আজ বাংলাদেশ স্বাধীন। কিন্তু আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হওয়া মাতৃভাষার বিরুদ্ধে চক্রান্ত আজও থামেনি। আজও আমরা সুনিয়ন্ত্রিত সুশৃঙ্খল বাংলাভাষাকে বিধি-বদ্ধ করতে পারিনি। আজও সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার শতভাগ নিশ্চিত করতে পারিনি। কারণ একদল উচ্চ শ্রেণী যারা নিজেদের আভিজাত্যের অদৃশ্য অহংকারের মোড়কে ঢেকে রাখতে সরকারের উচ্চ প্রতিষ্ঠান গুলিতে বাংলার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার করেন। অথচ বাংলা ভাষার ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে সেই ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে ব্যবহার করার ঘোষণা করা হয়। তৎকালীন বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের নেতা বাংলার মহা নায়ক জাতির জনক শেখ মজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমীর একুশের অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী ভাষণে দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, “ আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে সেদিন থেকেই দেশের সর্ব স্তরে বাংলাভাষা চালু হবে।’’ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নির্বাহী আদেশে বাংলা ভাষার ব্যবহার চালু হয়। সেই ধারাবাহিকতায় মহান সংবিধান বাংলায় লিপিবদ্ধ করা হয়।
সংবিধানের (৩) অনুচ্ছেদে “ প্রজাতন্ত্রেও রাষ্ট্রভাষা বাংলা” ঘোষিত হয়। সংবিধানের ১৫৩(৩) অনুচ্ছেদে বাংলা পাঠের সাথে ইংরেজি পাঠের বিরোধের ক্ষেত্রে বাংলা পাঠের প্রাধান্য ঘোষিত হয়। উচ্চ আদালতেও দৈনিক শুনানির কার্যতালিকা বাংলায় ছাপা হত। কিন্তু তখনও একশ্রেণীর উচ্চ-শিক্ষিত মহল বাংলাকে উপেক্ষা করে ইংরেজি ভাষার প্রতি অতি-প্রীতি দেখাতে থাকে। ১৯৭৫ সালের ১২ই মার্চ তারিখে এক প্রজ্ঞাপন জারীর মাধ্যমে জাতির জনক শেখ মজিবুর রহমান কঠোর ভাবে ঘোষণা করেন, “ সকল সরকারী, আধা-সরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে বাংলাভাষা ব্যবহার করতে হবে। এবং আদেশ অমান্যকারীকে শাস্তি প্রদান করা হবে। শুধু মাত্র বিদেশের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে বাংলার সাথে ইংরেজি বা সংশ্লিষ্ট ভাষার একটি প্রতিলিপি নির্মাণ করতে হবে।’’ অফিস আদালতের কর্তা ব্যক্তিদের সর্তকতার সাথে উক্ত আদেশ কার্যকরী করার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালে জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার পরে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরে আবার সেনা শাসকদের দ্বারা ও তাদের আনুকূল্য লোভী শ্রেণীর দ্বারা ইংরেজি ভাষার ব্যবহার বৃদ্ধি পেতে থাকে।
আজও ভাষা আন্দোলন থামেনি। স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বত্র বাংলা ভাষার শতভাগ ব্যবহার নিশ্চিত করা আজও সম্ভব হয়নি। এর পিছনে যাদের গলদ আছে তাদের জন্য অষ্টাদশ শতকের কবি আব্দুল আওয়ালের কবিতার ভাষায় বলতে চাই-
“ যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুড়ায়।
নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যায়।।”
একুশ আমাদের চেতনা। একুশ আমাদের সত্ত্বা। একুশ আমাদের গর্ব। একুশ আমাদের মাথা উন্নত রাখার ব্রত। একুশ আমাদের মুক্তির পথপ্রদর্শক। একুশের দেখানো পথেই আজ আমরা স্বাধীন। বিশ্ব মানচিত্রে একমাত্র স্বাধীন বাঙালি রাষ্ট্র। একুশ আমাদের ভাষা ভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের কথা বলে। একুশ আমাদের অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার কথা বলে। অন্যায়, অনিয়ম, দুর্নীতি ও শোষণ মুক্ত রাষ্ট্র গঠনের কথা বলে। অন্যায়, অনিয়ম, দুর্নীতি ও শোষণ মুক্ত রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে এবং সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার শপথ গ্রহণ করে বারবার ২১শের প্রভাত ফেরীতে গেয়ে উঠি-
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি?”
মশিউর রহমান
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ২:২৪