গৃহকর্মী জান্নাতের নির্যাতনকারীকে গ্রেফতারের খবর দেখে ক্রিকেটার শাহাদাতের কথা মনে পড়ে গেলো। এবারো গুরুপাপে লঘুদন্ড হয় কিনা সেটাই দেখার বিষয়!...
বছর দেড়েক আগে এই বিষয়ে কিছু একটা লেখার চেষ্টা করেছিলাম। জান্নাতকে দেখে মনে পড়ে গেলো।
সেই লেখাটির জন্য ইউনিসেফসহ কিছু সংস্থার কেইস-রিপোর্ট ঘাটতে হয়েছিল। এই দেড় বছরে তথ্যগত কিছু পরিবর্তন হয়ত এসেছে। ব্যক্তিগত সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে লেখাটি দিলাম। চাইলে পড়তে পারেন।
.
~ঝরে পড়া নয়নতারাদের দুঃখগাঁথা~
.
নয় বছর বয়সী নয়নতারাকে যখন হাসপাতালে অচেতন অবস্থায় নেয়া হয় তখন সে বেঁচে ছিলো কিনা বোঝা যাচ্ছিলনা। দুইদিনের অভুক্ত শরীরে হাড় সবকয়টা গোনা যাচ্ছিলো। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছিলো। কদম ফুলের মতন চুলের আড়ালে মাথায় অনেকগুলো কাটাদাগ আর শরীরের বিভিন্ন স্থানে গরম ইস্ত্রির ছেঁকা ওর উপর বয়ে যাওয়া নির্যাতনের সাক্ষী দিচ্ছিলো। ডান চোখের চারপাশে ফুলে নীল হয়ে ছিলো। ডোবার পাশে পড়ে থাকা নিস্তেজ দেহটিতে প্রাণের স্পন্দন ছিলো বোধহয় সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদে।
কথাগুলো পড়ে কোন বর্বরযুগের কাহিনী বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এটা আমাদের এই ঘুণে খাওয়া সমাজের কিছু বাস্তবতার একটা উদাহরণ। এ সমাজে নয়নতারাদের পরিচয় “কাজের মেয়ে”। আর যারা তাদের এভাবে আধমরা করে সবার অলক্ষ্যে ফেলে রেখে যায় তারা সমাজের কিছু শিক্ষিত বিত্তবান মানুষ!
ILO এবং UNICEF এর হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় দেড় কোটি শিশু গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে যাদের বয়স ৫-১৭ বছর পর্যন্ত। এইসব শিশুদের ৭৫ শতাংশ হলো মেয়েশিশু। দারিদ্র্যের তাড়নায় বিভিন্ন বাসায় গৃহস্থালি কাজ করতে আসা এসব শিশু পাঁচটি মৌলিক অধিকার থেকে আংশিকভাবে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি প্রতিনিয়ত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এদের প্রতি যে নির্যাতনগুলো করা হয়-
১. পর্যাপ্ত পরিমাণ পুষ্টিকর খাদ্য থেকে বঞ্চিত,
২. পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশ্রাম থেকে বঞ্চিত,
৩. শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত,
৪. কাজে ভূল-ত্রুটি হলে গালিগালাজ এবং চড়-থাপ্পড়,
৫. ক্ষেত্রবিশেষে নির্মমভাবে শারীরিক প্রহার এবং
৬. যৌন নিপীড়ন।
১-৪ নং পয়েন্টগুলোকে Regular Torture এবং ৫ ও ৬ নং Extreme Torture ক্যাটাগরিতে ফেলা হয়েছে।
সকল প্রকারের শিশুশ্রমের মধ্যে গৃহকর্মীদের শ্রমকে নিকৃষ্টতম বলে আখ্যায়িত করা হয় কারন-
১. এই শ্রমের কোন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। এবং এই শ্রমটি International Labour Law এর অন্তর্ভুক্ত নয়। ফলে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজও এদের দিয়ে করানো হয়।
২. শিশু গৃহকর্মীদের সপ্তাহের ৭দিন গড়ে ১৬-১৭ ঘন্টা কাজ করতে হয় যা International Labour Law এর পরিপন্থী।
৩. তারওপর এমন অনেক গৃহকর্মী আছে যারা নিয়মিত কাজের মজুরী পায়না। শুধুমাত্র অন্ন এবং বাসস্থানের বিনিময়ে অনেকে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে।
৪. নির্যাতিত শিশুরা কোন প্রকার আইনী সহায়তা পায়না। কারন বন্ধ দরজার ভিতরে এদের প্রতি নির্যাতনের স্বরুপটি লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে যায়। একমাত্র এক্সট্রিম কেসগুলোই মানুষের নজরে আসে।
৫. শিশুশ্রমিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোন সুনির্দিষ্ট আইন ও শাস্তির বিধান নেই। যদি কোনভাবে নির্যাতনকারীকে সনাক্ত করা যায় তাহলে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা করা সম্ভব; যার শাস্তি হবে অপরাধের ধরন বুঝে।
হতভাগ্য এই গৃহকর্মী শিশুদের ৮০ শতাংশ আসে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী পরিবার থেকে। যাদের বাবা মা নেই অথবা থাকলেও লালন পালনের ক্ষমতা নেই। এইসব অভিভাবকেরা আইন আদালত সম্পর্কেও অজ্ঞ। তাই নির্যাতনকারী গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করার সাহসটুকু পর্যন্ত তারা রাখেনা।
নির্মমতায় ভরা এই সামাজিক সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য সর্বস্তরের মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে।
#প্রথমতঃ ব্যাক্তিগত পর্যায়ে সচেতন হতে হবে। নিজের পরিবারে বা বন্ধু, আত্মীয় কিংবা প্রতিবেশীর ঘরে কোন দরিদ্র অসহায় শিশু নির্যাতিত হচ্ছে কিনা খেয়াল রাখতে হবে। এমন কিছু দেখলেই প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ করতে হবে।
#দ্বিতীয়তঃ বিভিন্ন এনজিও এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে আরো বেশি উদ্যোগী হতে হবে যেন সুবিধাবঞ্চিত এইসব শিশুরা শিক্ষার আলো পায় এবং সুবিচারের আওতায় আসে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যম গুলোও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে।
#তৃতীয়তঃ Domestic Child Labour এর সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত। শিশুশ্রমিক নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে যথাযত আইন ও শাস্তির বিধান করা হলে এবং তার দৃষ্টান্তমূলক প্রয়োগ হলেই এই অনাচার অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
পৃথিবীটা হোক সকল শিশুর জন্য নিরাপদ আবাসভূমি।