কে হবেন জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক? বিসিবি সাকিব-তামিমকে অব্যাহতি দিলেও তাদের পরে কারা আসছে এমন কোন ঘোষণা দেয়নি। সামনেই বিসিবি কাপ। এর আগেই হয়তো বিসিবি অধিনায়কের নাম ঘোষণা করতে পারে। আবার অক্টোবরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হোম সিরিজের জন্যও অপেক্ষা করতে পারে। যখনই অধিনায়ক ঘোষণা করা হোক এই মুহূর্তে সাকিব, তামিম, আশরাফুলকে বাদ দিয়ে বিসিবি সব চিন্তা ভাবনা করছে বলে জানা গেছে। তবে এই প্রশ্নের উত্তর হয়ত খুব শীঘ্রই জানা যাবে। সম্ভাব্য অধিনায়কের তালিকায় সবচেয়ে যে নামটি সবার মুখে ঘুরেফিরে আসছে তিনি হলেন মুশফিকুর রহিম। ঠিক তেমনি নাফিস এবং মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের নামও রয়েছে।
"একবার বিকেএসপিতে সপ্তম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার দিন শ্রেণীর প্রায় শ খানেক শিক্ষার্থীর মধ্যে অধ্যক্ষ জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে প্রথম হবে বলে মনে কর?’ মাত্র ছোট্ট একটি হাত উঠে আসে। শিক্ষক জিজ্ঞেস করেন, ‘কেন তুমি প্রথম হবে?’ উত্তরে ছেলেটি বলে, ‘আমার আত্মবিশ্বাস আছে।’ ফলাফলে দেখা যায়, সত্যি সত্যি ছেলেটি প্রথম হয়েছে। সেদিনের এই ছোট্ট ছেলেটিই আজকের আমাদের প্রিয়মুখ মুশফিকুর রহিম।
বিকেএসপিতে থাকতেই তার লেখাপড়া, শৃঙ্খলা, ব্যবহার—সবই ছিল অনুকরণ করার মতো। আর তাইতো বিকেএসপি থেকে প্রথম এ+ পাওয়ার গৌরবটা তারই। খেলাপাগল ছেলেটি একবার বিকেএসপির শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়ে মেডেল জিতে নেয়। বিকেএসপির এ যাবত সেরা আবিষ্কারের মধ্য মুশফিকের নাম সবার আগে থাকবে।
ভালো খেলে যে আবার ভালো ছাত্র হওয়া যায়, তা মুশফিক প্রমাণ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে খেলোয়াড়দের কোটা থাকলেও তা গ্রহণ করেননি বাংলাদেশ দলের এই উইকেট রক্ষক। যথারীতি ভর্তিপরীক্ষা দিয়েই স্থান করে নেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। খেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও পড়াশোনায় তুখোড় মেধাবী ছেলেটি।" [১]
শুধুমাত্র প্রতিভা আর আত্মবিশ্বাস থাকার কারনেই ক্যারিয়ারের একেবারে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত নানা সমালোচনা স্বত্তেও ছোট্ট মুশফিক ভেঙ্গে না পড়ে নিজেকে প্রতিনিয়ত প্রমান করেই চলেছেন। কখনো তার কিপিং আবার কখনো তার ব্যটিং নিয়ে সমালোচনার তীর বারবার তাকে বিদ্ধ করলেও সামান্যতম বিচলিত হয়নি মুশফিকুর।
১৯৮৮ সালে বগুড়ায় জন্ম নেয়া মুশফিকুর ২০০৫ সালের ইংল্যান্ড সফরে প্রথমবারের মতো জাতীয় দলের সঙ্গী হয় মাত্র ১৭ বছর (তখনো ১৭ বছর হতে ৩মাস বাকি ছিল) বয়সে। বাংলাদেশের প্রথম ইংল্যান্ড সফর ছিল সেটি। বাংলাদেশ প্রথমবার লর্ডসে খেলব, এই উত্তেজনায় অনেকের দুশ্চিন্তা হলেও আশ্চর্য শান্ত মুশফিকুর। এবং সবাইকে ও চমকে দিল প্রস্তুতি ম্যাচেই। সফরের প্রথম প্রস্তুতি ম্যাচটিতে দ্বিতীয় ইনিংসে লড়াকু ৬৩ রানের একটা ইনিংস খেলেন সাসেক্সের বিপক্ষে। তবে পরের প্রস্তুতি ম্যাচে নর্দাম্পটনশায়ারের বিপক্ষে ১১৫ রানের অপরাজিত সেই ইনিংসটিই তাকে পরিচিতি এনে দেয়। নর্দাম্পটনশায়ারের ঐ ম্যাচের পর মুশফিকুর নজর কেড়েছিল নাক-উঁচু ইংলিশ মিডিয়ারও। তার ১১৫ রানের ইনিংস নিয়ে তখন বিশিষ্ট ক্রিকেট ভাষ্যকার জিওফ্রে বয়কট বলেছিলেন, ‘ছোড়াটার টেকনিক তো দেখছি জবরদস্ত!’ তবে ভাগ্য সহায় না হওয়ায় লর্ডস টেস্ট খেলেই এ্যাংকেল ইনজুরির কবলে পড়ায় সিরিজের বাকি ম্যাচগুলো তার আর খেলা হয় নি।
