somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফিচার লেখার অনুসরণীয় কয়েকটি দিক

০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ফিচার পড়তে কে না পছন্দ করে! বিভিন্ন সংবাদপত্রে ও ম্যাগাজিনে প্রতিদিন নানা বিষয়ের উপর লিখিত ফিচার প্রকাশিত হচ্ছে। ফিচার পড়ার মধ্যে সুখপাঠ্যতা আছে। পাঠকদের মাঝে এর আকর্ষণ ও গুরুত্ব অনেক বেশি। এমন অনেক পাঠক আছেন, যারা খবর পড়ার চেয়ে ফিচার পড়তে বেশি পছন্দ করেন। তা বলে খবর আর ফিচার পরস্পরের প্রতিপক্ষ নয়। ফিচারও মূলত একধরনের তথ্যজ্ঞাপনকারী খবর। এটা সমসাময়িক ঘটনার উপর হতে পারে অথবা সমসাময়িক নয়, কিন্তু তার সংবাদমূল্য আছে। আমরা বিষয়টি এভাবে দেখতে পারি। খবর বা NEWS হলো N: North, E: East, W:West এবং S: South এ সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনার তথ্য। স্বরূপ বিশ্লেষণে খবর দু ধরনের হয়ে থাকে। যেমন: ১. Hard News অর্থাৎ একেবারে তথ্য জানানো। যা অনেকক্ষেত্রে আমাদের আবেগ অনুভূতিতে খুব একটা আন্দোলন জাগাতে নাও পারে। ২. Soft News অর্থাৎ লঘু সংবাদ। এটা পড়তে ভালো লাগে। আবেগ-অনুভূতিতে সাড়া জাগায়। এটি মূলত স্বস্তিদায়ক খবর। Hard News পড়ার ক্ষেত্রে সবসময় স্বস্তিদায়ক বিষয় থাকবে এমন কথা নেই। কিন্তু Soft News পড়ার ক্ষেত্রে সুখপাঠ্যতার স্পর্শ থাকে। ফিচার আসলে একধরনের Soft News আওতাভুক্ত।

ফিচারের কোনো সুনির্ধারিত সংজ্ঞা তেমন একটা নেই। কেউ কেউ সংজ্ঞা নিরুপন করেছেন; তবে তা পূর্ণাঙ্গ বৈশিষ্ট বিধৃত করার ক্ষেত্রে সীমিত। বলা হয়, ফিচার পাঠকের কাছে নিরস বিষয়কে সরস করে উপস্থাপন করে থাকে। যেন অনেকটা এ রকম যে, ফিচার হলো a lemon turned into lemonade। ফিচার হলো এমন একধরনের রমনীয় লেখা যা পাঠকের মনকে আকর্ষিত করে, পড়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করে শেষে মুগ্ধতার সাথে পরিতৃপ্ত করে।

খবর আর ফিচার দুটোই তথ্য প্রদানকারী লেখা। তবে এ দুইয়ের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হলো: খবর কোনো ঘটনা সংঘটিত না হলে লেখা হয় না, কিন্তু ফিচার সংঘটিত ঘটনা অথবা কোনো ঘটনা নয় তার উপরও লেখা যেতে পারে। যেমন: দেশের অর্থব্যবস্থায় মুদ্রাস্ফীতি ১৫% বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি খবর। আর এই খবরের ভিত্তিতে সাধারণ মানুষের জীবনপ্রবাহ কতটা দুর্দশায় নেমে গেছে তা ফিচারের বিষয়বস্তু হতে পারে। অথবা তেমন কোনো খবর নয় সে বিষয়কে নিয়েও ফিচার লেখা যেতে পারে। যেমন: পদ্মা নদী বা কান্তজিউ মন্দিরের উপর লেখা ফিচার। খবরের দুনিয়া সীমিত, ঘটনা না ঘটলে খবর লেখা যায় না। কিন্তু ফিচারের দুনিয়া সারাবিশ্বের সমস্তকিছু। বলা হয়ে থাকে: The whole world is the workshop of a feature writer। খবর মানুষকে ভাবায় আর ফিচার মানুষের মনে আড়োলন তোলে। খবর মস্তিষ্কে ঢেউ জাগায় আর ফিচার ঢেউ জাগায় হৃদয়ে। খবরে মানবিক আবেদন অপরিহার্য নয় কিন্তু ফিচারে তা থাকতে হবে। খবরে লেখক কোনো মন্তব্য করতে পারেন না, কিন্তু ফিচারে লেখক তার মতামত বা দিকনির্দেশনার ইঙ্গিত দিতে পারেন।

