somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাকিন সুন্দরবন ৩। মরণখোর

১৪ ই জানুয়ারি, ২০১১ রাত ৮:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সুন্দরবনের কাদায় পা দিতেই আমাকে একেবারে ভারহীন করে নেয় সুন্দরবনের শীতভোর

আমাদের রিজার্ভ করা জাহাজে নয় ছয় বলে গতকাল আরো তিন ডজন লোক ঢুকিয়ে দেবার পর খাবার টেবিলে লাইন- টয়লেটে লাইন- পানির গ্লাসে লাইন দিয়ে সব শেষে যখন আজ সূর্য ওঠার আগে ম্যানেজার চায়ের গ্লাসে লবণ গুলিয়ে দিয়ে চিনি বলে চালিয়ে দিতে চাইল তখন আমার মুখ দিয়ে বের হয়ে এলো- চোদনা পুরা গ্লাস তোমার ইয়ের মধ্যে ঢুকায়ে দিলে বুঝবা কোনটা চিনি আর কোনটা লবণ....

মাথা মুখে শরীরে এইসব খিটিমিটি নিয়ে জাহাজ ছেড়ে ছোট নৌকায় যখন বনের ভেতরে ঢুকছিলাম তখনও ভয়ে ছিলাম পুরো যাত্রাটা মাটি হয়ে যাবার। কিন্তু বনের ভেতরে ঢুকতেই সুন্দরবনের সবগুলো শ্বাসমূল মাথার সব খিটিমিটি শুষে নিয়ে আমার সামনে দাঁড় করিয়ে দিলো এক অন্য রকমের শুভসকাল

আমরা হাঁটছি শীতের ভেতর দিয়ে গলায় পিঠে ক্যামেরা ঝুলিয়ে। কারো পায়ে বুট- কারো স্যান্ডেল। কারো পায়ে মোজার মতো নরম গোলাপি জুতা। আমরা হাঁটছি জুতায় কাদা লাগার উহুআহা ভয় নিয়ে। আমরা হাঁটছি জুতায় মোড়ানো নরম গোড়ালিতে কাদা-ঠান্ডায় ওরেমারে নিয়ে। আমাদের সামনে পেছনে বনবিভাগের নির্লিপ্ত দুই গার্ড। বেতনের বাইরে ভাতা আর বকশিশের আকর্ষণ ছাড়া এই বন যাদের কাছে পুরোটাই বিরক্তিকর। তারা হাঁটছে সুন্দরবনের যে কেনো গার্ডের মতো বারবার বনের বেশি গভীরে না যাবার সতর্কতা দিয়ে। অক্লান্তভাবে তারা জানিয়ে যাচ্ছে বনের গভীরেও বন ছাড়া কিছু নেই। একই রকম কাদা। একই রকম গাছ। কিন্তু বন যত গভীর ভয় তত বেশি। তাই বেশি ভেতরে যাবারও দরকার নেই কারো...

সাধারণ সতর্কীকরণের পরে সুন্দরবনের যে কোনো বনকর্মীর মতো তারা বেছে নেয় ভয়ের গল্প। চোখেমুখে ভয় জড়ো করে জানায়-গতকাল এখানে এসে বাঘ শিকার ধরে নিয়ে গেছে। যদিও গতকাল এই লোকগুলো আমাদের সাথেই ছিল মোবাইল নেটওয়ার্কের বাইরে। তবুও যেন অলৌকিক ক্ষমতায় এরা সবাই গতকালের বাঘের শিকার সংবাদ জেনে যায়...

কিচ্ছু বলি না আমি। বনের ভেতরে চিল্লাচিল্লি অশ্লীল ঠেকে আমার। কিন্তু এবার তরুণ বনকর্মী সুমন আমার কানের কাছে এসে গতকালের বাঘের শিকার কাহিনী আবারও শোনায়। আমি তার দিকে তাকাই- কাল যদি বাঘ শিকার ধরে থাকে তবে আগামী চার দিন এই বনে সবাই নিরাপদ। সুমন একটু হকচকিয়ে গলায় উঁচায়- আপনি কীভাবে জানেন?
- আমি জানি। কারণ বাঘ মানুষের মতো চুতিয়া নয় যে ঘরে খাবার রেখে আবার খাবার কাড়তে বেরোবে। সুন্দরবনের একটা বাঘ এক হরিণ পাঁচ দিন ধরে খায়। সুতরাং বাঘ এইখানে গতকাল শিকার ধরলে আপনার রাইফেল আগামী চারদিন শুয়োর খেদানো ছাড়া কোনো কাজে লাগবে না আর...
সুমন একটু পিছিয়ে যেতে যেতে বিড়বিড় করে- সবকিছু তারা জানে। আমরা এখানে আছি বাল ছিঁড়তে

