{ইহা কোনো রম্য গল্প নহে। তবে অদূর ভবিষ্যতে সাহিত্যকর্মের খাতায় এক অভাবনীয় সাফল্য লাভ করিয়া তরুণ সাহিত্যিকগণকে উৎসাহিত করিতে পারে বিধায় ইহা তৎকালীন লিখিত ভাষায় রচিত হইল।}
----------------------------------------------------------------------------------
সাঁই সাঁই অনুভূত আওয়াজে ছুটিয়া চলিতেছে মন্ত্রীর গাড়িবহর। প্রথমটা একটা পুলিশী ভ্যান, তাহার পরে একটা মাইক্রোবাস সমেত মিনিবাস, তৃতীয়টা মন্ত্রী মহোদয়কে বহনকারী ব্যক্তিগত গাড়ি আর সর্বশেষে বিকট আওয়াজ তুলিয়া ছুটন্ত একটা অ্যাম্বুলেন্স। জনৈক মন্ত্রী আবুল মোর্শেদ তাহার অর্ধাঙ্গী কাওকাবা বেগম এবং সদ্য প্রবাসফেরত একমাত্র কন্যা জুলিয়াকে নিয়া বাহির হইয়াছেন গ্রাম দর্শনে। উপলক্ষ্য তেমন কিছুই না - কন্যার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।
মন্ত্রী মহোদয়ের মুখ হাসি হাসি। গাড়ির ভেতরই গলাটা অ্যালকোহলে হালকা ভিজাইয়া লইলেন তিনি। স্ত্রীর কপট দৃষ্টি-রাগ উপেক্ষা করিয়া মুখমন্ডলে একটা অতিরিক্ত ভাবগাম্ভীর্য্যতা আর অহমিকা ফুঁটাইয়া তুলিলেন। নিজ কন্যার সম্মুখে তাহার অভাবনীয় ক্ষমতার একটা নমুণা দেখাইতে পারিতেছেন - ব্যাপারটা অতিশয় উপভোগ করিতেছেন তিনি। আসন্ন নির্বাচনী প্রচারণার ব্যাপারটাও মাথায় ঘুরপাক খাইতেছে তাহার। কন্যার গ্রাম দর্শন আর নির্বাচনী প্রচারণা - এক ঢিলে দুই পক্ষী মারিবার মোক্ষম সুযোগটা হাতছাড়া করা উচিৎ হইবে না।
সকাল হইতে অনেকটাই প্রফুল্ল জুলিয়া। গ্রামে ইতঃপূর্বে কখনোই যাওয়া হয় নাই তাহার। প্রবাস হইতে ফিরিয়া গ্রাম দর্শনে বাহির না হইলে চলে কি করিয়া? ভাবিতে থাকে সে। তাহার উপর আবার অমন প্রভাবশালী পিতা পাওয়াও মহা ভাগ্যের ব্যাপার। রীতিমত ফোর্স লইয়া গ্রাম পরিদর্শন। গ্রাম দর্শন যেন সামাজিক আভিজাত্য প্রদর্শনের এক নগ্ন হাতিয়ার। গ্রাম জিনিসটাই তাহার পছন্দ না। তবে নিজে যতটুকুন না জানে সে, প্রবাসী বন্ধুমহলের উৎসাহ এবং স্পৃহা নিবারণের নিমিত্তে মূলতঃ তাহার আজিকার বায়না। চালকের সিটের পাশের সিটটায় বসিয়া আশেপাশের দৃশ্য ক্যামেরাবন্দীতেই ব্যস্ত থাকিলো সে।
----------------------------------------------------------------------------------
গ্রামের নাম বিরপুশিয়া। চিলাই নদীর তীর ঘেঁসিয়া অবস্থিত গ্রামটিতে অন্য আরও দশটা গ্রামের মতনই সন্ধ্যা হইলে কুঁপি জ্বলে। আঁকিয়া বাঁকিয়া চলা কাঁচা রাস্তার দুই'ধারেই ধানী জমি। উত্তরের ক্ষেতের একেবারে শেষ মাথাতেই চিলাই নদী। আর ঐ নদীর পাড় ঘেঁসিয়া একটু খানি টিলার মতোন করিয়া উঁচু সমেত জায়গাতেই রমিজ মিয়ার ঘর-সংসার।
