somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গোলাম আযম ও ভাষা সৈনিক প্রসঙ্গ

০১ লা মার্চ, ২০১২ বিকাল ৫:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
(গোলাম আযম নাকি স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার। নরঘাতক গোলাম আযমের মুক্তির জন্য ভন্ড,ধর্ম ব্যবসায়ী জামায়াতে ইসলামী এই পোস্টারটি লাগিয়ে বেড়াচ্ছে। জামায়াতের হেডকোয়ার্টার বলে খ্যাত মগবাজারের শুকরের খামারেও দেখি আজকাল এলকোহলের দারুণ চাহিদা। )

জামায়াতে ইসলামী ঠিক কোন ঘরানার ইসলামী দল সেটা নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমি তীব্র সন্দেহ পোষণ করি। কারণটা এদের তীব্র মিথ্যাচার। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তথ্য ঘাঁটাঘাটি করতে গিয়ে এই মিথ্যাচারের কদর্য রূপটা সম্পর্কে জানতে পেরেছি। একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগীর ভূমিকায় এবং ক্ষেত্রবিশেষে তাদের চেয়েও নৃশংসতা দেখানো দলটি স্বাধীনতার পর নিষিদ্ধ ছিলো। কিন্তু রাজনৈতিক অধিকার ফিরে পাওয়ার পর থেকেই তারা মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের ভূমিকা আড়াল করতেই নানা রকম মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছে। তার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এবং ব্যক্তিত্বদের নিয়ে মিথ্যাচার ও চরিত্রহানি যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে মিথ্যে গল্প ফেঁদে ইতিহাস বিকৃতি। এর সবটাই তারা করেছে গোটা আবহটাকে বিতর্কিত করে নিজেদের কর্মকাণ্ডকে জাস্টিফাই করতে। এবং এর মধ্যে নাটের গুরু ও ঘাতক দালাল শিরোমনি গোলাম আযমের মিথ্যাচার আলাদা আলোচনার দাবি রাখে।

যেই মুহূর্ত থেকে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি নতুন করে ব্যাপ্তি পেলো, গোলাম আযমকে একজন ভাষাসৈনিক হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য উঠে পড়ে লাগলো তার অনুসারীরা। বাজারে ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে একটা সিডি তারা ছেড়েছে। এবং তাতে বদরুদ্দিন উমরসহ বেশ কজন বিশিষ্ট মানুষের নাম রয়েছে যারা গোলামকে ভাষা আন্দো্লনের মহান সৈনিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে উমর তার এক কলামে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ‘ক্যাসেটটিতে ভাষা আন্দোলনের ওপর কিছু কথাবার্তা থাকলেও বিশেষভাবে লক্ষণীয় হল জামায়াতে ইসলামীর নেতা গোলাম আযমের দু’দফা সাক্ষাৎকার, যাতে তিনি নিজেকে ভাষা আন্দোলনের একজন সক্রিয় নেতা হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করেছেন। এই প্রচেষ্টা যে কত অসৎ ও হীন এর একটা প্রমাণ হচ্ছে, এ ক্যাসেট তৈরির সময় তথ্য সহায়তা যারা করেছেন তাদের মধ্যে আমার নাম উল্লেখ। এ কাজ করার উদ্দেশ্য যে এই প্রতারণাপূর্ণ ব্যাপারটির প্রামাণ্যতা নিশ্চিত করা এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার তথ্য সরবরাহ করার বিষয়টি সর্বৈব মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। এক বন্ধু ক্যাসেটটি দেখার জন্য আমাকে দেয়ার আগে এ বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না। ভাষা আন্দোলনে গোলাম আযমের ভূমিকা সম্পর্কে প্রচার কাজে আমি তথ্য দিয়ে জামায়াতে ইসলামীকে সহায়তা করেছি এটা প্রচার করা থেকে বড় ধৃষ্টতা আর কি হতে পারে? কতখানি নৈতিক অধ:পতন ঘটলে এ কাজ কোন ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব, সেটা বলাই বাহুল্য।

