসিয়ে দেওয়ার ঘটনা তার ধর্মীয় স্থানের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে প্রশ্ন তোলে

মাহমুদ গজনবীর চরিত্রের একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি তার পৃষ্ঠপোষকতা। তিনি তার রাজধানী গজনীকে কেবল একটি সামরিক শক্তিকেন্দ্রই নয়, বরং একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক নগরী হিসেবেও গড়ে তোলেন। তার রাজদরবারে বহু কবি, পণ্ডিত ও দার্শনিকের সমাবেশ ঘটেছিল, যাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন মহাকবি ফেরদৌসী। ফেরদৌসী তার মহাকাব্য "শাহনামা"-এর জন্য মাহমুদের কাছ থেকে আংশিক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন, যদিও এই গ্রন্থটি মূলত স্বাধীনভাবেই রচিত হয়েছিল এবং এতে প্রাক-ইসলামি পারস্যের গৌরবকাহিনি বর্ণিত হওয়ায় মাহমুদের ইসলামিক রাজনৈতিক আদর্শের সাথে কিছুটা বৈপরীত্য ছিল। এছাড়াও মাহমুদ গজনীতে মসজিদ, মাদ্রাসা ও গ্রন্থাগার নির্মাণ করে শিক্ষা ও স্থাপত্যের বিকাশে ভূমিকা রেখেছিলেন। এই সবকিছুই ইঙ্গিত দেয় যে তিনি কেবল একজন বিজয়ী সুলতানই নন, বরং সংস্কৃতির উন্নয়নে অবদান রাখা একজন জটিল ও বহুমাত্রিক শাসক ছিলেন।

মাহমুদের চরিত্রে তিনটি দিক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রথমত, তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সেনাপতি, যার যুদ্ধ কৌশল ও সেনা ব্যবস্থাপনা ছিল প্রশংসনীয়। দ্বিতীয়ত, তিনি ছিলেন একজন চতুর রাজনীতিবিদ, যিনি রাজনৈতিক বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা বিস্তার করেছিলেন। তৃতীয়ত, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো তিনি ছিলেন একজন নিষ্ঠুর লুটেরা, যিনি মানবিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় শ্রদ্ধা এবং সাধারণ মানুষের জীবনকে উপেক্ষা করেছিলেন। তার ধর্মীয় পরিচয় ছিল কেবল তার ক্ষমতা ও সম্পদ অর্জনের হাতিয়ার। মুহাম্মদ হাবিব তার "সুলতান মাহমুদ অফ গাজনিন" গ্রন্থে মাহমুদের অভিযানকে "ধর্মীয় যুদ্ধ" নয়, বরং "অর্থনৈতিক সন্ত্রাস" হিসেবে বর্ণনা করেছেন। মুঘল সম্রাট আকবরের প্রধানমন্ত্রী আবুল ফজল তার "আইন-ই-আকবরী" গ্রন্থে মাহমুদের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে বলেছিলেন যে এটি সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের জন্য ক্ষতিকর।

সুলতান মাহমুদকে "ধর্মপ্রচারক" বলার কোনো সুযুক্তি নেই। তিনি ছিলেন একজন সুযোগসন্ধানী শাসক, যিনি নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য ধর্মের অপব্যবহার করেছিলেন। তার কর্মকাণ্ডের নেতিবাচক প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। তার আক্রমণে হাজার হাজার বছরের পুরাতন মন্দির ও শিল্পকর্ম ধ্বংস হয়েছে, যা ছিল অপূরণীয় ক্ষতি। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে চিরস্থায়ী বিভাজন তৈরি হয়েছে। ভারতীয় অর্থনীতির বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে বা দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়েছে। তাই, ইতিহাসের সত্যিকারের শিক্ষা হলো, মাহমুদকে যা-ই বলা হোক না কেন, তিনি কখনোই একজন ধর্মপ্রচারক ছিলেন না; তিনি ছিলেন একজন সুযোগসন্ধানী শাসক যিনি নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য ধর্মের অপব্যবহার করেছিলেন।

Source: মুহাম্মদ নাজিম-এর "History of Mahmud Ghaznavi", এ. এল. ব্যাশাম-এর "The Wonder That Was India", এবং উপিন্দর সিং-এর "Early Medieval India and its Invaders"। এছাড়াও, আল-উতবি-এর "তারিখ-ই-ইয়ামিনি", আল-বালাজুরি-এর "কিতাব ফুতুহ আল-বুলদান", আবুল ফজল-এর "আইন-ই-আকবরী", মুহাম্মদ হাবিব-এর "Sultan Mahmud of Ghaznin", এবং আন্দ্রে উইঙ্ক-এর "Al-Hind: The Making of the Indo-Islamic World" ।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই আগস্ট, ২০২৫ রাত ১১:৩৮
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুহূর্ত কথাঃ সময়

লিখেছেন ফাহমিদা বারী, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৩৭



সামুতে সবসময় দেখেছি, কেমন জানি ভালো ব্লগাররা ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়! যারা নিয়মিত লেখে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রচণ্ড নেগেটিভ স্বভাবের মানুষ। অন্যকে ক্রমাগত খোঁচাচ্ছে, গারবেজ গারবেজ বলে মুখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×