আমার পিতা খাজা তৈয়বুল ইসলাম । ইসলামপুর গাছতলা দরবার শরিফে তার জন্ম ।
এক জন সুদর্শন সু পুরুষ ছিলেন ! ছিলেন বলার উদ্দেশ্য তিনি গত তিন বছর হয় ইন্তেকাল করছেন আষাড়ের এক দুপুরে যোহরের নামাজের আগে তাঁর খান্কায় সুন্নত নামাজ পড়তে পড়তে সেজদায় ...সাজদায় ...তাঁকে তার প্রিয় প্রভু তার শাহী দরবারে নিয়ে যান - ইননা-লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন ।
ফর্সা লম্বাটে হালকা পাতলা সুন্দর গায়ের গড়ন । সাদা পান্জাবি পাজামা অথবা সাদা জুব্বা সাদা লুংগি তিনি সব সময় পরতেন ,সাদা রংটাই তাঁর খুব বা একমাত্র পছন্দ ছিল একটা সাদা রুমাল সব সময় তাঁর কাঁধে থাকতো কিস্তি সাদা টুপি পরতেন । সুন্দর দাড়ী ( রেশমি ) ছিল । সব সময় মেশ্স্ক আমবার (অরিজিনাল) আতর ব্যবহার করতেন । অত্যান্ত পরিপাটি পরিস্কার চলাফেরা করতেন । মানুষের সাথে তার ব্যাবহার ছিল আসাধারন এত মিষ্টি ও মুল্যবান কথা বলতেন যেন মুখ দিয়ে মুক্তোর দানা পরতো তার প্রতিটি কথা মানুষ মণিমুক্তার মত সংগ্রহ করতো তিনি সবাই কে খুব ভালবেসে খুব আপন মানুষের মত আদর করতেন । আর মানুষ ও তাঁকে এতো স্রদ্ধা করত না দেখলে বোঝার উপায় নাই
আমি আমার আব্বাজানের সব সময় সাথে সাথে থাকতাম। তিনি আমাকেও সাদা পানজাবি পায়জামা টুপি ও একটা রুমাল দিয়ে মাসজিদে নিয়ে আসতেন । আমার তখন বয়স পাঁচ কি ছয় হবে । আমি আমার আব্বার সাথেই থাকতাম আমার আব্বাও আমাকে খুব ভালোবাসতো । আব্না যখন বাসা থেকে বের হতেন তার আগেই আমি তার একটা ফেন্ছি লেদার বেগ ধরে বসে থাকতাম ,আমি জানি আব্বা সেই বেগ ছাড়া বের হবেন না । আব্বা ও আমাকে উনার সাথে প্রায় সব জায়গায় নিয়ে যেতেন । মেয়েরা যেমন ঘোমটা দিয়ে চলাফেরা করত আমার আব্বাও ঐ সাদা রুমাল দিয়ে প্রায় গোমটা দিয়ে চলতেন কেন এত লজ্জাবোধ আমি বুঝতাম না । আমিও তাঁর সাথে সাথে সাদা রুমাল টা দিয়ে টুপির উপরে মাঝামাঝি করে পড়তাম কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনুভুতি বোঝাতে পারবো না ।
জুম্মা দিনটি ছিল তাঁর জন্য অতান্ত গুরুত্ত পুর্ন । সকাল থেকেই তিনি ব্যাস্ত থাকতেন নিজেকে নিয়ে , নিজের সুন্দয্য নিয়ে সচেতন প্রস্তুতি নিতেন নখ্ সুন্দর করে নিজেই কাটতেন । আববাজানের একটা ছোট আয়না ছিল ঐ আয়নায় দেখে দেখে ছোট কেচিঁ দিয়ে গোফ ছাটতেন সুন্দর করে তারপর গোশল করে ধবধবে সাদা ঝুব্বা মাথায় সাদা বড় পাগড়ি পড়ে সুন্দর করে শুরমা চোখে দিতেন এর পর আতর দিয়ে একটা বড় সাদা রুমাল দিয়ে নিজের এতো সুন্দর চেহারা মোবারক প্রায় ঢেকে ফেলতেন রুমালের হাল্কা ফাঁক দিয়ে তাঁর শরু নাক ও দাড়ি মোবারাক দেখা যেত কি যে অদ্ভুত লাগতো আব্বাজানকে মাশা আল্লাহ । এর পর পড়তে বসতেন , কত যে কিতাব তার সংগ্রহে ছিল বড় বড় মোটা মোটা এক একটা কিতাব যেন একটা রেজিস্টার বই উর্দু ,ফর্সি , আরবি মহামুল্যবান এই কিতাব গুলো তিনি আনেক যত্ন করতেন প্রতিদিন আদর করতেন , মাঝে মাঝে জড়িয়েও ধরে থাকতেন কিতাবগুলোকে আশ্চয্য ! আমাকে বলতেন বাবা এই বইখানা বুকের ভিতর জড়িয়ে রাখলে তোমার কখন বুকে অসুখ হবে না এটা শেফার মত তোমার বুক কে সুস্থ রাখবে । খুবই আশ্চর্য !!
