somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নজরুলের একটি লেখা ও আমার উপলব্ধি

২৭ শে আগস্ট, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



"আমার কবিতা আমার শক্তি নয়; আল্লার দেওয়া শক্তি আমি উপলক্ষ মাত্র। বীণার বেণুকে সুর বাজে কিন্তু বাজান যে গুণী, সমস্ত প্রশংসা তারই। আমার কবিতা যারা পড়েছেন, তাঁরাই সাক্ষী। আমি মুসলিমকে সঙ্ঘবদ্ধ করার জন্য তাদের জড়ত্ব, আলস্য কর্মবিমুখতা, কৈব, অবিশ্বাস দূর করার জন্য আজীবন চেষ্টা করেছি। বাংলার মুসলমানকে শির উঁচু করে দাঁড়াবার জন্য যে শির এক আল্লাহ ছাড়া কোন সম্রাটের কাছেও নত হয়নি; আল্লাহ যতটুকু শক্তি দিয়েছেন তাই নিয়ে বলেছি, লিখেছি ও নিজের জীবন দিয়েও তার সাধনা করেছি। আমার কাব্যশক্তিকে তথাকথিত ‘খাট’ করেও গ্রামোফোন রেকর্ডে শত শত ইসলামী গান রেকর্ড করে নিরক্ষর তিন কোটি মুসলমানের ইমান অটুট রাখারই চেষ্টা করেছি। আমি এর প্রতিদানে সমাজের কাছে জাতির কাছে কিছু চাইনি।

আমি আজ জিজ্ঞাসা করি : আমি লীগের মেম্বার নই বলে কি কোন লীগ-কর্মী বা নেতার চেয়ে কম কাজ করেছি? আজও ‘নবযুগে’ এসেছি শুধু মুসলমানকে সঙ্ঘবদ্ধ করতে, তাদের প্রবল করে তুলতে, তাদের আবার ‘মার্টায়ার’-শহীদি সেনা করতে। বাংলার মুসলমান বাংলার অর্ধেক অঙ্গ। কিন্তু এই অঙ্গ আলস্যে জড়তায় পঙ্গু। এই অঙ্গকে প্রবল না করলে বাংলা কখনো পূর্ণাঙ্গ হবে না। বাংলার এই ছত্রভঙ্গ ছিন্নমূল মুসলমানদের আবার এক আকাশের ছত্রতলে, এক ঈদগাহের ময়দানে সমবেত করার জন্যই আমি চিরদিন আজান দিয়ে এসেছি। ‘নবযুগ’-এ এসেও সেই কথা বলছি ও লিখেছি। এই ‘নবযুগ’-এ আসার আগে বাংলার মুসলমান নেতায় নেতায় যে ন্যাতা টানাটানির ব্যাপার চলেছিল, সেই গ্লানিকর বিদ্বেষ ও কলহকে দূর করতেই আমি লেখনী ও তলোয়ার নিয়ে আমার অনুগত নির্ভীক, দুর্জয়, মৃত্যুঞ্জয়ী ‘নৌ-জোয়ানদের’ নিয়ে ভাই-এ ভাই-এ পূর্ণ প্রচেষ্টা চালাতে এসেছি। আমি কোনো ব্যক্তিকে সাহায্য করতে আসিনি। আল্লাহ জানেন, আর জানেন যাঁরা আমার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত তাঁরা আমি কোনো প্রলোভন নিয়ে এই কলহের কুরুক্ষেত্রে যোগদান করিনি ‘লীগ’ কেন, ‘কংগ্রেসেকে’ও আমি কোনো দিন স্বীকার করিনি। আমার ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা তার প্রমাণ। মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে কোন দিন লিখিনি কিন্তু তার নেতাদের বিরুদ্ধে লিখেছি। যে কোনো আন্দোলনেরই হোক নেতারা যদি পূর্ণ নির্লোভ, নিরহঙ্কার ও নির্ভর না হন, সে আন্দোলনকে একদিন না একদিন ব্যর্থ হতেই হবে।

মুসলমানের জন্য আমার দান কোন নেতার চেয়ে কম নয়; যে সব মুসলমান যুবক আজ নব জীবনের সাড়া পেয়ে দেশের জাতির কল্যাণে সাহায্য করছে তাদের প্রায় সকলেই অনুপ্রেরণা পেয়েছে এই ভিুকের ভিক্ষা-ঝুলি থেকে।
আল্লাহর সৃষ্টি এই পৃথিবী আজ অসুন্দরের নির্যাতনে, বিদ্বেষে পূর্ণ হয়ে উঠেছে। মানুষ মাত্রেই আল্লাহর সৈনিক। অসুন্দর পৃথিবীকে সুন্দর করতে সব নির্যাতন, সব অশান্তি থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করতে মানুষের জন্ম। আমি সেই কথাই আজীবন বলে যাব, লিখে যাব, গেয়ে যাব; এই জগতের মৃত্তিকা, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশকে আবার পূর্ণ শুদ্ধ পূর্ণ নির্মল করব এই আমার সাধনা। পূর্ণ চৈতন্যময় হবে আল্লাহর সৃষ্টি এই আমার সাধ।
পূর্ণ আনন্দময়, পূর্ণ শান্তিময় হবে এ পৃথিবী এ আমার বিশ্বাস। এ বিশ্বাস আল্লাহতে বিশ্বাসের মতোই অটল।"

