somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি পোস্টমডার্ন প্রাতর্ভ্রমণ কিংবা প্রাতবর্মণ

১৭ ই জুলাই, ২০২০ দুপুর ১২:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


পূর্বাধুনিক, আধুনিক ও উত্তরাধুনিক

ঘন্টার কাঁটাটি V-এর ঘরে এবং মিনিট ও সেকেন্ডের কাঁটাদ্বয় XII-এর ঘরে দণ্ডায়মান হলে, অন্যভাবে বলতে গেলে, সমাপতিত হলে, পাঁচটি তোপ দেগে তার নিয়মানুবর্তিতার প্রমাণ উপস্থাপন করল পিতামহ ঘড়িটি, আর সেসঙ্গে আমার নিষুপ্তিটি প্রথমে তন্দ্রায় পরিণত হলো, তারপর পুরোপুরি টুটে গেল। মুখমণ্ডলে অবস্থিত চক্ষুদ্বয় আমার উন্মীলিত হলো এবং নিম্নদেশে অবস্থিত পদযুগল গাত্রোত্থানে সহায়তা করে পুরো দেহটি ভূমির উপর দণ্ডায়মান করল। পাঁচটা বেজে ষষ্ঠ মিনিট সপ্তম সেকেন্ডে গৃহত্যাগ করলাম আমি।

ঘড়িটি ক্রয় করা হয়েছিল ১৯২০ সালের জানুয়ারি মাসের দশ তারিখে, শনিবার দিবসে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা শেষে লীগ অব নেশনস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যেদিন। ঠিক সেদিনই ঘড়ি ক্রয় করার ঘটনাটি নিছক কাকতালীয় নয়, সেদিন আমার পিতামহেরও জন্ম হয়েছিল। তারপর থেকে সপ্তাহান্তে শুধু একবার দমের উপর ভর করে অদ্যাবধি প্রায় নিষ্ঠার সঙ্গে তার কাজ করে যাচ্ছে ঘড়িটি। প্রায় বলার কারণ হচ্ছে ঘড়িটি নাকি একদা, আমার স্বজনেরা বলেন, থমকে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল বেশ অনেকক্ষণ, কারও কারও মতে, সে হয়েছিল বিষাদগ্রস্ত, এই শতাব্দীর একেবারে সূচনালগ্নে যখন আশি বছর বয়সে আমার পিতামহ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। স্বজনেরা অবশ্য এরূপ অনেক লোমহর্ষক কথাই বলে থাকেন, ঘড়িটি নাকি দাদুর জীবনের কুড়িটি বিশেষ ঘটনায় কুড়িটি ঘন্টাধ্বনি জ্ঞাপন করেছিল, যাদের কতক ছিল সুখের, তখন বেজেছিল সুরেলা ধ্বনি, আর কতক বেজেছিল অপার্থিব বিষাদ ধ্বনি কারণ দাদুর জীবনে তখন নেমে এসেছিল দুর্যোগ। এসব সংঘটনে আমি বিশ্বাস করি না, আবার তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেই না, কারণ আমি একজন পোস্টমডার্ন গবেষক, কেউকেটা কেউ, গবেষণা করে যাচ্ছি এ রহস্যের মূলোৎপাটনে।

পাঁচ ঘটিকা নবম মিনিট অষ্টম সেকেন্ড। বাইরে মৃদুমন্দ সমীরণ, বসন্তের উদীচী হাওয়ার আগমনী আমেজ। মৃদুমন্দ শব্দটির মুখোমুখি হওয়ার অনেক পূর্বে, সেই শৈশবেই সমীরণটি আমি অনুভব করেছিলাম তীব্রভাবে, গ্রামের বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তরে ছুটে ছুটে। সুতরাং শব্দটির সঙ্গে প্রথম পরিচয়ে স্বভাবতই বিস্মিত হয়েছিলাম আমি, এত সুন্দর বায়ু কেন মন্দ হবে খানিক। আমার বন্ধুরা বলত, এ হচ্ছে আদর সম্বোধন হে, মায়েরা যেমন সোহাগে বলেন, দুষ্টুমিষ্টি বাচ্চাটি আমার। তবে রবীন্দ্রনাথও যখন বলেন,
"অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া--
দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া॥",
তখন একজন পোস্টমডার্ন গবেষক হিসেবে আরোপিত ব্যাখ্যাটিতে খটকা ধরে আমার। চলন্তিকা অভিধান বিশদ পর্যবেক্ষণ শেষে আমি আবিষ্কার করি, মন্দ শব্দেরও রয়ে গেছে আরেকটি মানে যা তীব্র নয়, ধীর; আর তখনই বিদ্যুৎচমকের মতো স্পষ্ট হয়েছিল বিজ্ঞানের মন্দন শব্দটিরও মানে। বিশেষ গবেষণাটি আমার ভাষাজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতা বিবর্ধিত করে।