তিনি যখন মসজিদে প্রবেস করতেন সমস্ত মুছল্লিগন লাইন ধরে আদবের সাথে তার সন্মানে দাড়িয়ে থাকতো । তিঁনি মিষ্টি করে সবারইকে হাতবুলিয়ে দিতেন খোজ খবর নিতেন । শুক্রবার তিনি থাকনে একটু ভিন্ন মেজাজে মসজিদের মিম্বারে সাদা পোষাকের অপর্ব সুন্দর মানুষ টি তার সাদা পাগড়ী ও একটি সুন্দর লাঠি নিয়ে দাড়িয়ে দাড়িয়ে খুত্বা (বক্তব্য) পড়তেন মুসলমান দের গুরুত্তপুর্ন বিষয়ের উপর ইসলামের ইতিহাস ও সমসাময়িক অন্যান্য গুরুত্ত্বপুর্ন বিষয়ের উপর বিশেষ করে নামাজের জন্য সবাইকে আহবান করতেন তিনি তাঁর আলোচনায় ।
ভালো লাগতো দেখতে যেন এই মানুষটাকে দেখতেই আমার জন্ম হয়েছে । তাঁর শুদ্ধ্ উচ্চারন কথা বলার ধরন মানুষকে আকর্শন করত সবাই তাঁর দিকেই মন দিয়ে কথা শুনতো । চিন্তাই করা যায় না তাঁর আকর্শন ক্ষমতা ।
খুত্বার দ্বিতিয় অংশে তিনি জোরে জোরে উচ্চারণ করতেন যেন ধমক দিচ্ছেন কিন্তু অত্যান্ত বলিষ্ট ভাবে এতো ভালো লাগতো .. তিনি যখন নামাজে ইমামতি করতেন তাঁর কোরআনুল করিমের তিলাওয়াত এতো দরাজ ছিল যে কাউকেই আবেগ প্রবন করে ফেলতো । তিনি যখন কোরআন তিলাওয়াত করতেন তিনি যে তার সৃষ্টিকর্তার সামনে কথপকথন করছেন তা বোঝা যেত এতো আবেগ আল্লাহ !আল্লাহ ! তিনি অঝোর নয়নে কাদঁতেন তাঁর চোখের পানিতে দাড়ি মুখ নাঁক ভিজে যেত তার প্রভুর সামনে তাঁর আর্তনাদের মিষ্টি বিলাপ আমাকে কেন সবাইকে করতো পুলকিত আলোকিত । কোন মুছল্লি চোখের পানি ধরে রাখতে পারতো না । অপুর্ব সে অভিগ্গতা !
নামাজ শেষে মুছল্লিগন লাইন ধরে দাড়িয়ে থাকতো আব্বাজানের হাত মোবারক ছুঁয়ে দেখার জন্য , কি কাকুতি মিনতি মানুষের তার কাছে ! মুছল্লিগন তাঁকে এতো ভালবাসতো তাঁকে সব বিষয়ে অবগত করতো । কারো মেয়ে বিয়ে হচ্ছে না কারো চাকরি নেই কারো জ্বর কারো মা অসুস্থ কারো মামলা জটিল জটিল সমস্যা । আমি আব্বাজানের পাশে মুগ্ধ হয়ে এ সব দেখতাম আর আমার গর্ভে বুক টা ভোরে যেত । এটা কোন সাধারন ঘটনা না খুবই Special কিছু !!! পৃথিবীতে খুব অল্পো কিছু মানুষকে এই সুযোগ দাওয়া হয়েছে এবং I'm the special one ( তাই মনে হতো ) । আমার গর্ভের কোন সীমা থাকতো না ।
আমার আব্বাজান ছিলেন প্রকৃত প্রেমিক। মানুষ ছিল তার সব চেয়ে প্রিয় , তাঁর খুব প্রিয় মানুষের জন্য তার খুব ভালোবাসা । পরিচিত অপরিচিত সবার প্রতি তাঁর দরদ ছিল অপরিসীম সবাই কে তিনি আদর করতেন ভালবাসতেন শুধু তাই না সবাইকে ভালবেসে খাওয়াতে পছন্দ করতেন নিজ হাতে বেড়ে বেড়ে খাওয়াতেন ছোটদের জন্য তিনি ছিলেন বন্ধু । সবার মনের কথা তিনি জানতেন ভালবাসতেন বলেই সবার খবর তিনি জানতেন