"মুসলমান সমাজ আমাকে আঘাতের পর আঘাত দিয়েছে নির্মমভাবে। তবু আমি দুঃখ করিনি বা নিরাশ হইনি। তার কারণ, বাংলার অশিক্ষিত মুসলমানরা গোঁড়া এবং শিক্ষিত মুসলমানরা ঈর্ষাপরায়ণ। এ আমি একটুও বানিয়ে বলছিনে। মুসলমান সমাজ কেবলই ভুল করেছে আমার কবিতার সঙ্গে আমার ব্যক্তিত্বকে অর্থাৎ নজরুল ইসলামকে জড়িয়ে। আমি মুসলমান কিন্তু আমার কবিতা সকল দেশের, সকল কালের এবং সকল জাতির। কবিকে হিন্দুকবি, মুসলমানকবি ইত্যাদি বলে বিচার করতে গিয়েই এত ভুলের সৃষ্টি।"

"হিন্দু-মুসলমানে দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মানুষের জীবনে এক দিকে কঠোর দারিদ্র্য, ঋণ, অভাব অন্য দিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ- স্তূপের মতো জমা হয়ে আছে- এই অসাম্য, এই ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে, সঙ্গীতে, কর্মজীবনে, অভেদ-সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম- অসুন্দরকে ক্ষমা করতে, অসুরকে সংহার করতে এসেছিলাম- আপনারা সাক্ষী আর সাক্ষী আমার পরম সুন্দর। আমি যশ চাই না, খ্যাতি চাই না, প্রতিষ্ঠা চাই না, নেতৃত্ব চাই না- তবু আপনারা আদর করে যখন নেতৃত্বের আসনে বসান, তখন অশ্রু সংবরণ করতে পারি না।"
_______

আহা, প্রিয় কবি!
কি সব কথা বলে গেছেন। আজ ৮০-৯০ বছর পরও কথাগুলো কেমন লোমকূপের গোড়ায় শিহরণ জাগায়। মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা অবশ্যই আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিয়েছেন, ইনশাআল্লাহ।

আমি সবসময়ই বলি, মানুষকে কবিতার কাছে আসতেই হবে। মানুষ যত কবিতা থেকে দূরে সরে যাবে, ততই প্রাণহীন, জড়পদার্থের মতো হয়ে যাবে।
জন এফ কেনেডি বলেছিলেন না, 'অনেক বেশী রাজনীতিবিদ যদি কবিতা ভালবাসতেন, কিংবা অনেক বেশী কবি যদি রাজনীতি করতেন তাহলে পৃথিবীটা আরো বাসযোগ্য হতো, আরো সুন্দর হতো।'
এই কথাটা একবার কবিতা-বিদ্বেষী এক বন্ধুকে বলেছিলাম। শুনে বলেছিল, 'তাহলে পুরো দুনিয়াটা পাগলে ভরে যেতো আর কি! কবিরা তো সব পাগল।'

তাই কী? আমাদের জাতীয় কবি পাগল ছিলেন? পাগলেও তো বোধহয় এই কথা শুনলে পাগলামী ছেড়ে দেবে! যে মানুষ অকপটে ঘোষণা দেন,
"বিদ্রোহী মানে কাউকে না মানা নয়। যা বুঝি না, তা মাথা উঁচু করে বুঝি না বলা।"

তিনি সৃষ্টিসুখের উল্লাসে, নিয়ম ভঙ্গের উচ্ছ্বাসে মাততে পারেন। তিনি জাহান্নামের আগুনে বসে পুষ্পের হাসি হাসতে পারেন। তিনি সব ধরণের শৃংখল ভাঙতে, উচ্ছৃংখল হতে পারেন। কিন্তু পাগল হতে পারেন না কখনোই।

আমাদের দূর্ভাগ্য, আমরা তাঁর জীবদ্দশায়, তাঁর কবিত্বের সময়টুকুতে তাঁকে সাহচর্য দিতে পারিনি। উলটো ভুল বুঝেছি। ভুল বকেছি। তাঁকে যা নয়, তা বলে, সমালোচনার আগুনে দগ্ধ করেছি। অপমান করেছি। কেড়ে নিয়েছি তাঁর কবিত্বের সবটুকু শক্তি। ফলে কবিতা-ছাড়া তিনি হয়ে পড়েছিলেন প্রাণহীন জড় পদার্থের মতো।
ক্ষমা করবেন, প্রিয় কবি! আমাদের ক্ষমা করবেন।

যা কিছু রেখে গেছেন, তা মাথায় করে রেখে যদি কিছু প্রায়শ্চিত্ত করতে পারি!

লেখার উৎস : নজরুলকে দ্রুত দেখা
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:০২
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×