somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পতনের মিছিল

০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ২:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চুপচাপ ঘরমুখো শৈশবের পর এক রকম হঠাৎ করেই যেন গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু মুশকিলটা হয়ে গেলো বাইরে বেরুবার পর, সামনে এতো অনেক বড় জগত! কোন দিকে যাব? কি করবো? যে দিকে যাবো কেনই বা সেদিকে যাবো, আর অন্যদিকে কেন না? কেনই বা যা কিছু করবো তাই শুধু করবো আর কেনই বা অন্য কিছু করবো না? এসব নানা ভাবনার ঘোর-প্যাঁচের দ্বন্দে ঘুরপাক খেতে খেতে বেহাল দশা প্রায়।

তো আমার যৌবনের যখন শৈশব, তখন এরকম কঠিন অবস্থা থেকে আমাকে উদ্ধার করলেন রবি ঠাকুর। কিভাবে যেন তাঁর সাক্ষাত মিলে গেলো! তিনি আমার হাত ধরে তাঁর ঘরে নিয়ে বসালেন। দেখালেন কোন পথের কি মায়া আর সে মায়ায় পড়লে কোথায় যেয়ে পৌঁছুনো যায়। রবি ঠাকুরই প্রথম আমাকে বললেন, আশেপাশের আর সকলে যে পথে চলেছে তাতে সফলতার দেখা ঠিকই মেলে, কিন্তু জীবনের স্বাদ সেখানে বড় পানসে।

সেই আমি প্রথম জানলাম, জীবনের স্বাদ বলে কিছু আছে। আমি জানলাম জীবন বলেই কিছু আছে।

জীবনানন্দ দাশ তখন পাশ থেকে আমাকে জানালেন, ফড়িং দোয়েলের জীবন আর মানুষের জীবন এক নয়।

আমি জানলাম আমার কিছু করার আছে। কিন্তু কি যে করার আছে তা জানালেন না কেউ আমাকে।

আমি নজরুলের কাছে গেলাম। তিনি আমাকে মানুষের হাহাকার আর দুর্দশার চিত্র দেখিয়ে সাম্যের মন্ত্র শোনালেন। আমাকে কি করতে হবে না বলেই বিদায় দিলেন।

আমি অসহায়ের মতো এখানে ওখানে ছুটলাম। এঁর কাছে তাঁর কছে গেলাম আমার কি করণীয় জানতে। সকলেই আমাকে এই বলে দিলেন শুধু, স্রোতে গা না ভাসিয়ে অন্য পথে চলতে। জানালেন, সে পথ আমাকেই খুঁজে নিতে হবে, নিজের মতো করেই।

আমি খুঁজলাম। পাগলের মতো খুঁজলাম। আজো জানি না, ঠিক পথে আছি কি না। তবে জানি যে পথে চলেছি তা আমার নিজের পথ। আমিই এর স্রষ্টা। পথ খুঁজে খুঁজে আমি ক্লান্ত প্রাণ হইনি কখনো। আমি খুঁজেছি। আমি আমার নিজের পথে চলেছি।

শহরটার চেহারা বদলে গেছে অনেক। এখানে খেলার মাঠ ছিল, বিকেল হলেই গোল্লাছুট বা দাড়িয়াবান্ধা খেলা যেমন হতো, ক্রিকেট আর ফুটবলও চলতো পাশাপাশি। রাস্তার ধারে, অনেকের বাড়ির সামনে বা পিছনে বড় পুকুর ছিল, সেখানে নির্মল আনন্দে এলাকার অনেক শিশু কিশোরেরা একসাথে পানি ছিটিয়ে ঝাঁপিয়ে লাফালাফি হুড়োহুড়ি করে গোসল করতো, বেলা হলে পরে। জ্যৈষ্ঠ মাসে ঝড়ের পরে আম কুড়াতো সব বাড়ির ছেলে-মেয়েরা, একসাথে, কাড়াকাড়ি করে, সে কি আনন্দ। বৃষ্টিতে ভেজার সে কি নেশা সবার! মাঠ আর পুকুরগুলোর অধিকাংশই এখন বহুতল ভবনের নিচে চাপা পড়ে গেছে। মিলেমিশে ওরকম সব সময়ও চাপা পড়ে গেছে, তলিয়ে গেছে যেন। আমার জন্মভূমি, আমার শৈশবভূমি প্রিয় ফরিদপুর শহর বদলে গেছে অনেক অনেক। এই বদলে যাওয়া খুব দ্রুত ঘটে গেলো। সবাই চেয়ে চেয়ে দেখল। কেউ কিছু বলল না, কিছু করলো না বদল ঠেকাতে। আমি মেনে নিতে পারি না। কিন্তু আমার মেনে না নেয়ায় তো কোথাও কোন প্রভাব পড়বে না। আমার মেনে নেয়া না নেয়ায় কার কি এসে যায়।

এসব বদলের সাথে অনেক বড় বড় লাভ আর সফলতার হিসাব যুক্ত হয়ে আছে। কাজেই আমার চিৎকার আমারই ভেতরে জমে জমে কেঁদে ওঠে। বদলের এই ধারা তো আর শুধু এ শহরেই নয়, বদল ঘটে চলেছে সবখানে। বদলে যাচ্ছে, বদলে দিচ্ছে সকলে সকলকে। অনেক শক্তিশালী এ বদলের ধারা। আমার মেনে নিতে কষ্ট হয়। মনে হতে থাকে যেন পতনের গহ্বরে এগিয়ে চলেছি আমরা সমবেতভাবে।