খবর লেখা শুরু করতে হয় ষড় ‘ক’ দিয়ে অর্থাৎ কে, কি, কখন, কোথায়, কেন, কিভাবে প্রশ্নের উত্তর সংক্রান্ত তথ্য জানিয়ে। ইংরেজিতে একে চমৎকারভাবে সাজিয়ে বোঝানো হয়। Five `W’ives and 1 `H’usband বাক্য দিয়ে; অর্থাৎ কি না who, what, when, where, why and how প্রশ্ন দিয়ে। আমরা যদি খবরের প্রথম অংশটি দেখি তাহলে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সংক্রান্ত তথ্য শুরুতেই পেয়ে যাব। এই অংশটিকে বলা হয় খবরের ইন্ট্রো বা সূচণা। পাঠক এটি পড়েই খবরের ভেতরের অংশে বিস্তারিত তথ্য পেয়ে যান। খবর লেখার ধারাক্রম পিরামিড আকৃতির মতো। শুরুতে ছোট হয়ে ধীরে ধীরে নিচে বড় অংশ। অন্যদিকে ফিচার অনুসরণ করে উল্টো পিরামিড আকৃতিতে। কোনো কোনো লেখক অবশ্য এ রীতি মানতে নারাজ। তবে যাই হোক, খবর খুব জমিয়ে লেখা বাতুলতা। কেননা এতে সতর্ক পাঠকের বিরক্তি আসতে বাধ্য। অন্যদিকে ফিচার জমিয়ে লেখা চলে যাতে পাঠকের সুখপাঠ্যতা আসে। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় রচিত ফিচারগুলোর বিচারে এটাই সত্য যে ফিচার পড়ার মধ্যে একটি মানবিক আবেদন ও উপলব্ধি খবরের তুলনায় বেশি।

উদ্দেশ্য বিচারেও খবর আর ফিচারের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। খবরের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র তথ্য জানানো। ফিচারের উদ্দেশ্য কয়েকটি: ক. তথ্য অবহিত করা খ. শিক্ষাদান বা দিকনির্দেশনা দেয়া ও গ. বিনোদন বা আনন্দ দেয়া। তবে লক্ষ্যণীয় যে, একটি ফিচারে সবগুলো উদ্দেশ্যের সমাহার দেখা যাবে তা নয়। আবার শুধুমাত্র আনন্দ দেবে তাও সত্য নয়। মানবিক উপলব্ধি জাগ্রত করাও এর অন্যতম উদ্দেশ্য। সময়ের বিচারে খবরের একটি নির্দিষ্ট ডেডলাইন থাকে। নির্দিষ্ট তারিখের পর কোনো খবরের উপযোগিতা থাকে না। সেকন্ডহ্যান্ড ইনফরমেশনের কোনো গুরুত্ব নেই। কিন্তু ফিচারের কোনো ডেডলাইন নেই। তবে সমসাময়িক হওয়া বাঞ্ছনীয়। এতকিছুর পরও আসল কথা, ফিচারের অন্যতম বৈশিষ্ট হলো যে, তাকে মানুষের মন ছুঁয়ে যেতে হবে।

ফিচার কয়েক রকমের হতে পারে। মূলত ১. ব্যক্তিত্ব চিত্রণ, ২. স্বীকারোক্তিমূলক ৩. ইতিহাস ভিত্তিক ৪. সংবাদ ভিত্তিক ৫. সাক্ষাতকার ৬. ভ্রমণ বৃত্তান্ত ৭. মানবিক আবেদন ও ৮. উন্নয়ন ফিচার।

খবর লেখার ক্ষেত্রে ষড় ‘ক’ কে সামনে রেখে সূচণা তৈরি করতে হয়। তারপর পিরামিড আকৃতিতে ধীরে ধীরে তথ্য বা বক্তব্য সাজাতে হয়। কিন্তু ফিচার লেখার জন্য যে সূচণা তা ষড় ‘ক’ কে সামনে রেখে লিখতে হবে এমন কথা নেই। একটি সূচণা ধরেই লেখক ফিচার লিখতে শুরু করতে পারেন। ফিচার লেখার ক্ষেত্রে যে সূচণা তা হতে হবে আকর্ষণীয়। সেজন্য লেখক তার নিজস্ব মেধা দিয়ে সূচণা নির্বাচন করবেন। সেটি সারমর্ম সূচণা হতে পারে। কিংবা উদ্ধৃতি সূচণা, প্রশ্ন সূচণা, চিত্র সূচণা, সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্য সূচণা, ব্যতিক্রমি সূচণা ইত্যাদি। যেভাবেই শুরু করা যাক না কেন, ফিচার লেখকের তিনটি মৌলিক শর্ত পুরন করতে আবেদন রাখে। আর তা হলো: ১. অধ্যয়ন ২. গবেষণা ও ৩. সাক্ষাতকার।