আমি আমার ভাষা আন্দোলনের বইটির প্রথম খণ্ডে একবারই মাত্র গোলাম আযমের উল্লেখ করেছি। ১৯৪৮ সালের নভেম্বর মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। ২৭ নভেম্বর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের এক সমাবেশে ভাষণ দেন। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে তাকে একটি মানপত্র দিয়ে তাতে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো হয়। এ মানপত্রটি পাঠ করেন ইউনিয়নের তৎকালীন সেক্রেটারি গোলাম আযম। আসলে এটি পাঠ করার কথা ছিল ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট অরবিন্দ বোসের। কিন্তু লিয়াকত আলীকে ভাষা আন্দোলনের দাবি সংবলিত মানপত্র পাঠ একজন হিন্দু ছাত্রকে দিয়ে করালে তার মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে এবং মুসলিম লীগ সরকার এ নিয়ে নানা প্রকার বিরূপ প্রচার শুরু করবে¬ এ আশংকা থেকেই একজন মুসলমান ছাত্র হিসেবে সেক্রেটারি গোলাম আযমকে সেটা পাঠ করতে দেয়া হয়েছিল। এই হল ভাষা আন্দোলনে গোলাম আযমের ‘বিরাট’ ভূমিকা।‘

এ বিষয়ে গোলাম তার আত্মজীবনীতে যা লিখেছেন তাতেও বদরুদ্দিন উমরের কথার সত্যতা মেলে। গোলাম স্বীকার করেছেন, এই ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা নিতান্তই আকস্মিক। তার ভাষায়, ’৪৯-৪৯ সালে ইউনিভার্সিটি ইউনিয়নের নির্বাচন না হওয়ায় এ সেশনেও জিএস-এর দায়িত্ব আমার উপরই রইল। কিন্তু হলে না থাকায় আমার জন্য এ দায়িত্ব পালন কঠিন হয়ে পড়লো। তাই ভারপ্রাপ্ত জিএস হিসেবে নির্বাচিত সদস্যদের একজনের উপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ’৪৮ এর ২৭ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর নিকট পেশ করার জন্য একটি মেমোরেন্ডাম (স্মারকলিপি) রচনার দায়িত্ব দেওয়া হয় সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ভিপি আবদুর রহমান চৌধুরীর উপর (যিনি বিচারপতি হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেন)। একটি কমিটি স্মারকলিপিটি চূড়ান্ত করে।

ইউনিভার্সিটি ছাত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভাইস চ্যান্সেলর ড. সৈয়দ মুয়াযযাম হোসেন তখন বিদেশে থাকায় ভারপ্রাপ্ত ভাইস চ্যান্সেলর জনাব সুলতানুদ্দীন আহমদকে সভাপতিত্ব করতে হয়। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের পর তিনি গভর্নর হয়েছিলেন। ছাত্র মহাসমাবেশে প্রধানমন্ত্রীর সামনে মেমোরান্ডামটি কে পাঠ করে শুনাবে এ নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হলো। ছাত্র ইউনিয়নের ভিপির উপরই এ দায়িত্ব দেওয়া স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু স্মারকলিপিতে পূর্ব পাকিস্তানের অনেক দাবি-দাওয়ার তালিকায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিটি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ থাকায় সবাই একমত হলো যে, ঐ পরিস্থিতিতে একজন হিন্দুর হাতে প্রধানমন্ত্রীকে তা পেশ করা মোটেই সমীচীন নয়। কারণ মুসলিম লীগ সরকার রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পেছনে হিন্দুদের হাত আবিষ্কার করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালিয়েছে। শেষ পর্যন্ত এ সমস্যার সমাধান হিসেবে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে ছাত্রইউনিয়নের জিএস গোলাম আযমকেই এ দায়িত্ব পালন করতে হবে।’ (জীবনে যা দেখেছি, ১ম খন্ড পৃ:৯৬)।