এরপর ২০০৬ সালে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ-১৯ বিশ্বকাপে মুশফিক বাংলাদেশ দলকে নেত্ত্ব দেন। অন্যান্যদের মধ্যে এই দলে ছিলেন ভবিষ্যতের আনর্জাতিক তারকা সাকিব আল হাসান এবং তামিম ইকবাল। সেবার মুশফিকের নজরকাড়া নেত্ত্বে বাংলাদেশ কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত যেতে সমর্থ হয়।[২] সুতারাং পুর্বেই সাকিব-তামিমকে নেতৃত্ব দেয়ার অভিজ্ঞতা থাকায় মুশফিকের সামনে অধিনায়কত্ব সহজ হবে বলেই মনে হচ্ছে।
২০০৬ এর জিম্বাবুয়ে ট্যুরে মুশফিক, ফরহাদ রেজা ও সাকিব আল হাসানেরওয়ানডে অভিষেক হয়। হারারেতে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে মুশফিক তার প্রথম হাফ সেঞ্চুরি করেন। পরের বছর সবাইকে চমকে দিয়ে ওয়েস্ট-ইন্ডিজে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্বকাপের জন্য খালেদ মাসুদের স্থলাভিষিক্ত হন মুশফিক।
এভাবে চলতে থাকে মুশফিকের ক্যারিয়ার। ২০০৯ এর জিম্বাবুয়ে ট্যুরে মুশফিক বাংলাদেশের সহ-অধিনায়ক নির্বাচিত হন। ২০১০ এর ২১ জানুয়ারী ভারতের বিরুদ্ধে হোম সিরিজের প্রথম টেস্টের পঞ্চম দিনে মুশফিক তার ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি করেন। মাত্র ১১২ বলে চমৎকার সেঞ্চুরি করে তিনি বাংলাদেশের দ্রুততম টেস্ট সেঞ্চুরির মালিক হন।
এখন বাংলাদেশ দলের ভবিষ্যৎ অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি বিবেচিত হচ্ছে মুশফিকের নাম। মুশফিকুর এখন উইকেটের পেছনেও অনেক বেশি সক্রিয়। দলকে উদ্বুদ্ধ রাখতেও উইকেটকিপারের ভূমিকা অনেক বড়। টিভিতে খেলা দেখলেই সবার নজরে পড়ে, মুশফিকুর চিৎকার করেই বোলারদের, ফিল্ডারদের অনুপ্রাণিত করে সারাক্ষন। উইকেটের পেছন থেকে খেলা দেখার আরেকটা বড় ভূমিকা হলো, প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানটিকে সেই কিন্তু সবচেয়ে কাছে থেকে দেখছে।
তার সম্পর্কে আজকে একটি পত্রিকায় বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান বলেন, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ভবিষ্যৎ অধিনায়ক হতে পারেন মুশফিকুর রহিম। তিনি বলেন, 'ক্রিকেটীয় ব্রেইনের দিক থেকে মুশফিকুর রহিম অনেক ভালো। সেক্ষেত্রে তার অধিনায়ক হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।' বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ সুজনও অবশ্য রকিবুলের সুরেই কথা বললেন। তিনিও মুশফিকুর রহিমের কথাই বলেছেন।[৩]
২০০৩ সালে ২২ বছর বয়সে দক্ষিন আফ্রিকা গ্রায়েম স্মিথের হাতে আধিনায়কত্ব তুলে দিয়ে যেমন দীর্ঘমেয়াদী পথ বেছে নিয়েছিল সেভাবে আরেক ২২ বছর বয়সী মুশফিককে ভবিষ্যতের কথা ভেবে একজন যোগ্য অধিনায়ক হিসেবে বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রফেশনাল কোচ স্টুয়ার্ট ল ভালো ভুমিকা রাখতে পারেন। একজন অধিনায়ককে দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হয়। তাই পারফরমেন্স এর কথা মাথায় রাখা দরকার। অধিনায়ককে ভাল টিমম্যান ও হতে হয়। একজন উইকেট কিপার এর প্রতিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যান জানার, নিজ দলের বোলার, ফিল্ডার দের অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা বেশি থাকে। এর পর তার যদি দলের সহকারী অধিনায়ক থাকার পুর্ব অভিজ্ঞতা থাকে তবে তো সেটা প্লাস পয়েন্ট।
এসব বিবেচনায় নিলে মুশফিকুর রহিম এর দিকেই দৃষ্টি যায়।
তথ্যসুত্র-
[১] ওপেন মিডিয়া লাইন
[২]Miller, Andrew, ইংল্যান্ড বনাম বাংলাদেশ সিরিজ, ২০০৫, প্রকাশক: Wisden Cricketers' Almanack, r হয়েছে: 2011-02-14
[৩] বাংলাদেশ প্রতিদিন (০৮-০৯-১১)
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ রাত ১১:২৮