খবর লেখার জন্য তিনটি বিষয়ে দক্ষতা থাকা আবশ্যক। ১. খবর চেনার দক্ষতা ২. ভাষা সম্পর্কে দক্ষতা ও ৩. লেখার কৌশল আয়ত্ত করার দক্ষতা। এছাড়া সমাজ ও মানুষ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। খবরে সবকিছু লেখা হয় না। খবরের পেছনে আরও খবর থাকে তা প্রতিবেদক খুব আবশ্যক বলে মনে নাও করতে পারেন। তিনি পাঠকের আগ্রহের নিরিখে নির্বাচন করেন খবরের সংবাদমূল্য। সংবাদমূল্য নির্ধারণের কয়েকটি উপাদান রয়েছে: পরিবেশনযোগ্য তথ্য, নৈকট্য (শুধুমাত্র ভৌগলিক নৈকট্য বা দুরত্ব নয়, মানবিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি বিষয় সংশ্লিষ্ট হতে পারে), খ্যাতি, সন্ত্রাস বা ভয়াবহতা, অপরাধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মানবিক আবেদন ইত্যাদি। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, ফিচার অবশ্যই একধরনের সংবাদ। মানুষের জানার আগ্রহ আছে কিন্তু খবরের উপাদান বিচারে তার তেমন সংবাদমূল্য নাও থাকতে পারে।

ফিচার লেখার সাধারণ কয়েকটি অনুসরণীয় পদ্ধতি:
একটি অভিধান অনুসরণ করা, অভিধান দেখার অভ্যাস থাকা, শব্দার্থ ও বানানের বিষয়ে সজাগ থাকা, বাক্য বা বিষয়ের পুনরাবৃত্তি না করা, অনাবশ্যক ও বাহুল্য কথা বর্জন করা, সহজ শব্দ নির্বাচন ও সহজভাবে ভাবা, বাক্যগঠন বা নির্মাণে কূশলতা আনয়ন, দীর্ঘ বাক্য পরিহার, যতিচিহ্নের যথাযথ ব্যবহার, প্রধান ভাববাচ্য বাক্যটি চিহ্নিত করা, তথ্য ও যুক্তি প্রদান, বক্তব্য সম্প্রসারণ ও বিশ্লেষণ, দৃষ্টান্ত উপস্থাপন এবং পর্যায়ক্রম রক্ষা করা।

একটি ভালো ফিচারের বৈশিষ্ট:
একটি সুখপাঠ্য ও সফল ফিচারের গুন বা বৈশিষ্ট লক্ষ্য করলেই লেখক ভালো ফিচার লিখতে সফল হবেন। যেমন: সফল ফিচারের একটি মূল বক্তব্য রয়েছে; বেশি বা বহুমাত্রিক বক্তব্য ফিচারকে ভারী করে তোলে ও পাঠকের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সাত-আটটির বেশি প্যারাগ্রাফ না থাকাই বাঞ্ছনীয়। যাকে নিয়ে ফিচার লেখা হচ্ছে তিনি যদি কোনো ব্যক্তি হোন তবে তার সন্বোধন ‘আপনি’ বলে করা উচিৎ। সংখ্যা গননায় এক থেকে নয় পর্যন্ত কথায় ও পরের ধাপগুলো অংকে লেখা। ফিচারকে বাক্য দিয়ে ছবি আঁকা বা চিত্রকল্প তৈরি করা।

লেখক আশেপাশের যেকোনো বিষয় নিয়ে ফিচার লিখতে পারেন। নিজে থেকেই তার সংবাদমূল্য নির্ধারন এবং নিজের লেখার দক্ষতায় মানবিক আবেদন সুখপাঠ্যতার মাধ্যমে পরিবেশন করতে পারেন।

প্রকাশিত: ভোরের কাগজ ২০১২
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:১৩
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×