এক সময় ভাবতাম একাই বোধহয় অনেক কিছু করে ফেলবো। নিজের পতন ডেকে এনে, মেনে নিয়ে, সমাজের এইসব পতন ফেরাবো আমি, আমি একাই। কত অপরিপক্ক সে ভাবনা! ফলাফল নিজের পতন, চারপাশের আর সবার চোখে, আমার ঘটে গেল ঠিকই। কিন্তু পতন ফিরলো না কোনো। আমার শহর ক্রমে বদলে যেতে থাকলো, আধুনিক চকচকে হয়ে উঠছে দিনে দিনে। আমার দেশও বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে। শুধু এদেশের মানুষগুলোর সাথে, আমার শহরের মানুষগুলোর সাথে সে তাল মিলছে কি না সেদিকে তাকিয়ে দেখছে না কেউ।

আমি বিদ্রোহ করি। আমার সে বিদ্রোহের স্বর বদলে দেয়ার বদলে যাবার মন্ত্রণাদাতাদের কান পর্যন্ত হয়তো পৌঁছায় না। তবু আমি বিদ্রোহ করি। মানুয়ের মৌলিকতার বদলের বিরুদ্ধে আমি শামিল হই মানুষের মিছিলে। মানুষের উদ্বোধনের স্বপ্নে বিশ্বাসী হয়ে আমি ডাক দেই মানুষের সম্মেলন। মানুষের মাঝে আমি এখনো খুঁজে বেড়াই কোন এক নুরলদিনকে যে কিনা জেগে উঠবার ডাক দেবে স্বজোরে, আর জেগে উঠবে মানুষ। হয়ে উঠবে স্বজন আবার সবাই সবার। হয়ে উঠবে খেলার মাঠের বন্ধু, হয়ে উঠবে গামছায় মাছ ধরে আবার ছেড়ে দেয়া দুষ্টামির ভাগীদার।

নানা ভাবনার দ্বন্দ কাটিয়ে আমি মেতে উঠি আমার পতনের পথের খোঁজে। দেখানো পথ আর শেখানো মত মতো না চলে আমি চলেছি আমারই মতো করে। চলেছি একান্ত আমার মতে। আমি হেঁটেছি বন্ধুর পথে। মাথার উপরে ঝড়ঝাপটা বাধা বিপত্তি নিয়ে আমি নীল আকাশ দেখেছি। এগিয়েছি উর্বর পলি মাটিতে হাঁটবো বলে। গায়ে মেখেছি ধুলা-কাদা। আমি কখনো যাইনি থেমে। ক্রমেই এগিয়েছি আমার পতনের পথে। থেকেছি পতন ফেরানোর স্বপ্নে বিভোর। এ শহরের অলিগলি আমি ছুটে বেড়িয়েছি সে স্বপ্ন চোখে মেখে নিয়ে। করেছি মানুষে মানুষে সম্পর্কের সেতু বোনার সাধনা। কতটা কি পেরিছি বা পারিনি, কি হয়েছে বা হয়নি সে হিসাব নিকাশের সময় বোধ করি আসেনি এখনো। কিছুটা আত্মঅহংকারী হয়েই বলছি, একদিন এ শহর ঠিক আমার করে যাওয়া কর্মের ফল ভোগ করবে। হয়তো জানবে না তারা কেউ পেছনের কোন কথা।

আমার ভাবনার জগতে আমি এখনো সাজিয়ে রেখেছি সেই শহরের রূপ, যার মায়ায় আজও আমি বারবার ছুটে আসি এই শহরে। এ চাওয়া শুধু তো নিজের শহরকে নিয়েই নয়, এ দেশ কে নিয়ে, এ মাটিকে নিয়ে। আমি স্বপ্ন দেখি যুক্তিবাদী তরুণ মুখের দিকে তাকিয়ে। এমন পথ-চলা আমার একার হয়তো নয় আর, ছিল না কোনদিন। নিজের নিজের পথে চলে এ পথ চলায় শামিল ছিলেন তো অনেকেই। সামনে ছিলেন রবি ঠাকুর, নজরুল, জীবনানন্দ। ছিলেন আমাদের পিতা শেখ মুজিব, তাজউদ্দীনসহ আরও আরও অনেকে। হেঁটে চলি তাদেরই প্রেরণায় আমার নিজের পথে। পেছন ফিরে দেখতে এখন আর ভয় হয় না তেমন, মন জানে পেছনে রয়েছে সপ্নে বিভোর হাজার তরুণ দল। শুধু চিৎকার দিয়ে নয় তারা তাদের স্বপ্ন ছড়িয়ে দেবে, বুঝিয়ে দেবে যুক্তি দিয়ে। কারণ তাদের ইচ্ছে শক্তি এখনো আছে বেঁচে।

এগিয়ে চলি তাই মিছিল নিয়ে... পতনের মিছিল অথবা পতন ফেরানোর মিছিল।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নারী একা কেন হবে চরিত্রহীন।পুরুষ তুমি কেন নিবি না এই বোজার ঋন।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১২:৫৪



আমাদের সমাজে সারাজীবন ধরে মেয়েদেরকেই কেনও ভালো মেয়ে হিসাবে প্রমান করতে হবে! মেয়ে বোলে কি ? নাকি মেয়েরা এই সমাজে অন্য কোন গ্রহ থেকে ভাড়া এসেছে । সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

=সকল বিষাদ পিছনে রেখে হাঁটো পথ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৮



©কাজী ফাতেমা ছবি

বিতৃষ্ণায় যদি মন ছেয়ে যায় তোমার কখনো
অথবা রোদ্দুর পুড়া সময়ের আক্রমণে তুমি নাজেহাল
বিষাদ মনে পুষো কখনো অথবা,
বাস্তবতার পেরেশানী মাথায় নিয়ে কখনো পথ চলো,
কিংবা বিরহ ব্যথায় কাতর তুমি, চুপসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×