ছোট্ট উঠানের চারিপার্শ্বে তিনটা ছনের ঘর তোলা। একটা রমিজ তাহার বউ জিলাতন আর পু্ত্র লতুর মাথা গুঁজিবার জন্য ব্যবহৃত। একটাতে থাকে রমিজের ছোট ভাই তমিজ আর তাহার বউ হাজেরা। তাহাদের পিতা বৃদ্ধ গিয়াস মিয়ার স্থান অপর ছাউনির তলায়। একদিকের কোণায় একটা বাঁশের চাটাই দিয়া তিনদিক ঘেরাও দেয়া আর সম্মুখে একাধিক ছিদ্রযুক্ত একছত্র ঝুলন্ত কাপড় দিয়া রাখা ঘর, যাহা কি না তাহাদের শৌচাগার হিসাবে ব্যবহৃত হইয়া থাকে।
চোখ পিটপিট করিতে করিতে বৃদ্ধ গিয়াস মিয়া কুঁজো হইয়া আসিয়া বসিল উঠানের এক কোণায়। তাহার সন্তানদের জন্য কিছুই করিতে পারে নাই সে - না কোনো সম্পত্তি অথবা জমিজমা করিয়াছে, না একটা থাকিবার মতন ঘর - অনুশোচণা অতিমাত্রায় তাড়া করিয়া বেড়ায় বৃদ্ধকে। পাতাবিড়ির প্রতি টানেই যেন অনুশোচণা রূপ নিয়া নেয় কোনো অমানুষিক ভয়ঙ্কর যন্ত্রণায়। জিলাতন ভাত চড়াইয়া ঘরের মেঝে লেপিবার কাজে ব্যস্ত। উঠানের মাঝামাঝি একমনে জালি কুমড়ার মাচান তুলিবার কাজে নিয়োজিত রমিজ। তাহার পাশেই পাটের কঞ্চি দিয়া অদ্ভুত আঁকিবুকিতে রত তাহার চার বছরের পুত্র লতু।
ঠিক এই সময়েই রমিজের কানে ভাসিয়া আসিলো তীক্ষ্ম সাইরেনের শব্দ। সচকিতে তাকায় সে দূরের কাঁচা রাস্তার দিকে। চার চারটা আস্ত গাড়ি আসিয়া থামিলো তাহাদের গ্রামে। হাতের দা ফেলিয়া উঠানের এক কোণায় গিয়া দাঁড়াইয়া পড়ে রমিজ।
----------------------------------------------------------------------------------
- ওয়াও
উত্তরের সরিষা ক্ষেতের দিকে চাহিয়া গাড়ি হইতে একলাফে বাহির হইয়া আসিলো জুলিয়া। সাথে সাথেই তাহার পেছনে আসীন হইলো মন্ত্রীর সাদা পোশাক পরিহিত এক চ্যালা। দেশপ্রেমিক মন্ত্রীকন্যার জন্য অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা!
- এই হইতেছে তোমার গ্রাম, বেবি। হ্যাভ ফান।
গলায় স্পষ্ট অহমিকার টান আবুল মোর্শেদের।
কিছু অতি উৎসাহী লোকজনকে দেখা যাইতেছে এদিক-ওদিক হইতে উঁকি-ঝুঁকি মারিতে। ইহাতে মন্ত্রী মহোদয়ের দম্ভ বোধ করি আরো একটুখানি বাড়িয়া গেল।
- চলো বেবি, উই উইল হ্যাভ এ রিভারসাইড ওয়াক আহেড।
- ওহ রিয়্যালি...! আই ওয়ান্না সি রিভার।
মুখে ফটর ফটর ইংরেজী বুলি আওরাইয়া দেশপ্রেমিক মন্ত্রী তাহার স্ত্রী-কন্যা সমেত নামিয়া পড়িলেন সরিষা ক্ষেতে। এই ক্ষেতটা পার হইয়া তবেই চিলাই নদী। মন্ত্রীর মাথায় ছাতা ধরিয়া আছে তাহার একান্ত ব্যক্তিগত দেহরক্ষী মোখলেছ। তাহাদের সামনে একজন সাদা পোশাকের পুলিশ; হাতে কালোমতোন একটা ওয়াকিটকি। আর পিছনে আরো দুই'জন। দূরে ভ্যানে ঠেস দিয়া বসিয়া আছে তিনটা ইউনিফর্ম পরিহিত চ্যালা। ইতঃমধ্যেই অনেক লোক জড় হইয়া গিয়াছে চারিপাশে। উৎসুক দৃষ্টিতে দেখিতেছে তাহাদের।
ক্ষেতের আইল মাড়াইয়া তাহাদের দলটা আগাইয়া চলিতেছে নদী বরাবর। কাঁচা রাস্তায় যেন মানুষের মেলা বসিয়াছে। তিনটা পুলিশ তাহাদের নিয়ন্ত্রণ করিবার চেষ্টা করিয়া যাইতেছে।
ডার্টি ভিলেজার্স...!