সুমন পিছিয়ে গেলে অন্য কৌশল নিয়ে এগিয়ে আসে প্রবীণ বনকর্মী মজিদ। নাকে মুখে আঙুল দিয়ে মাটিতে বাঘের পায়ের ছাপ দেখিয়ে ঘোষণা করে একটু আগে এইখান দিয়ে হেঁটে গেছে বাঘ। ব্যাস। খটাখট ছবি উঠে আর কেউ গিলে ফেলে তার কথা। এই বুঝি এলো বাঘ...

কিন্তু এই টিমের লিডার মুস্তাফিজ ভাই; হাতের তালুর উল্টাপিঠের মতো.চেনে সুন্দরবন। সাথে সাথে পায়ের গোড়ালি দিয়ে মাটিতে একটা আধা গর্ত করে সামনের দিকে আঙুল চেপে আরো দুটো দাগ বানিয়ে সবাইরে দেখিয়ে দেয়- এই দেখো। বাঘের পায়ের ছাপ কিন্তু বানানো যায়। কেউ হাসে- কেউ সাহস পায়- কেউ ছবি তোলে আর বনকর্মীরা হতাশ হয়ে হাঁটে। বিড়বিড় করে তাদের দায়িত্বের কথা মনে করাতে করাতে আবারও আমার সামনে পড়ে। আমি বলি- আপনারা ফিরে যান। এই বনে বাঘ নেই

প্রবীণ বনকর্মী মজিদ এবার সত্যি সত্যি আতঙ্ক নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে অনুনয় করে- দয়া করে এই কথা বলবেন না। হরিণ দেখেন। শুয়োর দেখেন। বাঘের পায়ের ছাপ দেখেন। কিন্তু বাঘ নেই কিংবা বাঘ দেখার কথা মুখেও আনবেন না কেউ...

সুন্দরবনের বাঘশিকারী পচাব্দী গাজীর একটা কথা মনে পড়ে যায় আমার। কথাটা নাকি তিনি বাপ্পী ভাইকে বলেছিলেন- যতদিন সুন্দরবনে তুমি বাঘকে ভয় পাবে ঠিক ততদিনই সুন্দরবনে বেঁচে থাকবে তুমি। আর যাই করো বাঘের সাথে মাতব্বরি না...

দুনিয়ার অন্য যে কোনো বাঘ থেকে সুন্দরবনের বাঘ একেবারেই আলাদা। এত কষ্টে দুনিয়ার বাঁচে না কোনো বাঘ। পৃথিবীর অন্য কোনো বাঘ এইভাবে নিত্য জোয়ার ভাঁটা প্লাবন জলোচ্ছ্বাসের সাথে তাল মিলিয়ে বাঁচে না। এই বাঘকে বাঁচতে হয় কখনও কুমির হয়ে গলা পর্যন্ত পানিতে ডুবিয়ে- কখনও বানর হয়ে গাছে নাক ভাসিয়ে। এক বনে দুই বাঘ না থাকার প্রবাদ মিথ্যে করে সুন্দরবনের বাঘ মাঝে মাঝেই দল বেঁধে হাঁটে। একাধিক পুরুষ কিংবা একাধিক নারী বাঘ একসাথে দেখা অস্বাভাবিক নয় সুন্দরবনে। খাবার রেখে বাঘের শিকারের নিয়ম না থাকলেও সুন্দরবনের বাঘ মাঝে মাঝে খাবার সংগ্রহ করে দুঃসময়ের জন্য। এই বাঘ বই কিংবা টেলিভিশনের বাঘ নয়। এই বাঘ সুন্দরবনের বাঘ। ভয় করা লাগে তারে সকল সূত্র ছেড়ে...

