"আর পারছি না, জলেশ্বরী গ্রামের ইব্রাহিম গাজী আমাকে ঘুমাতে দেয় না। মাঝে মাঝে মনে হয় লাফিয়ে পড়ি ছাদ থেকে।"- সত্যিই তিনি লাফিয়ে পড়েছিলেন ছাদ থেকে। আর এই আত্মহত্যার পিছনের কারনের মরিয়া অনুসন্ধানে জলেশ্বরীর পথে নামে তার আমেরিকা প্রবাসী পুত্র।
কিন্তু সে রহস্যভেদী যাত্রা ছিল জীবনকে নতুন চোখে দেখার এক অনন্য অভিজ্ঞতা। প্রাচুর্যের মাঝে বড় হওয়া অন্তর্মুখী স্বভাবের আমেরিকা ফেরত এই ছেলেই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র; যাকে লেখক উত্তম পুরুষের সম্বোধনে চিত্রিত করেছেন। তাই উপন্যাস পড়তে গিয়ে পাঠকের মনে হবে সে নিজেই যেন বজরায় চেপে জলেশ্বরীর দিকে ছুটে চলেছে।
আটাশির বন্যায় যখন বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো ক্রমবর্ধমান রাক্ষুসে পানির নিচে মুমূর্ষু অবস্থায় ধুঁকছে, তখনই আপনি গিয়ে উপস্থিত হবেন ‘জলছর’ নামে এক গ্রামে। প্রাকৃতিক দূর্যোগ আর দারিদ্র্যের রুপ যে কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে তার কিছুটা নিদর্শন মেলে এখানে- “...এই অদ্ভুত জগত আমার কাছে অপরিচিত ছিল। লোভ নয়, ক্ষুধার জন্য বাবা মেয়েকে বেচতে এনেছে; স্ত্রী ক্ষুধায় স্বামীকে ছাড়ে, ধর্ম ছাড়ে! সমাজ, ধর্ম, সংস্কার এখানে ক্ষুধার কাছে পরাজিত হয়। এখানে মানুষ খোদার চেয়ে ক্ষুধাকেই বেশি ভয় পায়।...”
জলছরে কাঙ্ক্ষিত ‘ইব্রাহিম গাজী’র সন্ধান না পেয়ে আপনি যাত্রা করেন “জলছরি”র পানে অথবা জীবনের আরো কিছু কঠিনতম সত্যের পানে। এই পথে আপনার সাথে দেখা মিলবে বজলু-লিয়াকতদের মতন লোভী আর নীচ মানুষের, কমলার মতন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অসহায় নারীর আর “বুজি” নামের এক বর্ষীয়সী ছায়াদায়িনী বটবৃক্ষের। মেকু আর সগীর আপনাকে জানিয়ে দিবে যে, রিপুর তাড়নায় আর স্বার্থের প্ররোচনায় জঘন্যতম অন্যায়গুলোও অবলীলায় করে যেতে পারে একমাত্র মানুষই।
আবার মানুষই পারে সকল অন্ধবিশ্বাসকে দূরে ঠেলে নিঃস্বার্থভাবে নিজেকে পরের কল্যানে উৎসর্গ করতে। তেমনই একজন হলো তাপসী। দেবীতুল্যা এই রমণী গ্রামবাংলার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অবহেলিত নিঃসঙ্গ নারীর প্রতিচ্ছবি যার চলার পথ শুধুই কণ্টকাকীর্ণ। যার পাশে দাঁড়াতে গেলেও সইতে হয় অপবাদ আর লাঞ্ছনা। শিবপুরে তাপসীর হাজির হওয়াটা অতি কাকতালীয় হলেও মানতে কষ্ট হয়না। বরং অবচেতন মন যেন চাইছিলই “তাদের” দু’জনের আবার দেখা হোক।
আরেক নিঃস্বার্থ চরিত্রের দেখা মিলবে আপনার সাথে। মুক্তিযোদ্ধা আসাদউদ্দীন। একহাজার লাশ সৎকারের লক্ষ্যে যে ছুটে চলেছে গ্রামের পর গ্রাম। “...যুদ্ধের সময় এত লাশ নিজ হাতে দাফন করেছি যে পরে অভ্যাসটা আর ছাড়তে পারিনি। নেশা হয়ে গেছে। তাছাড়া এখন মানুষের চেয়ে লাশগুলোই বেশি মানবিক। যেখানে শুইয়ে দিবে চুপচাপ শুয়ে থাকবে। জাত পাত নিয়ে ঝগড়া করবে না।...” সেক্টর কমান্ডারের দেয়া ওভারকোট আগলে চলা এই মানুষটি কি পারে শেষ পর্যন্ত তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছাতে? আমি কি পারবো “জলেশ্বরী” পৌঁছাতে?
আর “ইব্রাহিম গাজী”? তাকেই কি শেষ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়? পিতার আত্মহত্যার সাথে জলেশ্বরীর সম্পর্কের ছিন্ন সূত্রটি কি শেষ পর্যন্ত জোড়া লাগানো সম্ভব হয়? “...আমি জানিনা, যে অন্ধকার ঘরের দরজা খুলতে চাচ্ছি তাতে কি আছে। আমার মনে প্রবল আশঙ্কা, সেই ঘরে হয়ত কোন ভয়ানক গল্প লুকিয়ে আছে। সেই গল্পটি আমার জানা চাই, কিন্তু একইসাথে গল্পটিকে ভয়ও পাই।...”
বন্যাকালীন দুঃসহ জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা, রুদ্র প্রকৃতির কাছে নিজেকে সঁপে দেয়া, খাদ্যের অভাব, বন্যাপরবর্তী মহামারী আকারে কলেরা আক্রান্ত জনপদের অসহায়ত্ব, একের পর এক মৃত্যুর চিত্র আর এরই মাঝে স্বার্থলোলুপ মানুষের সুযোগ নেয়ার চালচিত্র আপনাকে প্রতিমুহুর্তে এগিয়ে নিয়ে যাবে উপন্যাসের শেষভাগে। আর শেষে এসে আপনি ভিতরে ভিতরে একটি ভীষণরকম নাড়া খাবেন। মোটকথায়; এক বসায়, এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার মতই একটি বই জলেশ্বরী।
লেখক ওবায়েদ হক খুব সহজ কথায় জীবনের কিছু গভীর দর্শন আপনার সামনে এনে হাজির করেছেন। তাঁর স্বভাবসুলভ সূক্ষ্ম রসবোধের পরিচয়ও পাওয়া যাবে ভাষাবিন্যাসে। প্রতিটা চরিত্র অংকনে তিনি যত্নের কার্পন্য করেননি। দুই মলাটের মাঝে ১১২ পৃষ্ঠার একটা পরিপূর্ণ 'কোয়ালিটি টাইম' পাওয়া যাবে উপন্যাসটি নিয়ে বসলে। আর বইয়ের শেষে লেখক পরিচিতি অংশটি আপনার জন্য অবশ্যই আরেকটি চমক হয়ে থাকবে। আমি কিন্তু একটুও বাড়িয়ে বলছিনা!