মজার ব্যাপার হচ্ছে একই বইয়ের ১৪১ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছে, ‘৪৮এর ২৭ নভেম্বর প্রথম কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খানকে ঢাকার ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় জিমনেশিয়াম গ্রাউন্ডে এক ঐতিহাসিক স্মারকলিপি দেওয়া হয়। এতে রাষ্ট্রভাষার দাবির সাথে সাথে পূর্ব পাকিস্তানের সামগ্রিক দাবি বলিষ্ঠ ভাষায় জোরালোভাবে শামিল করা হয়। প্রধানমন্ত্রী যদি একমাত্র উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বলে ঘোষণা দিতেন তাহলে মঞ্চেই এর প্রতিবাদ করার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু ঝানু রাজনীতিক ভাষার বিষয়ে কিছুই না বলায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে নতুন গতিবেগ সৃষ্টি হয়নি।’

প্রসঙ্গত, ১৯৫২ সালের ৬ মার্চ রংপুর কারমাইকেল কলেজের প্রভাষক থাকা অবস্থায় তাকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে জড়িত থাকার অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানায় গোলাম। এর স্বপক্ষে ভিন্ন কোনো সূত্রে কোনো প্রমাণ মেলেনি। তবে বাংলা এবং উর্দুর মধ্যে তার পক্ষপাতটুকু আমরা তার আত্মজীবনীতে অনেকবারই পেয়েছি।

এই সিচুয়েশনাল হিরোশিপের ফায়দা এখন গোলাম আবার তুলতে চাইছেন অবস্থার ফেরে পড়ে। অথচ তার উর্দুপ্রীতির কথা তিনি লুকোননি তার আত্মজীবনিতে। বরং ১৯৫০ সালে তার উর্দু শেখার ঘটনার উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘…আমাদের আমীর উর্দুভাষী হওয়ায় উর্দু শোনা ও বুঝার সুযোগ পেয়ে ভালোই লাগলো। উর্দু ভাষার এক প্রকার মিষ্টতা আছে, যার কারণে শুনতে শ্রুতিমধুর মনে হয়।… আমাদের আমীর উর্দুভাষী হলেও কোলকাতার অধিবাসী হওয়ায় বাংলা মোটামুটি বুঝেন ও কিছু কিছু বলতেও পারেন বলে আমাদের জন্য শিখতে সহজ হলো। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনের সময় উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকায় উর্দু শিখবো না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সে ক্ষোভ আর রইল না। উর্দু শেখা শুরু হয়ে গেলো।‘’ (জীবনে যা দেখেছি, ১ম খন্ড, পৃ: ১১২)

১৯৪৮ সালের ওই ঘটনায় গোলামের মুসলমান পরিচয়টিকেই ব্যবহার কার হয়েছে মাত্র। এবং এই পরিচয়ে আজীবনই গোলাম উর্দুকেই শ্রেষ্ঠ মেনে গেছেন। তার প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরা যাক তার আত্মজীবনীর ৩য় খন্ডের ১০৫ পৃষ্ঠায় বলা কিছু কথা, ‘১৯৭১ সাল থেকে সৌদী আরব, কুয়েত, দুবাই, বাহরাইন, কাতার, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা, সিঙ্গাপুর, জাপান ইত্যাদি দেশে অনেকবার আমার সফর করার সুযোগ হয়েছে। হিমালয়ান উপমহাদেশে যারা ইসলামের কর্মসূচী নিয়ে চর্চা করেন, তাদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমই হলো উর্দু। শ্রীলঙ্কা, নেপাল, আফগানিস্তান ও মায়ানমারসহ গোটা উপমহাদেশের মুসলমানদের কমন ভাষা একমাত্র উর্দুই। উচ্চশিক্ষিতদের জন্য ইংরেজি কমন ভাষা হলেও সকলের জন্য উর্দুর কোনো বিকল্প নেই। মুসলমানদের জন্য বিভিন্ন কারণে এ ভাষায়ই সবচেয়ে সহজে ভাবের আদান-প্রদান সম্ভব। বিশেষ করে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের মুসলমানদের বিরাট জনশক্তি ঐসব দেশে রয়েছে। তাদের মধ্যে যারা ইসলামী কর্মকান্ডে জড়িত, তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। উপমহাদেশের কোন দেশ থেকে কোন ইসলামী ব্যক্তিত্ব আসলে তারা যৌথ সমাবেশের আয়োজন করে থাকেন। তাদের পারস্পরিক যোগাযোগ ও মতবিনিময়ের মাধ্যম প্রধানত উর্দু ভাষা। তাই বাংলাদেশীরাও উর্দু মোটামুটি বুঝে এবং কিছু কিছু বলতেও পারে।’