সামনে আগাতে থাকি আমরা। কেউ জুতার থেকে পা মূল্যবান ভেবে জুতা ঢুকিয়ে দেয় কাদায়। কেউ জুতার দাম পায়ের থেকে বেশি নির্ধারণ করে জুতা হাতে নিয়ে খালি পায়ে ছোঁয় কাদা। কেউ জুতা আর পায়ের সমান মূল্য ভেবে পা আর জুতা দুটোকেই বাঁচিয়ে একটু শুকনা জায়গা- একটু গাছের গুঁড়ি খুঁজতে গিয়ে জ্যাকেট ক্যামেরাসহ ধপাস। কিন্তু সকলেই আগাতে থাকে। আর গতকালের বাঘের পায়ের ছাপ কিংবা শিকার ধরা কাহিনী কোনোটাই কারো কানে দিতে না পেরে দুইজন বনকর্মী হাঁটতেই থাকে... হাঁটতে হাঁটতে বাঘের পায়ের ছাপ দেখায়- হরিণ টেনে নিয়ে যাবার চিহ্ন দেখায় কিন্তু আমার চোখ গিয়ে পড়ে আব্দুল ওহাবের খালি পায়ের ছাপে

বাঘের পায়ের কাছে আব্দুল ওহাবের খালি পায়ের ছাপ। হরিণের পায়ের কাছে ওহাবের ছাপ। সামনে পেছনে গার্ড নিয়ে আমাদের পেছনে আমাদের বহরের ভিন্ন ভিন্ন জুতার ছাপ। কাদার উপর অনভ্যস্ত পায়ের এলোমেলো ছাপগুলো আমাদের। কিন্তু কাদার উপর বাঘ কিংবা হরিণের মতো অভ্যস্ত যে মানুষের ছাপ নগ্ন-সটান- আত্মবিশ্বাসী- একটানা এবং মোড় ঘোরার আগে পর্যন্ত একই সরল রেখায় ধাবমান; ওই ছাপ আব্দুল ওহাবের ছাপ...

যেখানে বাঘ এসে কাল হরিণ নিয়ে গেছে। যেখানে পাথরের নিচে শঙ্খচূড়। সেখানে খালি পায়ে একা আব্দুল ওহাব কোন পর্যটনে যায়? বনের ভেতরে সূর্যোদয় দেখতে? কুয়াশাভেজা গাছের পাতায় সূর্যের ঝিলিক ক্যামেরাবন্দী করতে? নাকি এই যে সুন্দরবনের পুরো সীমানা জুড়ে পর্যটকদের ফেলে যাওয়া ছেঁড়া স্যান্ডেল- চিপসের প্যাকেট সিগারেটের ফিল্টার প্রকৃতির কতটুকু ক্ষতি করছে তার খতিয়ান নিতে?

সূর্য ওঠার আগেই আব্দুল ওহাব এই পথ দিয়ে একা চলে গেছে বনের অনেক গভীরে। আমরা জানি না সেই বাঘ আব্দুল ওহাবের সাথে কী আচরণ করেছে। আমরা অপেক্ষা করি কুয়াশা কাটার। আমরা অপেক্ষা করি সূর্য আরেকটু একটু কঠিন হবার। আমরা অপেক্ষা করি আমাদের কাক্সিক্ষত ছবির...