কাঁটায় কাঁটায় পাঁচটা পনেরোতে সরসর সরাৎ করে সরালি এক সরে যায়, ১। প্রথমে বাঁশঝাড়ে ২। তারপর তৃণভূমিতে ৩। তৎপর ধানক্ষেতে এবং ৪। অতঃপর জলাভূমে। আমি মুহূর্তগুলো বন্দী করে রাখছি আমার কবজি ঘড়িতে। পাতি সরালির বৈজ্ঞানিক নাম Dendrocygna javanica। ছোট সরালি, সরালি বা গেছো হাঁস অ্যানাটিডি (Anatidae) গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত Dendrocygna গণের অন্তর্ভুক্ত সুলভ এক প্রজাতির হাঁস। পাখিটি বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। পাতি সরালির বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ জাভার বৃক্ষবাসী হাঁস: গ্রিক dendron মানে বৃক্ষ, cygnus হচ্ছে হাঁস, আর লাতিন javanica মানে জাভা দ্বীপের অধিবাসী। এই বিষয়গুলো বাংলা উইকিপিডিয়াও জানে।

আমি এবার পায়চারি করতে থাকি ছোট স্রোতস্বিনীটির তটরেখা বরাবর। স্রোতস্বিনীটিকে ভাষাবিদগণ বলেন, ক) তটিনী খ) তরঙ্গিনী গ) প্রবাহিনী ঘ) স্রোতস্বতী ঙ) গাঙ চ) স্বরিৎ ছ) নির্ঝরিনী জ) কল্লোলিনী ঝ) গিরি নিঃস্রাব ঞ) মন্দাকিনী ট) কূলবতী ঠ) স্রোতোবহা ড) সমুদ্রকান্তা ইত্যাদি; আমি বলি, উচ্ছলা।

ধীরে ধীরে আসে সে ব্রাহ্মমুহূর্ত, আস্তে আস্তে আলোড়িত হতে থাকে দেহ আমার, বাড়তে থাকে হৃদস্পন্দন, বাহ্যচেতনা হারাই একসময় মনে পড়ে আমার সুপ্রাচীন সে কালের কথা, পেয়েছিলাম একদা বর, অমরত্ব ছাড়া পাব সব যদি হয় অভিলাষ, আর আমি শুধু চেয়েছিলাম হোক মোর জীবন কি মরণ, থাকে যেন সকল পূর্বকথা স্মরণ। আহা, ভিড় করে পুরাতন কত না স্মৃতি! ট্রয়ের যুদ্ধে ছিলাম আমি বীর ইউফোরবস, ভয়ানক কত যুদ্ধ করি প্রায়ামপুত্র হেক্টরের পাশে, লুটিয়ে পড়ে দেহ শেষে হেলেনপতি মেনেলাউসের বর্শাঘাতে, ঝটিকার তোড়ে উৎপাটিত জলপাই প্রসূন। তারপর আত্মা আমার প্রবেশ করে এরমোটিমসের দেহে আর আমি গমন করি ব্র্যাংকিডিসের রাজ্যে, জনসমক্ষে তুলে ধরি আমার সে ঢাল, ট্রয় থেকে নিয়ে এসে মেনেলাউস যা করেছিল অর্ঘ্য, তথায় ছিল শুধু গজদন্ত অবশেষ। এরমোটিমসের মৃত্যুর পর আমি হয়ে গেলাম পিররস, ডিলোস দ্বীপের এক জেলে সাধারণ, অথচ স্মৃতি অমলিন—পূর্বে আমি ছিলাম এথালিদিস, তারপর ইউফোরবস, তৎপর এরমোটিমস, অতঃপর পিররস। আমি অনুভব করি আলো-আঁধারি, ভাসতে থাকে সত্তা আমার অনন্ত কালের গর্ভে, উড়ে উড়ে নৃত্য করে আত্মা আমার ফিনিক্স পাখির মতো।

"তুমি এখানে, পুনরুজ্জীবিত, অনুভব করেছ মহান রহস্য। মৃত্যুকে পরাভূত করেছ তুমি, অর্জন করেছ মৃত্যুঞ্জয়তা,’ মন্দ্রসপ্তকে ভেসে আসে তাদের স্বর, কাদের স্বর! "এসো, উদযাপন করো অভিমন্ত্রিতদের গৌরব। তুমি হয়েছ আমাদের একজন, লভেছ নবজন্ম।’

অনাথ-অনন্ত প্রাতবর্মণে আবারও অবিরাম হাঁটে পোস্টমডার্ন গবেষক।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০২০ দুপুর ১২:৩২
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×