বাংলা ও বাঙালির রয়েছে হাজার হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য। ধারাবাহিকভাবে তারই কিছু বিচ্ছিন্ন চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করবো এখানে। এ লেখা তৈরি করতে যেয়ে উদারভাবে গ্রহণ করেছি বিভিন্ন বই, পত্রিকা ও ব্লগে প্রকাশিত লেখা থেকে। ছবিও নিয়েছি ইন্টারনেট থেকে। সকল উৎসের প্রতি কৃতজ্ঞ আমি।
ভৌগলিক সীমনা:
সবুজের অরণ্যে ঘেরা দেশ বাংলাদেশ। পাহাড়, নদী আর সাগরের অপূর্ব মোহনা এই দেশ। ভৌগলিক বিবেচনায় বাংলাদেশ এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণে অবস্থিত। এর উত্তরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, অরুনাচল ও আসাম রাজ্য, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে আসাম, ত্রিপুরা রাজ্য ও মায়ানমার এবং পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ।
বাংলার আয়তন:
বাংলাদেশের আয়তন প্রায় ৫৫,৫৯৮ বর্গমাইল বা ১৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটার।
পৃথিবীর আর সব ভূখণ্ডের মতো বঙ্গভূমিতেও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে জনপদ ও রাজ্য গড়ে উঠেছিল। সময়ের পরিক্রমায় সেসব বিলুপ্ত হয়ে আবার নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করেছিল। তারই ধারাবাহিকতা আজকের বাংলাদেশ। এর কাঠামো বা পরিধি সবসময় এক রকম ছিল না। ঐতিহাসিক ও পুরাতত্ত্ববিদগণ বাংলার বিভিন্ন সময়ের অবস্থার চিত্র তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন।
প্রাচীন নিদর্শন:
এখন পর্যন্ত পাওয়া নিদর্শনসমূহের ভেতরে বর্ধমান জেলার দমোদর নদীর তীরে বীরভানপুরে পাওয়া ছয় হাজার বছরের পুরনো প্রত্ন নিদর্শনকে সবচেয়ে প্রাচীন বলে মনে করা হয়। তা থেকে পণ্ডিতজনেরা অনুমান করেন এখানেই ছয় থেকে দশ হাজার বছর আগে বাঙালি জনগোষ্ঠীর বসতি শুরু হয়েছিল।
পাণিনির ব্যাকরণের ভাষ্যকার পতঞ্জলি প্রায় ২ হাজার বছর আগে বঙ্গভূমির অধিবাসী তিনটি মুখ্যজাতি ও তাদের দেশের নাম উল্লেখ করেছেন। এগুল হল- বঙ্গাঃ, সুহ্মাঃ, পুণ্ড্রাঃ অর্থাৎ, বঙ্গ জাতি ও তার দেশ, সুহ্ম জাতি ও তার দেশ, পুণ্ড্র জাতি ও তার দেশ। (বাংলা ও বাঙালির কথা- আবুল মোমেন)
• বঙ্গ হল গঙ্গা বা পদ্মার অববাহিকা। অর্থাৎ, বর্তমান ফরিদপুর, ঢাকা ও সংলগ্ন এলাকা।
• সুহ্ম গঙ্গার শাখা নদী দমোদর-হুগলীর পশ্চিম তীরের মেদিনীপুর এবং মোহনার কলকাতা-হাওড়া নিয়ে গঠিত ছিল। আরেক পর্যায় সুহ্মরই নাম হয় দক্ষিণ রাঢ়া।
• পুণ্ড্র পদ্মার উত্তরাঞ্চলের বর্তমান পাবনা, বগুড়া, রাজশাহী নিয়ে গঠিত। আরও পরে, খ্রিস্টীয় অষ্টম-নবম শতকের দিকে এই অঞ্চলেরই নাম হয় বরেন্দ্র বা বরেন্দ্রী।
ইতিহাসবিদের মতামত:
পরবর্তীকালের বঙ্গ ছোট ছোট অঞ্চলে বিভক্তছিল। যেমন: "বঙ্গাঃ, রাঢ়ীয়ঃ:, পুন্ড্রী নামে বিভিন্ন কৌমের জনেরা যেসব অঞ্চলে বাস করত তাদের নাম হলো বঙ্গ, গৌড়, পুন্ড্র ইত্যাদি। প্রাচীন লিপিতে যেসব অঞ্চলের নাম উল্লেখিত আছে তাদের সঠিক সীমানা সবসময় বোঝা যায় না। প্রাচীনকালে রাষ্ট্র-পরিধির বিস্তার ও সংকোচনের সঙ্গে সঙ্গে জনপদের সীমান্ত বিস্তৃত ও সংকুচিত হয়েছে। জনপদের সীমা সর্বদা এক থাকেনি। আসল কথা, প্রাচীন বাংলায় বঙ্গ ও বঙ্গাল বলতে যাকে বোঝা যেত তা বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশের সমার্থক নয়, তার একটি অংশমাত্র। প্রাচীন বাংলাদেশ যেসব জনপদে বিভক্তছিল বঙ্গ ও বঙ্গাল তার দুটি বিভাগ বৈ নয়। (বাঙ্গালীর ইতিহাস: নীহাররঞ্জন রায়, পৃ. ১০৮)
• মূলত প্রাচীন সভ্যতার অভ্যুদয় ঘটে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশে। আফ্রিকার মিশর এবং এশিয়ার মেসোপটেমিয়া, ভারত ও চীন সভ্যতার লীলাভূমি।
• ভারতীয় উপমহাদেশে সবচেয়ে পুরনো সভ্যতার সন্ধান পাওয়া যায় সিন্ধু নদের অববাহিকায়।
উয়ারি-বটেশ্বর: গৌরবের ধারক
বর্তমান বাংলাদেশ ভূখন্ডে বাঙালীর সভ্যতা কমপক্ষে চার হাজার বছরের পুরনো। উয়ারি-বটেশ্বর অঞ্চলে ২০০৬ সালে প্রাপ্ত পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুযায়ী বাংলাদেশ অঞ্চলে জনবসতি গড়ে উঠেছিলো প্রায় চার হাজার বছর আগে। দ্রাবিড় ও তিব্বতীয়-বর্মী জনগোষ্ঠী এখানে সে সময়বসতি স্থাপন করেছিল। পরবর্তীতে এই অঞ্চলটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয় এবং স্থানীয় ও বিদেশী শাসকদের দ্বারা শাসিত হতে থাকে। আর্য জাতির আগমনের পর খ্রিস্টীয় চতুর্থ হতে ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত গুপ্ত রাজবংশ বাংলা শাসন করেছিল।
ইতিমধ্যে মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধান ও প্রত্নতাত্ত্বিক খননে যেসব আলামত আবিষ্কৃত হয়েছে তাতে প্রমাণিত যে, উয়ারী-বটেশ্বরে প্রাচীনকালে সমৃদ্ধ নগর সভ্যতা ছিল।
প্রাচীনকালে উয়ারী-বটেশ্বরে নগরায়ন ঘটেছিল। বাণিজ্য-কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত নদী তীরবর্তী উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলটির পাশ দিয়ে প্রবহমান ব্রহ্মপুত্র নদ হয়ে বঙ্গোপসাগরের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে সুদূর রোমান সাম্রাজ্য পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্য চলতো। সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক খননে আবিষ্কৃত এখানকার প্রশস্ত রাস্তা, পার্শ্ব রাস্তা, স্থাপত্য উয়ারীর উন্নত নগর পরিকল্পনার পরিচায়ক। এখানে পাওয়া ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রা ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি কেন্দ্র হিসেবে উয়ারী-বটেশ্বরকে শনাক্ত করে। এ অঞ্চলে দুর্গ-প্রাচীর, পরিখা, পোড়ামাটির নিক্ষেপাস্ত্র পাওয়া গিয়েছে, যা প্রমাণ করে এখানে একটি শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল। (উয়ারী-বটেশ্বর, সীমান্ত দীপু)
যেমন করে বাংলা হল দেশের নাম:
আদিম জীবনকাঠামোর দীর্ঘ পথ হেঁটে হেঁটে এই বাংলার জন্ম। সাড়ে ছয় থেকে দশ হাজার বৎসর আগে ভারতীয় সভ্যতার কথা বলা হলেও বঙ্গভূমিতে বাঙালী সভ্যতার বয়স বলা হয় সাড়ে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার বছর।
প্রাচীনকালে বাংলার জনপদ বিভিন্ন নামে ও বিচ্ছিন্নভাবে ছিলো। এগুলো একত্র বাংলা নামকরণ মাত্র কয়েক'শ বছর আগের ঘটনা।
• বাংলা নামকরণ সম্পর্কে আবুল ফজল বলেন: “এ দেশের প্রাচীন নাম "বঙ্গ" এবং এদেশের লোকেরা জমিতে উঁচু উঁচু ‘আল’ বেঁধে বন্যার পানি থেকে জমি রক্ষা করতো। সময়ের ব্যবধানে ‘আল’ শব্দটি দেশের নামের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। এভাবে (বঙ্গ+আল) বাঙ্গাল শব্দের উৎপত্তি হয়।” (আইন-ই- আকবরী, আবুল ফজল)
• কিন্তু ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’ গ্রন্থে রমেশচন্দ্র মজুমদার এই মতামতকে ‘সত্য নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁর মতে “খ্রীষ্টীয় অষ্টম শতাব্দী এবং সম্ভবত আরও প্রাচীনকাল হইতেই বঙ্গ ও বঙ্গাল দুইটি পৃথক দেশ ছিল এবং অনেক প্রাচীন লিপি ও গ্রন্থে এই দুইটি দেশের একত্র উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়।” রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, বঙ্গাল দেশের নাম থেকেই কালক্রমে বাংলা নামকরণ করা হয়েছে। (বাংলা দেশের ইতিহাস, রমেশচন্দ্র মজুমদার)
• শ্রী সুখময় মুখোপাধ্যায় বলেন, “চৌদ্দ শতকের বাংলার স্বাধীন মুসলিম সুলতান হাজী শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ প্রথমবারের মতো গংগা ও ব্রহ্মপুত্রের নিম্ন অববাহিকার ব্যাপকতর এলাকাকে ‘বাংগালাহ’ নামে অভিহিত করেন। লাখনৌতি (উত্তর বঙ্গ) ও বাংগালাকে তিনিই স্বাধীন সুলতানী শাসনের অধীনে ঐক্যবদ্ধ করেন।” (বাংলার ইতিহাসের দু'শ বছর-স্বাধীন সুলতানদের আমল, সুখময় মুখোপাধ্যায়)
• ডক্টর নীহার রঞ্জন রায়-এর মন্তব্য হচ্ছে, “যে বংগ ছিল আর্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক থেকে ঘৃণিত ও অবজ্ঞাত, যা ছিল পাল ও সেনদের আমলে কম গৌরবের ও কম আদরের- সেই বংগ নামেই শেষ পর্যন্ত তথাকথিত পাঠান আমলে বাংলার সমস্ত জনপদ ঐক্যবদ্ধ হল।” (বাঙালীর ইতিহাস: আদিপর্ব, ডক্টর নীহার রঞ্জন রায়)
• অনেক ঐতিহাসিক ‘বঙ্গ’ শব্দের রুপান্তর ‘গঙ্গ’ থেকে আসার দাবি করেন। যেমন: “বঙ্গ শব্দটি গঙ্গ শব্দের রুপান্তর হতে পারে বলে কেউ কেউ অনুমান করেছেন এবং এটা আর্যভাষা ও উচ্চারণ রীতির প্রভাবেই সম্ভব হয়েছে বলে তাঁরা মনে করেন। অতীতের শৌর্যশালী গঙ্গরীড়ী বা গঙ্গারিডই জাতি এ গঙ্গের অধিবাসী এবং একসময় তাদের সাম্রাজ্য কামরূপ থেকে পাঞ্জাবের পূর্ব সিমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। কাজেই সহজেই অনুমান করা যায় যে, গঙ্গরীড়িদের গঙ্গরাজ্যই পরবর্তীকালে বঙ্গে রূপান্তর হয়।” (বাংগালীর ইতিকথা- অধ্যাপক আখতার ফারুক)
চলবে.....
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:২৭