ছবি ওঠে। গাছের সঙ্গে মানুষ। কাদার ভেতরে মানুষ। বনের মধ্যে আমাদের স্মৃতি। শীতে কুয়াশায় কাদায় আমাদের দুরবস্থা- আমাদের অবস্থান- আমাদের আনন্দের ছবি উঠতে উঠতে কুয়াশা কেটে যায়। ডালপালার ফাঁক দিয়ে সূর্য যথেষ্ট আলো পাঠায় ক্যামেরার জন্য। তুষার আর হাসান আর পারভেজ ভাই প্রায় ভিডিও করে বসে প্রত্যেকটা ফ্রেম। একেক ক্লিকে দশ বারোটা ছবি। অন্তত একটা হলেও পাওয়া যাবে শার্প ফোকাস। এখলাস সাবজেক্টের ডানে বামে উপরে নিচে নড়েচড়ে ফ্রেম ঠিক করতে না পেরে যেন গাছকেই বলে বসে- বাবা একটু ডান দিকে সরলে আলোটা ভালো করে পাবি। জিয়া পাখির ছবি তোলার জন্য পাখির কাছে যেতে যেতে পাখিটাকেই উড়িয়ে দেয়। জিলাল সতর্কভাবে খেয়াল রাখে অন্যদের আবিষ্কার করা পজিশন আর ফ্রেমে; তারপর সেখানে গিয়ে কয়েকটা ক্লিক। জাহিদের ক্যামেরা কনফিউজড। ইভেন্ট ফটোগ্রাফির অতি ব্যস্ত জীবনে গাছের ছবি তার কাছে কে চাইতে আসবে? আশিক- রাশেদ আর মাহবুবের ক্যামেরা ছবি তোলে নিজেকে আড়ালে রেখে। সাদেকের দৃষ্টি সুন্দর বনের অস্তিত্বের ক্ষুদ্রপ্রাণের দিকে। তার ক্যামেরা তাক করে ক্ষুদ্র কীট-এক আংটাওয়ালা লাল ক্ষুদ্র লাল কাঁকড়া- লাফানো মাছ- ক্ষুদ্র কীটে। মফিজ ভাই স্টিল ছবি দিয়ে সুন্দরবনকে ধরতে না পেরে ক্যামেরার ভিডিও অপশন চালু করে ডানে বামে ঘোরান। অরূপদা তার শৌখিন ক্যামেরা নিয়ে কিছুটা বিব্রত। বারবার চোখ দেয় এর তার মনিটরে। মিলিয়ে নেয় অন্যের ছবির সাথে নিজের ছবির ভালোমন্দত্ব। আলমগীর নিশ্চিন্ত তার স্মৃতি ধরে রাখার পদ্ধতি নিয়ে। কারো দিকে তাকানোর বালাই নাই। কারো সাথে তুলনার বালাই নাই। সে তার হ্যান্ডি ভিডিও ক্যামেরায় ধরে রাখে সুন্দরবনের স্মৃতি। শাওনের ক্যামেরায় দ্রোণাচার্যের শিক্ষার্থী অর্জুনের চোখ। তীরের নিশানা ঠিক করার সময় সে গাছের ডালে বসা পাখি দেখে না- গাছ দেখে না- পাখির মাথা দেখে না। দেখে শুধু পাখির চোখ যেখানে বিদ্ধ করতে হবে তীর। বিশাল বনকে ঝাপসা রেখে শাওন শুধু ক্যামেরায় তুলে আনে কয়েক ইঞ্চি দৈর্ঘ্য প্রস্থের একেকটা টুকরা। মুস্তাফিজ ভাইর কোনো তাড়াহুড়া নেই। ফ্রেম খোঁজেন না। সাবজেক্ট খোঁজেন না। তিনি জানেন কীসের ছবি তোলা যাবে। জানেন কোনো ক্যামেরায়ই সবকিছু তোলা যাবে না। তাই তিনি আশপাশে তাকান। দেখেন। তার চোখে ধরা পড়ে গাছের পাতার ফাঁকে ছোট্ট একটা পাখি। তার চোখে ধরা পড়ে দূরে কেওড়া গাছের নিচে হরিণের নড়াচড়া। তার চোখে ধরা পড়ে কাদার মধ্যে মিশে থাকা থাবা খাওয়া হরিণের রক্ত। ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে তিনি শুধু দেখেন। এবং তারপর ক্যামেরা তুলে ক্লিক করেন একটা কি দুইটা...