মনে মনে ভাবিলো জুলিয়া।
- পাপা, ডু ইউ লাভ দিস পিপল?
মুচকি হাসিলেন মন্ত্রী সাহেব।
- কি যে বলো, বেবি? হোয়াই স্যুড আই লাভ দেম? আই লেট দেম টু লাভ মি। আই লাভ মাই পাউআর।
বলিয়াই উৎসুক জনগনের উদ্দেশ্যে ভালোবাসা ছুঁড়িয়া দিবার ভঙ্গিতে হাত নাড়িলেন মন্ত্রী।
তাহারা নদীর তীরে আসিয়া উপস্থিত হইলো। জুলিয়ার হাতের ক্যামেরার যেন স্বস্তি নাই।
----------------------------------------------------------------------------------
হঠাৎ তলপেটে প্রচন্ড চাপ অনুভব করিলেন মন্ত্রী। এই চাপটা তিনি একদমই নিতে পারেন না। বাইরে টাইরে গেলে সাধারনত এই ধরনের চাপ অনুভূত হয় না। অদ্য কেনই যে হইতেছে ভাবিয়া পাইতেছেন না মন্ত্রী মহোদয়।
দরদর করিয়া ঘামিতেছেন আবুল মোর্শেদ। নিম্নচাপ ক্রমাগত বাড়িয়াই চলিতেছে। এর সহিত তাল মিলানো বড় দায়। শুকনা মুখে আবারও জনতার উদ্দেশ্যে হাত নাড়িলেন তিনি। ভাবিতেই ভালো লাগিতেছে এতটা সম্মানীয় তিনি - তিনি, তাহার স্ত্রী-কন্যা।
আবার প্রচন্ড চাপ। এইখানে হাই কমোড পাইবেন কোথায় ভাবিতেছেন তিনি। হাত উঁচাইয়া মোখলেছকে ডাকিতে যাইবেন, অমনি তাহার মুখ দিয়া অস্ফুট করুণ আর্তনাদ বাহির হইয়া আসিলো।
----------------------------------------------------------------------------------
পিটপিট করিয়া তাকাইয়া রইয়াছেন বৃদ্ধ গিয়াস মিয়া। পাঁজকালো করিয়া ধরিয়া এক মধ্যবয়স্ক লোককে তাহাদের বাড়ির দিকেই ধরিয়া নিয়া আসা হইতেছে। পিছন পিছন দৌঁড়াইয়া আসিতেছে সার্ট-প্যান্ট পরিহিত মেয়েদের মতোন দেখিতে এক ছেলে, আর এক শাড়ি পরিহিত মহিলা। সামনে ক্রমাগত একজন দৈত্য সাইজের লোক হাতে কালোমতন কি একটা বস্তুর সহিত তর্কা-তর্কি করিয়াই যাইতেছে। ঘটনা কি বুঝিতে পারিতেছেন না গিয়াস মিয়া।
- ও রে রমিজ
অস্ফুটস্বরে ডাকিয়া উঠিলেন তিনি।
দৌড়াইয়া চলিয়া আসে জিলাতন আর হাজেরা। মুখে আঁচল দিয়া দুই'জন চাহিয়া থাকে সরিষা ক্ষেত বরাবর। কিছুটা ভয় পাইয়া যায় লতু। অস্ফুটস্বরে কাঁদিতে থাকে সে।
হাতে ওয়াকিটকি অলা লোকটা প্রথমে দৌড়াইয়া উঠানে আসিয়া ঢুকিল।
- এইখানে টয়লেট কোন দিকে?