১৯৭০ সালেই সে ভাষা আন্দোলনে তার সম্পৃক্ততা নিয়ে আফসোস জানিয়ে বক্তৃতা দিয়েছে যার উল্লেখ মিলে ১৯ জুন দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায়। সেখানে লেখা হয়, "পশ্চিম পাকিস্তানের শুক্কুরে ১৮ই জুন (১৯৭০) এক সংবর্ধনা সভায় জামায়াত নেতা গোলাম আযম বলেন, উর্দু পাক ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদের সাধারণ ভাষা।’’

তিনি বলেন, ৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় তিনিও তাতে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু তা ভুল হয়েছিল।" (সূত্র - বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস - ড. মোহাম্মদ হাননান পৃষ্ঠা ৩৯৯)।

একই তথ্য সমর্থিত হয়েছে বদরুদ্দিন উমরের কলামেও, ‘মহামান্য গোলাম আযম সাহেব ভাষা আন্দোলনে বীরত্বপূর্ণ ও নায়কোচিত ভূমিকা পালন করা সত্ত্বেও তাতে নিজের এই অংশগ্রহণকে সুবিধাবাদী কারণে অস্বীকার করতেও দ্বিধাবোধ করেননি। আজ নয়, পাকিস্তানি আমলে ১৯৭০ সালের জুন মাসে, পশ্চিম পাকিস্তানের শুক্কুর শহরে এক বক্তৃতা প্রসঙ্গে এই জামায়াত নেতা ‘খোদার সেরা দান’ বাংলা ভাষা ও ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করতে গিয়ে বলেন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এক মারাত্মক রাজনৈতিক ভুল এবং তিনি নিজে এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকার জন্য দু:খিত। গোলাম আযম ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে গিয়ে বলেন, উর্দু হচ্ছে এমন একটা ভাষা যার মাধ্যমে ইসলামী শিক্ষার উপযুক্ত প্রচার ও প্রসার সম্ভব। কারণ ‘উর্দু পাক-ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের সাধারণ ভাষা এবং এতে তাদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সম্পদ সংরক্ষিত রয়েছে।’ নিজের ভ্রান্ত ভূমিকা সম্পর্কে খেদোক্তি করতে গিয়ে গোলাম আযম আরও বলেন, বাংলা ভাষা আন্দোলন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দৃষ্টিকোণ থেকে মোটেই সঠিক কাজ হয়নি। (দৈনিক আজাদ, ২০ জুন, ১৯৭০) শুক্কুরে দেয়া গোলাম আযমের এই বক্তৃতা পত্রিকায় প্রকাশের পর আমি আমার সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘গণশক্তি’ পত্রিকায় এর ওপর লিখেছিলাম। (২১.৬.১৯৭০) গোলাম আযম এসব কথা বলছিলেন এমন এক সময়ে যার অনেক আগে ভাষা আন্দোলনের দাবি অনুযায়ী ১৯৫৬ সালের পাকিস্তান সংবিধানে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিল।

দেখা যাচ্ছে, জামায়াত নেতা গোলাম আযম সাহেবের কথাবার্তার ভেল্কিবাজি ও নৈতিক অধ:পতনের তুলনা নেই। ভাষা আন্দোলনে তার অংশগ্রহণের কাহিনী, তারপর ১৯৭০ সালে তাতে অংশগ্রহণে দু:খ প্রকাশ ও ভাষা আন্দোলনকে বেঠিক কাজ হিসেবে আখ্যায়িত করা, ১৯৯২ সালে নিজেকে ‘ভাষাসৈনিক’ হিসেবে প্রচার করা এবং এখন আবার বাংলা ভাষাকে ‘খোদার সেরা দান’ হিসেবে গৌরবান্বিত করার জন্য মিথ্যায় পরিপূর্ণ ক্যাসেট বের করা¬ সবই হল জামায়াতে ইসলামীর জাদুর খেলা। এর সঙ্গে যে প্রকৃত ইসলামী নৈতিকতার কোন সম্পর্ক নেই একথা বলাই বাহুল্য।’