আর আমি গার্ডের সতর্কতা এড়িয়ে তুষাররা যেখানে ছবি তুলতে গেছে সেখানে গিয়ে আবিষ্কার করি একটা গ্রাম্য বাড়ি আর গ্রামের রাস্তা। একেবারে সুনসান একটা গ্রাম্য বাড়ি। একটু নুয়ে গাছের গোড়ার ফাঁকে চোখ দিলে যেন বহু দূরের বাড়িটার ভিটে দেখা যায়। তারপর এই যে বাঁক। এতো আমাদের গ্রামের সেই রাস্তা। যদিও সতর্ক অনুমান দিয়ে জানি এই রাস্তায় সওদা নিয়ে বাড়ি ফেরার জন্য হাঁটে না কেউ...

আর কিছু দেখি না আমি। মুস্তাফিজ ভাই যেদিকে হরিণ দেখান সেদিকে তাকিয়ে বলি- হ্যাঁ ওই তো। আর মনে মনে বলি-হরিণ থাকলেও থাকতে পারে। না থাকলে ওটা গাছের ছায়া। তারপর হাঁটি। মাটির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাঁটি। হরিণের ছাপ। কাঁকড়ার দাগ। বাঘের ছোপ। আর সারা বন জুড়ে আব্দুল ওহাবের পায়ের চিহ্ন। আব্দুল ওহাব এদিকেও হেঁটে গেছে একা। হয়ত ওই গ্রামের রাস্তার মতো রাস্তা ধরে হেঁটে গেছে ওহাব। কী আছে ওখানে?

ওদিকে পা বাড়াতেই গার্ডেরা পড়িমরি করে এসে আটকায়- খবরদার...

একটা পায়ের রেখা ধরে চোখ কুঁচকে আমি সামনে তাকাই। কিছুদূর একটা কেওড়া গাছের গোড়ায় গিয়ে পায়ের ছাপগুলো আবার ফিরে এসে অন্য দিকে চলে গেছে। কী করতে আব্দুল ওহাব ওই গাছ পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে এসেছে আরেকটা সরল রেখায়? গাছ কাটলে তো গাছ থাকার কথা না এখানে। হরিণ ধরলে তো হরিণ টেনে নেয়ার চিহ্ন পাওয়া যেত। বাঘ মারলে কিংবা বাঘে মারলে দুজনেরই কোনো না কোনো ছাপ থাকতো অক্ষয় কাদায়। কিন্তু আব্দুল ওহাব কেন ওই গাছের গোড়ায় গেল আর ফিরে এসে চলে গেলো অন্য কোথাও?

আব্দুল ওহাবের গাছের দিকে যাবার চিহ্নের পাশে আরেকটা বুটের চিহ্নরেখা তৈরি করে আমি গাছের গোড়ায় আগাই। কী আছে ওখানে? বনের অত গভীরে গাছের গোড়ায় কী?

গাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে গাছ ধরে চারপাশে তাকাই। চারপাশে অক্ষত শ্বাসমূল- লকলকে ঘাস- আইলায় ভাঙা গাছের পচা ডাল- গুঁড়ি গুঁড়ি লাল কাঁকড়া দাগ। কোনো ধস্তাধস্তির চিহ্ন নেই- কোনো কাটাকাটির চিহ্ন নেই। সুনসান কাদা। তার মধ্যে ঘাসের ফাঁকে কাদার ভেতরে পেয়ে যাই আব্দুল ওহাবের আসার কারণ। একটা ছোট্ট বাঁশের খাঁচা। তার ভেতরে কাঠিতে গাঁথা তিন ইঞ্চি লম্বা একটা মাছ। আর মাছ খাবার লোভে খাঁচার ভেতরে ঢুকে আটকে পড়া মাঝারি সাইজের চারটি কাঁকড়া...

সূর্য ওঠারও আগে। কিংবা আগের দিন সূর্য ডোবার আগে আব্দুল ওহাব একা এই বন চষে বেড়িয়েছে কাঁকড়ার ফাঁদ নিয়ে। বাঘের ছাপের পাশে পাশে পা ফেলে দূরে দূরে নিয়ে বসিয়েছে কাঁকড়ার ফাঁদ। এক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আবারও হয়ত একটু পরে কিংবা বিকেলে সে আসবে কাঁকড়াগুলো নিতে। একেকটা ফাঁদে ধরা পড়বে তিনটা চারটা কিংবা দশটা কাঁকড়া। সারা বন থেকে কয়েক কেজি কাঁকড়া বস্তায় ভরে আবাও একা একা বাঘের-সাপের রাস্তা দিয়ে গিয়ে উঠবে নৌকায় কিংবা কিংবা হয়ত নৌকায় উঠার আগেই সামনে এসে দাঁড়াবে মামা- ভাগিনা। চল তোরে লইয়া যাই বনের গভীরে...

