somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পাঠ প্রতিক্রিয়া - "জলেশ্বরী"

০৪ ঠা জুলাই, ২০১৬ দুপুর ২:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

"আর পারছি না, জলেশ্বরী গ্রামের ইব্রাহিম গাজী আমাকে ঘুমাতে দেয় না। মাঝে মাঝে মনে হয় লাফিয়ে পড়ি ছাদ থেকে।"- সত্যিই তিনি লাফিয়ে পড়েছিলেন ছাদ থেকে। আর এই আত্মহত্যার পিছনের কারনের মরিয়া অনুসন্ধানে জলেশ্বরীর পথে নামে তার আমেরিকা প্রবাসী পুত্র।

কিন্তু সে রহস্যভেদী যাত্রা ছিল জীবনকে নতুন চোখে দেখার এক অনন্য অভিজ্ঞতা। প্রাচুর্যের মাঝে বড় হওয়া অন্তর্মুখী স্বভাবের আমেরিকা ফেরত এই ছেলেই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র; যাকে লেখক উত্তম পুরুষের সম্বোধনে চিত্রিত করেছেন। তাই উপন্যাস পড়তে গিয়ে পাঠকের মনে হবে সে নিজেই যেন বজরায় চেপে জলেশ্বরীর দিকে ছুটে চলেছে।

আটাশির বন্যায় যখন বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো ক্রমবর্ধমান রাক্ষুসে পানির নিচে মুমূর্ষু অবস্থায় ধুঁকছে, তখনই আপনি গিয়ে উপস্থিত হবেন ‘জলছর’ নামে এক গ্রামে। প্রাকৃতিক দূর্যোগ আর দারিদ্র্যের রুপ যে কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে তার কিছুটা নিদর্শন মেলে এখানে- “...এই অদ্ভুত জগত আমার কাছে অপরিচিত ছিল। লোভ নয়, ক্ষুধার জন্য বাবা মেয়েকে বেচতে এনেছে; স্ত্রী ক্ষুধায় স্বামীকে ছাড়ে, ধর্ম ছাড়ে! সমাজ, ধর্ম, সংস্কার এখানে ক্ষুধার কাছে পরাজিত হয়। এখানে মানুষ খোদার চেয়ে ক্ষুধাকেই বেশি ভয় পায়।...”

জলছরে কাঙ্ক্ষিত ‘ইব্রাহিম গাজী’র সন্ধান না পেয়ে আপনি যাত্রা করেন “জলছরি”র পানে অথবা জীবনের আরো কিছু কঠিনতম সত্যের পানে। এই পথে আপনার সাথে দেখা মিলবে বজলু-লিয়াকতদের মতন লোভী আর নীচ মানুষের, কমলার মতন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অসহায় নারীর আর “বুজি” নামের এক বর্ষীয়সী ছায়াদায়িনী বটবৃক্ষের। মেকু আর সগীর আপনাকে জানিয়ে দিবে যে, রিপুর তাড়নায় আর স্বার্থের প্ররোচনায় জঘন্যতম অন্যায়গুলোও অবলীলায় করে যেতে পারে একমাত্র মানুষই।

আবার মানুষই পারে সকল অন্ধবিশ্বাসকে দূরে ঠেলে নিঃস্বার্থভাবে নিজেকে পরের কল্যানে উৎসর্গ করতে। তেমনই একজন হলো তাপসী। দেবীতুল্যা এই রমণী গ্রামবাংলার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অবহেলিত নিঃসঙ্গ নারীর প্রতিচ্ছবি যার চলার পথ শুধুই কণ্টকাকীর্ণ। যার পাশে দাঁড়াতে গেলেও সইতে হয় অপবাদ আর লাঞ্ছনা। শিবপুরে তাপসীর হাজির হওয়াটা অতি কাকতালীয় হলেও মানতে কষ্ট হয়না। বরং অবচেতন মন যেন চাইছিলই “তাদের” দু’জনের আবার দেখা হোক।

আরেক নিঃস্বার্থ চরিত্রের দেখা মিলবে আপনার সাথে। মুক্তিযোদ্ধা আসাদউদ্দীন। একহাজার লাশ সৎকারের লক্ষ্যে যে ছুটে চলেছে গ্রামের পর গ্রাম। “...যুদ্ধের সময় এত লাশ নিজ হাতে দাফন করেছি যে পরে অভ্যাসটা আর ছাড়তে পারিনি। নেশা হয়ে গেছে। তাছাড়া এখন মানুষের চেয়ে লাশগুলোই বেশি মানবিক। যেখানে শুইয়ে দিবে চুপচাপ শুয়ে থাকবে। জাত পাত নিয়ে ঝগড়া করবে না।...” সেক্টর কমান্ডারের দেয়া ওভারকোট আগলে চলা এই মানুষটি কি পারে শেষ পর্যন্ত তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছাতে? আমি কি পারবো “জলেশ্বরী” পৌঁছাতে?

আর “ইব্রাহিম গাজী”? তাকেই কি শেষ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়? পিতার আত্মহত্যার সাথে জলেশ্বরীর সম্পর্কের ছিন্ন সূত্রটি কি শেষ পর্যন্ত জোড়া লাগানো সম্ভব হয়? “...আমি জানিনা, যে অন্ধকার ঘরের দরজা খুলতে চাচ্ছি তাতে কি আছে। আমার মনে প্রবল আশঙ্কা, সেই ঘরে হয়ত কোন ভয়ানক গল্প লুকিয়ে আছে। সেই গল্পটি আমার জানা চাই, কিন্তু একইসাথে গল্পটিকে ভয়ও পাই।...”

বন্যাকালীন দুঃসহ জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা, রুদ্র প্রকৃতির কাছে নিজেকে সঁপে দেয়া, খাদ্যের অভাব, বন্যাপরবর্তী মহামারী আকারে কলেরা আক্রান্ত জনপদের অসহায়ত্ব, একের পর এক মৃত্যুর চিত্র আর এরই মাঝে স্বার্থলোলুপ মানুষের সুযোগ নেয়ার চালচিত্র আপনাকে প্রতিমুহুর্তে এগিয়ে নিয়ে যাবে উপন্যাসের শেষভাগে। আর শেষে এসে আপনি ভিতরে ভিতরে একটি ভীষণরকম নাড়া খাবেন। মোটকথায়; এক বসায়, এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার মতই একটি বই জলেশ্বরী।

লেখক ওবায়েদ হক খুব সহজ কথায় জীবনের কিছু গভীর দর্শন আপনার সামনে এনে হাজির করেছেন। তাঁর স্বভাবসুলভ সূক্ষ্ম রসবোধের পরিচয়ও পাওয়া যাবে ভাষাবিন্যাসে। প্রতিটা চরিত্র অংকনে তিনি যত্নের কার্পন্য করেননি। দুই মলাটের মাঝে ১১২ পৃষ্ঠার একটা পরিপূর্ণ 'কোয়ালিটি টাইম' পাওয়া যাবে উপন্যাসটি নিয়ে বসলে। আর বইয়ের শেষে লেখক পরিচিতি অংশটি আপনার জন্য অবশ্যই আরেকটি চমক হয়ে থাকবে। আমি কিন্তু একটুও বাড়িয়ে বলছিনা!

সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুলাই, ২০১৬ দুপুর ২:১৬
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×