সবশেষে আসা যাক গোলাম আযমকে ভাষা সৈনিক হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবিতে সোচ্চার জামায়াতে ইসলামীর এই বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গী কেমন ছিলো সে বিষয়ে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ভাষা দিবসের স্মারক শহীদ মিনারটি গুঁড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। সেটিকে স্বাগত জানায় গোলাম আযম ও তার দল। এবং এর পক্ষে সাফাই দিয়ে বলেন যে, শহীদ দিবসের নামে হিন্দুয়ানি প্রথার চর্চা চলছিলো নাকি এখানে। প্রমাণ হিসেবে এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র দৈনিক সংগ্রামে ১২ মে ও ১৬ জুলাইয়ে প্রকাশিত দুটো সংবাদ তুলে দেওয়া হলো:

১২ মের সাংস্কৃতিক অনুপ্রবেশের ইতি হোক শিরোনামে লেখা হয় : হিন্দুস্তানী সংস্কৃতি মুসলমান সংস্কৃতিতে প্রবেশ করে পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতি ক্ষেত্রের প্রচণ্ড ক্ষতিসাধন করেছে। যার ফলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের জাতীয় শ্লোগানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ আল্লাহু আকবর ও পাকিস্তান জিন্দাবাদ বাক্যগুলি বাদ পড়ে এগুলোর জায়গা নিয়েছিলো জয় বাংলা। মুসলমানী ভাবধারার জাতীয় সঙ্গীতের স্থান দখল করেছিলো মুসলিম বিদ্বেষী হিন্দু কবির রচিত গান।...

শহীদ দিবসের ভাষা আন্দোলনে আত্মত্যাগী মুসলমান ছাত্রদের জন্য দোয়া কালাম পড়ে মাগফেরাত কামনার পরিবর্তে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনার্থে হিন্দুয়ানী কায়দা, নগ্নপদে চলা, প্রভাতফেরী, শহীদ মিনারের পাদদেশে আল্পনা আঁকা ও চন্ডীদেবীর মূর্তি স্থাপন ও যুবক-যুবতীদের মিলে নাচগান করা মূলত ঐসকল পত্রপত্রিকা ও সাংস্কৃতিক মাধ্যমগুলির বদৌলতেই এখানে করা সম্ভব হয়েছে।

১৬ জুলাই `ইতিহাস কথা বলে` সম্পাদকীয়তে তারা লেখে : আইউব খানের গভর্নর আজম খান ছাত্রদের খুশী করার জন্য যে শহীদ মিনার তৈরি করলেন তাকে পুজা মন্ডপ বলা যেতে পারে কিন্তু মিনার কিছুতেই না। যাহোক সেনাবাহিনী সেই কুখ্যাত মিনারটি ধ্বংস করে সেখানে মসজিদ গড়ে শহীদদের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শনের চেষ্টা করেছেন জেনে দেশবাসী খুশী হয়েছে।

আশা করি এরপর পাঠকদের গোলাম আযম ও তার অনুসারীদের বাংলা ভাষা এবং এর জন্য আন্দোলনে ভূমিকা ও সত্যিকার দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে কোনো বিভ্রান্তি থাকবে না।

তথ্যসূত্র:
১.ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর ভেলকিবাজি : বদরুদ্দীন উমর (http://www.droho.net/?p=3659)লিন্ক
২. জীবনে যা দেখেছি: গোলাম আযম, ১ম ও ৩য় খন্ড
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মার্চ, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:০১
১৬টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস-পরীক্ষার হলে দেরিঃ পক্ষ বনাম বিপক্ষ

লিখেছেন BM Khalid Hasan, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



বর্তমানের হট টপিক হলো, “১ মিনিট দেরি করে বিসিএস পরীক্ষার হলে ঢুকতে না পেরে পরীক্ষার্থীর স্বপ্ন ভঙ্গ।” প্রচন্ড কান্নারত অবস্থায় তাদের ছবি ও ভিডিও দেখা যাচ্ছে। কারণ সারাজীবন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

×