বনবিবির পরে সুন্দরবনের বাকি ক্ষমতার দুটো প্রতীকই পুরুষ। এখানে সব বাঘ মামা। বাঘের সব থাবাই পুরুষালি মামার থাবা। আর বাঘেরাও সবাই পুরুষবাদী এই বনে। আক্ষরিক অর্থেই ম্যানইটার। মানুষখেকো নয়; পুরুষখেকো বাঘ এরা সবাই। এই বনের গভীরে মারতে কিংবা মরতে কোনো নারী আসে না বলেই বাঘেরা যাদের হাতে মরে আর যাদের মারে তারা সকলেই পুরুষ। সুন্দরবন মূলত এক পুরুষালি বন...

আমাদের আশঙ্কা নেই। আমাদের পাহারা দিয়ে রেখেছে ফরেস্টের দুই দুইজন গার্ড। আমাদেরকে বাঘেরা মারবে না কারণ তারা জানে আমরা সবাই প্রকৃতিবাদী এবং পৃথিবীতে বাঘের সংখ্যা হ্রাসে দারুণ শঙ্কিত। আমরা বাঘ সম্মেলনে বাঘের সংখ্যা বাড়ানোর পক্ষে দেশের চুক্তি সইয়ে দারুণ খুশি। সারা সুন্দরবন আবার বাঘে বাঘে বাঘময় হয়ে গেলে আমরা খুশি। সুন্দরবনের পরিবেশ রক্ষায় সরকারের প্রতিজ্ঞায় আমরা খুশি। আমরা খুশি সুন্দরবনের ক্ষতি করলে আব্দুল ওহাবকে পাঁচ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে জেলের ঘানি টানতে হবে আরো পাঁচ বছর। আমরা খুশি বাঘ মারলে আব্দুল ওহাবকে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা জরিমানা দিয়ে যাবজ্জীবন জেলে কাটাতে হবে শুনে। আমরা এতেও খুশি যে বাঘের থাবায় আব্দুল ওহাব মরে গেলে তার বিধবা বৌ আব্দুল ওহাবের মূল্যবাবত পাবে এক লক্ষ টাকা। জীবিত আব্দুল ওহাব যেখানে সুন্দরবনে একমাস কাঁকড়া ধরে হাজার টাকা বাঁচাতে পারে না সেখানে শুধু বাঘের একটা থাবায় প্রাণ ছেড়ে দিলেই তার দাম হয়ে যাবে এক লক্ষ টাকা। বাহারে আব্দুল ওহাব। এই খবর জেনেই তুমি কাঁকড়া ধরার নামে একা একা বনে চলে গেছ বাঘের থাবার সন্ধানে। যদিও আমরা জানি না বাঘের থাবায় তোমার মৃত্যু প্রমাণের কী বন্দোবস্ত করে গেছ তুমি। সরকারের ঘরে বাঘের হাতে তোমার মৃত্যু প্রমাণের জন্য তোমার বৌয়ের প্রয়োজন হবে তোমাকে বাঘে ধরে নিয়ে যাবার স্থিরচিত্র কিংবা কোনো পত্রিকায় তোমার বাঘে খাওয়া ছবি কিংবা ফরেস্টের নোট কিংবা কমপক্ষে তিনজন সাক্ষী কিংবা নিদেন পক্ষে সরকারি আদালতে বাঘের স্বীকারোক্তি- মাননীয় আদালত আমি সুন্দরবনের কেওড়াশুটির বাঘ। আমি স্বীকারোক্তি দিচ্ছি যে স্বজ্ঞানে এবং আন্তর্জাতিক বাঘাধিকারে মরহুম আব্দুল ওহাব ভাগিনাকে ক্ষিদা নিবারণের মানসে ভক্ষণ আমি করেছি তাই আমার ক্ষতিগ্রস্ত ভাগিনাবধূকে প্রতিশ্র“তিমতো এক লক্ষ টাকা প্রদান করা হউক...