সবার খোজখবর নিতেন নিয়মিত একজন ও বাদ পড়তোনা তার হিসেবের । ধনী গরিব কোন বৈস্বম্য করতেন না বরং গরিবের প্রতি তার ভালবাসা ছিল বেশি । তিনি সকালে বাজারে করতে গিয়ে বাজারের সব মাছ কিনে নিয়ে তা গরিব যারা বাজার করতে পরতো না তাদের মাজে বিলি করে দিতেন তাও চুপচাপ যাতে কেউ লজ্জা না পান সে বিষয়ে তিনি খুব যত্নবান ছিলেন । মৌশুমি ফল ( কাঠাল আম তরমুজ বাংগি ) মণ কে মণ ( চল্লিশ শেরে এ এক মণ ) কিনে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পৌছিয়ে দিয়ে আসতেন । বৃদ্ধো মানুষদের বাড়ি গিয়ে গিয়ে খোজ খবর নিয়ে আসতেন কার কি দুঃক্ষ কষ্ট প্রান দিয়ে সমাধান করতে চেষ্টা করতেন । বিশেষ করে তার পরিবারের কাছের দুরের সকল আত্বীয়দের নিয়মিত খোজ খবর নিতেন প্রায় ই সকলের বাড়ি গিয়ে দেখা করে আসতেন । এত দরদি এত মায়া তার মানুষের জন্য ছিল যা একেবারেই বিরল । মানুষের জন্যে কিছু করতে পারলে তিনি ভিষন খুশি থাকতেন ।
ছোট সময় আমি আমার আব্বাজানের কাছেই বেশি থাকতাম । আব্বা কোথাও সফরে গেলে আমাকেও সাথে নিয়ে যেতেন । যেমন সিলেট হযরত শাহ জালাল (র.) মাজারশরিফ শাহ পরান (র.) তিনশত ষাট আউলিয়ার মাজার । মোহসিন আউলিয়া শাহ গরিব উল্লাহ শাহ (র.) শাহ আমানাত (র.) সহ বিভিন্ন্য আউলিয়াদের দরবারে । বিভিন্ন্য ইসলামিক অনুষ্ঠানে আমাকে ঘুরে ঘুরে দেখাতেন ।
আব্বাজান কে সব সময় ব্যাস্ত দেখতাম কোরআন তিলাওয়াতে নামাজ পড়ায় অথবা কিতাব পড়া নিয়ে । ঘুমের থেকে উঠে দেখতাম তিনি নামাজ পড়ছেন ঘুমুতে যাওয়ার সময়ও দেখতাম তিনি নামাজ পড়ছেন এতো নামাজ আমি এই পৃথিবিতে কাউকেই পড়তে দেখি নাই । নামাজের মোসল্লায় এক পা উঠিয়ে কোরআন তিলাওয়াত করতেন মগ্ন হয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা । সেজদায় ঘন্টার পর ঘন্টা পরে পরে চোখের জলে মুসল্লা ভাসিয়ে ফেলতেন । কি চাইতেন তিনি প্রিয় প্রভুর কাছে ? কোন লোভ ছিলনা মানুষটার এতো ভালমানুষ ছিলেন তিনি । এক আল্লাহকে সন্তোষ্ট করা ছিল তার চিরদিনের প্রচেষ্টা ।
ছোট সময়ে এক দিন আমার বয়স ছয় সাত হবে আমাকে সবার সামনে কোলে তুলে নিলেন খুব জড়িয়ে ধরে কাদঁতে লাগলেন তার ভক্তবৃন্দগন জানতে চাইলো হুজুর কি হয়েছে ! কোন পেরেশানি !কাদঁছেন কেন ? আব্বা বল্লেন আমার ছেলেটা বড় হয়ে যাচ্ছে ওকে তো আর বেশি দিন কোলে নিতে পারবো না তাই খুব খারাপ লাগছে ...
আমাকে আব্বু খুব ভালো বাসতেন আমাকে কোলে বসিয়ে কোরআন তোলাওয়াত শিখায়েছেন একলাইন একলাইন করে একপেরা একপেরা করে তাঁর বুকের ভিতরের উষ্নতা দিয়ে আগলে রাখতেন আমাকে সবসময় ........