হাত উঁচাইয়া জায়গাটা দেখাইয়া দিল জিলাতন।
- বাইর হন গো। লোক আইছে।
টয়লেটের ভিতর আসীন লোকের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলিলো সে। ভিতরে একটু আগেই ঢুকিয়াছে রমিজ।
কথার কোনো তোয়াক্কা না করিয়াই ওয়াকিটকিওয়ালা মোখলেছ কাপড়ের ঢাকনি উঠাইয়া রমিজকে অর্ধনগ্ন অবস্থাতেই টানিয়া হিঁচড়াইয়া বাহির করিয়া নিয়া আসিলো।
----------------------------------------------------------------------------------
ইতঃমধ্যেই মন্ত্রী তাহার লোকসমেত আসিয়া উপস্থিত হউন। তাহাকে সাদা পোশাকের কয়েকজন চ্যালা মিলিয়া বসাইয়া দেয় একটা গর্ত করিয়া রাখা প্রাকৃতিক কমোডের মতন স্থানে, যেইখানে আবার দুই পা রাখিবার জায়গায় কেবলি দুইটা ইট ফালাইয়া রাখা। শৌচাগারের দেখা পাইয়া অবশেষে মন্ত্রী মহোদয় খুব স্বস্তি পাইলেন।
পর্দা নামাইয়া দেয়া হইলো। শৌচাগারের দিকে পস্চাৎদেশ দিয়া দুই চ্যালা ঠিক হলিউডী স্টাইলে উহার সম্মুখে মলত্যাগরত মন্ত্রীর পাহারায় নিয়োজিত থাকিলো।
উঠানের এক কোণায় মন্ত্রীর স্ত্রী-কন্যা-কে পাহারারত অবস্থায় মোখলেছ ক্রমাগত ওয়াকিটকিতে কথা বলিয়াই যাইতেছে; একহস্তে ওয়াকিটকি আর অন্য হস্তে বদনা। বদনা আবার পানিশূন্য। পাশের নদী হইতেই পানি ভরিয়া আনিতে হইবে। অন্য কাহারো হস্তে সঁপিয়া দিতে ভরসা পাইতেছে না মোখলেছ- মন্ত্রীমহোদয়ের মলত্যাগ বলিয়া কথা।
যে কোনো সময়ই মন্ত্রীর কার্য্য সম্পাদন সম্পন্ন হইতে পারে। আর যখন তখনই তাহার ডাক পড়িতে পারে বদনার জন্য। খানিক চিন্তায় পড়িয়া গেল মোখলেছ।
আর কাঁচা রাস্তায় যেন মানুষের ঢল নামিয়াছে। তিন পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙ্গিয়া সবাই দৌড়াইয়া এইদিকেই ছুটিয়া আসিতেছে। মন্ত্রীর মলত্যাগ - খুব মজার কোনো দৃশ্য যেন।
অস্ফুট আর্তনাদে ঐ অর্ধনগ্ন অবস্থাতেই মাটিতে গড়াগড়ি খাইতে খাইতে মন্ত্রী মহোদয়ের মলত্যাগের দৃশ্য দেখিতে থাকে রমিজ। খানিক উদ্ভ্রান্তের মতন এদিক-ওদিক চাওয়াচাওয়ি করিতেছে গিয়াস মিয়া। যে লোকটাকে নিয়া তাহাদের শৌচাগারে বসানো হইলো, তাহাকে অনেক পরিচিত লাগিতেছে তাহার।
এই গ্রামেরই আবুল হাশেমের পুত্র মোর্শেদ নয় তো?
গেরামের পুলা, গেরামেই হাগিতেছে।
ভাবে গিয়াস মিয়া।
----------------------------------------------------------------------------------
নিশুতি রাত।
চাঁদের আলোয় উঠানে বসিয়া আছে রমিজ, তাহার পু্ত্র লতু, হাজেরা আর গিয়াস মিয়া।
- এবা একটা কাম অইল আইজ।
বলে গিয়াস মিয়া।
কোনো কথা নাই রমিজের মুখে। সকালের ঘটনাটা মনে পড়িয়া যায় তাহার। অর্ধনগ্ন অবস্থাতে তাহাকে শৌচাগার হইতে বাহির করিয়া ফেলিয়া দেয়ায় কেমন যেন একটু অপমানিত বোধ করে সে। তাহার কোলে মাথা রাখিয়া শুইয়া থাকা লতু আমতা আমতা করিয়া হঠাৎই বলিয়া উঠে,
- আববা, মোনতি রাও কি হাগে?
মন্ত্রীদের নিয়া পিতার মুখ নিঃসৃত অনেক রূপকথার কল্পকাহিনী শুনেছে সে। মন্ত্রীদেরও যে প্রাকৃতিক কাজকর্ম সারিতে হয়, তাহা ঠিক ঠাউর করিয়া উঠিতে পারিতেছিল না সুকোমল হৃদয়ের অধিকারী লতু।
ছেলের প্রশ্নে হঠাৎ রমিজের মুখে হাসির রেখা দেখিতে পাওয়া গেল। ঠিকরে আলো বিকিয়ে যাওয়া ঐ চাঁদের দিকে চাহিয়া থাকিয়া হাসিতে হাসিতে বলিলো,
- হ রে পুত, মোন্ত্রিরাও হাগে রে পুত। মোন্ত্রিরাও হাগে।
দুই চোখে বিস্ময় নিয়া তাকাইয়া থাকে লতু।
----------------------------------------------------------------------------------