আমরা বাঘের উপরে আস্থাশীল। আস্থাশীল বাঘ আর বাঘি পরিবেশ আইনের উপর। আমরা জানি আব্দুল ওহাবেরা বাঘের জমিতে এসে ঘর তোলে তাই বাঘের সংখ্যা কমে যায়। তারা বাঘের খাবার খেয়ে ফেলে তাই বাঘের সংখ্যা কমে যায়। তারা টাকার লোভে বাঘ মারে তাই বাঘের সংখ্যা কমে যায়। তাই এই নতুন আইন। লুকিয়ে চুরিযে একটা বাঘ মারলে আব্দুল ওহাবেরা পায় হাজার পাঁচেক টাকা তাই তাদেরকে বেশি টাকার লোভ দেখাতে নতুন এই আইন- বাঘ মারলে পাবি পাঁচ হাজার আর বাঘের হাতে মরলে পাবি এক লক্ষ টাকা। এইবার বুঝে দেখ বেটা কোনটাতে লাভ? যতবার মরবি তত লক্ষ টাকা। খালি টাকা আর টাকা। মরতে না পারলেও টাকা। বাঘের হাতে পঙ্গু হলে অর্ধলক্ষ টাকা। বারবার পঙ্গু হ বেটা মরতে যদি ভয়। মামার হাত এখন স্বর্ণের খনি। তোকে ছুঁয়ে দিলেই হাজারে হাজারে টাকা। তাই সরকারও তোর মঙ্গল চিন্তা করে সপ্তায় আড়ইশো টাকা নিয়ে কাঁকড়া ধরার পারমিট দিয়ে তোকে জঙ্গলে পাঠায়। তোমাকে পারমিট দিলে সরকারের লাভ। তুমি কাঁকড়াসহ ফিরে এলে লাভ মহাজনের আর ফিরে না এলে লাভ মামাবাঘা আর তোমার বিধবা বৌয়ের। তাই তোমাকে বনের মধ্যে একা পাঠানো হয় রাইফেল বন্দুক ছাড়া। রাইফেল থাকলেই হাজার টাকার জন্য তুমি বাঘের দিকে বন্দুক তাক করে ফেলতে পারো। কিন্তু না থাকলে মামার ছোঁয়ায় তোমার দাম উঠে যাবে লক্ষ লক্ষ টাকা...

এইসব তুমি ভালো করেই জানো আব্দুল ওহাব। জানো বলেই আমরা রাইফেলধারী গার্ড নিয়ে বনে ঢোকা আগেই তুমি কাঁকড়া ধরার নামে বাঘের হাতে ধরা দিতে গেছো। তুমি জানো এখানে বড়ো বড়ো ক্যামেরা নিয়ে একঝাঁক ফটোগ্রাফার আসবে। মুহূর্তের মধ্যেই তোমার লাশের শত শত ছবি উঠে আসবে ক্যামেরায়। তারপর পত্রপত্রিকা দেশি বিদেশি প্রদর্শনীতে চলে যাবে তোমার বাঘে খাওয়া ছবি। বন্দুকধারী ফরেস্টের গার্ডেরা সাক্ষী দেবে তোমার মৃত্যুর আর তখন... তোমার মৃত্যুর মূল্য কে ফাঁকি দেয়? সুড়সুড় করে সরকার তোমার মূল্যটা গ্রামে গিয়ে তোমার বৌয়ের হাতে পৌঁছে দিয়ে আসবে। কিন্তু ততক্ষণও কি তোমার বৌ তোমার বাড়িতেই থাকবে? নাকি সুন্দরবনের নিয়মে তোমার মৃত্যু দায় নিয়ে ততক্ষণে তাকে চলে যেতে হবে বিধবাপল্লির ডেরায়?


সাকিন সুন্দরবন ১। বনমজুর

সাকিন সুন্দরবন ২। বনপর্যটক

সাকিন সুন্দরবন ৪। ভাতারখাগী
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জানুয়ারি, ২০১১ দুপুর ১:৩০
৮টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ মিসড কল

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×