কর্ণফুলী, আমার শৈশবের নদী। জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে সে আমার সাথে মিশে আছে। অতি নিবিড় ভাবে, সঙ্গোপনে। সাম্পানের বটবট শব্দ, প্রবল স্রোত, তীরভাঙ্গা ঢেউ, বন্দরের জাহাজের শিকল ঘেঁষে এগিয়ে চলা; এসব আমার কাছে নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘লুসাই পাহাড় উত্তুন নামিয়েরে যারগুর কর্ণফুলী’- লুসাই পাহাড় থেকে উৎপত্তি তার। তারপর অনেক পথ পেরিয়ে(প্রায় দুশ সত্তর কিলোমিটার) আঁকাবাঁকাভাবে মিশে গেছে বঙ্গোপসাগরের মোহনায়। কর্ণফুলী কখনোই পদ্মার মতন সর্বনাশা ছিল না। বরঞ্চ এর দুকূলের মানুষকে দুহাত ভরে দিয়েছে। তাদের জীবনযাত্রাকে বদলে দিয়েছে। তাদের ভাগ্যের চাবিকাঠি ঘুরিয়ে দিয়েছে।
কর্ণফুলীর নামকরণ নিয়ে নানান মুনির নানান মত। তবে সবচে’ প্রসিদ্ধ গল্পটা চমকপ্রদ। আরাকান রাজার মেয়ে প্রেমে পড়ে এক পাহাড়ি রাজপুত্রের। কোন এক রূপালী পূর্ণিমা রাতে তারা বের হয় নৌকা ভ্রমণে। ঢেউর সাথে জোছনার জলকেলি রাজকন্যাকে আপ্লূত করে দেয়। ঘোরের মাঝে অসাবধানতা বশত হঠাত রাজকন্যার কান থেকে কানফুল খুলে নদীতে পড়ে যায়, এই কানফুলটি তাদের ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে এতদিন যত্নআত্তিতে রেখেছিল রাজকন্যা। বলাই বাহুল্য কানফুলটি তাকে দিয়েছিল রাজপুত্র। পড়ার সাথে সাথে সে ধরতে চায়, কিন্তু পারে না। তারপর ঝাঁপ দেয় প্রবল স্রোতে। কানফুলটি তো নিতেই পারে না বরঞ্চ সে তলিয়ে যেতে থাকে প্রবল স্রোতের মাঝে। নিজের প্রিয়তমাকে তলিয়ে যেতে দেখে রাজপুত্রও ঝাঁপ দেয়- কিন্তু তার চেষ্টাকে বৃথা করে দিয়ে হারিয়ে যায় রাজকন্যা। প্রিয়তমাকে হারানোর বেদনা সহ্য করতে না পেরে রাজপুত্রও স্রোতের মাঝে নিজেকে সঁপে দেয়। এই ট্রাজেডি পর থেকেই নাকি এ নদীর নাম কর্ণফুলী।
কর্ণফুলীর দুতীরের প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলো এক কোথায় অসাধারণ। যে কারো চোখ জুড়াবেই। কর্ণফুলীর উপরে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের একমাত্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। যদিওবা এর কারণে রাঙ্গামাটির মানুষদের জীবন হয়ে গেছে নরকসম। অত্যন্ত উদ্দাম উচ্ছল পাহাড়ি জীবন থেকে তারা হয়ে গেছে পানিবন্দি। কাপ্তাই লেকের কথা আর নাই-বা বললাম! এটি শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের সবচে সুন্দর লেক গুলোর একটি। পাহাড়ের মাঝে জল। জলের মাঝে পাহাড়। এছাড়া কাপাই লেকের সৌন্দর্য বর্ণনা করার মতন ভাষা আমার জানা নেই। কর্ণফুলীর উপরে রয়েছে তিনটি সেতু; শাহ আমানত(র.),কালুরঘাট আর গোডাউন সেতু।
কর্ণফুলীর তীরে গড়ে উঠেছে বার আউলিয়ার পুণ্যভূমি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের এই সৌন্দর্যের অন্যতম প্রধান কারণ হল কর্ণফুলী। কর্ণফুলীর তীরেই চট্টগ্রাম বন্দর। কর্ণফুলীর তীরে রয়েছে বাংলাদেশের সবচে বড় ইউরিয়া সার কারখানা এবং কাফকো। রয়েছে ওয়েস্টার্ন মেরিন, শিকলবাহা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, বাংলাদেশের একমাত্র মেরিন একাডেমী সহ বহু কল-কারখানা। শাহ আমনত বিমান বন্দরও কর্ণফুলীর তীরে।
কর্ণফুলীকে নিয়ে অনেক গান রচিত হয়েছে। তার সিংহভাগ কৃতিত্ব শেফালী ঘোষের। যতদিন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা বেঁচে রবে ততদিন চট্টগ্রামের মানুষের মুখে মুখে বেঁচে থাকবেন শেফালী। তাঁর ‘ওরে সাম্পান ওয়ালা’ ‘কর্ণফুলীরে সাক্ষী রাহির তোয়ারে’ এর মতন গানগুলো সত্যি অমর হয়ে রবে।
পূর্ণিমা রাতে চাঁদের নির্মল জোছনায় কর্ণফুলীতে নৌকা ভ্রমণ মন্ত্রমুগ্ধকর, মোহনিয়া, পুলকদীপ্তময়! কারো যদি এমন অভিজ্ঞতা না থাকে তাহলে জীবনে সে সত্যি অনেক কিছু মিস করেছে। একদিকে জোছনার সাথে বাঁকা জলের খেলা, আর অন্যপাশে বন্দরের বাতিগুলোর আলো মিলিয়ে এক অনন্যসাধারণ দৃশ্যের অবতারণা করে। আর এমনিতে জোছনাবিহীন কর্ণফুলীও অনেক সুন্দর। তখন বন্দর আর জাহাজের আলোর প্রতিবিম্ব অসাধারণ লাগে।
এছাড়া কর্ণফুলীর মোহনায় আছে নেভাল একাডেমী। নেভালের দেয়াল মানে অন্যরকম জীবন, চট্টগ্রামের মানুষের সময় কাটানোর অন্যতম প্রধান স্থান বর্তমানে এটি। বিশেষ করে কপোত কপোতীদের একান্ত সময় কাটানোর জন্য নেভালের জুড়ি মেলা ভার। দেয়ালে বসলে একদিকে কর্ণফুলীর মোহনিয়া দৃশ্য অন্যদিকে মোহনা থেকে আসা হৃদয়কে উদ্বেল করে দেয়া বাতাস, সব্বাইকে বিমোহিত করবেই।
শুরুতেই বলেছিলাম কর্ণফুলী পদ্মা-মেঘনা কিংবা যমুনার মতন সর্বনাশা নয়। অত্যন্ত খরস্রোতা হলেও নদীভাঙ্গন একেবারে নেই বললে চলে! তার উপর কর্ণফুলী বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। একে ঘিরে গড়ে উঠেছে সামুদ্রিক মৎস্যশিল্প। যার উপর নির্ভর করে আছে প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষভাবে লাখো মানুষ। একমাত্র কর্ণফুলীর কারনেই বলদে গেছে এর উভয়কুলের মানুষের ভাগ্য। যদিওবা দক্ষিন কূল অত্যন্ত অবহেলিত। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বন্দরের অবদানের কথা আর নাই-বা বললাম। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র আসদগঞ্জও কর্ণফুলীর তীরে।
এই হল কর্ণফুলী। আমার শৈশবের নদী। আমার বেদনার আশ্রয়স্থল। হোক সে শীতের প্রবল কুয়াশায় জাহাজের শিকলের ভয় তাড়া করে কিংবা বরষায় প্রবল স্রোত আর বৃষ্টি, হোক গ্রীষ্মের সুতীব্র আগুন কিংবা শরত আর হেমন্তের কোমলতা- আমি কর্ণফুলীর থেকে কখনোই মুখ ফেরাই নি। কর্ণফুলীও আমার মনকে নিত্যদিন মুগ্ধ থেকে মুগ্ধতর করেছে, চরমভাবে পুলকিতও। তাই আমি কিছুদিন তার থেকে দূরে থাকলেই হৃদয়ে হাহাকার জেগে উঠে। মন প্রবলভাবে প্রিয়তমার মতন তার কাছে ফিরে যেতে ব্যাকুল হয়ে পড়ে। হুম, কর্ণফুলীর তীরে আমৃত্যু থাকাই আমার ইচ্ছা।
হ্যাঁ, তোমার জলে হাত ভেজাতে আমি আবার আসছি, আমি আবার আসছি...
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুন, ২০১৩ দুপুর ২:১১