বৈদিক ধর্মের পুরোধা হিসেবে বিবেচিত সপ্তর্ষির অন্যতম ঋষি কাস্যপ (Kasyapa), বিয়ে করেন প্রজাপতি দক্ষের তের কন্যাকে, কালক্রমে জন্ম হয় দেব, অসুর, নাগ, অপ্সরা ও মানবগোষ্ঠির। পুত্র সন্তান লাভের আশায় একদা যজ্ঞের (sacrifice) আয়োজন করেন কাস্যপ, সে এক প্রকাণ্ড কাণ্ড বটে। দলে দলে যোগ দেয় দেব, গান্ধর্ব্য ও মুনির দল।
যজ্ঞের অগ্নিকাষ্ঠ বয়ে আনার ভার পড়ে দেবরাজ ইন্দ্র (Indra) এবং ৬০,০০০ মুনির এক গোত্রের উপর। বড় বড় বৃক্ষের আস্ত গুঁড়ি নিয়ে যখন অতিকায় স্তুপ বানিয়ে ফেলেন ইন্দ্র, তখন মুনির দল বয়ে আনেন কেবল পলাশ পাতার একটি বৃন্ত কিংবা এক চিলতে কাঠ। মুনি বেচারাদের অবশ্য দোষ নেই, যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন তারা। কিন্তু কী-ই বা করবেন, শারীরিক উচ্চতায় তারা মানুষের বৃদ্ধাঙ্গুলির সমান মাত্র!
নিজের পর্বতসম অর্জনের দিকে দৃষ্টিপাত করেন ইন্দ্র, দৃষ্টিপাত করেন ক্ষুদ্রাকৃতির মুনি, এবং ততোধিক ক্ষুদ্র তাদের অর্জনের দিকে। ক্ষমতায় মদমত্ত ইন্দ্র সংবরণ করতে পারেন না হাসি, মেতে উঠেন উপহাসে।
এত বড় সাহস, এত বড় অপমান! অক্ষম ফেলনা নন তারা, পিতা তাদের সপ্তর্ষির আরেক ঋষি, ব্রহ্মার মানসপুত্র ক্রেতু (Kratu), মাতা তাদের বিখ্যাত কর্দম মুনির ষষ্ঠ কন্যা ক্রিয়া (Kriya)। ক্রিয়া-ক্রেতুর ৬০,০০০ সন্তান তারা, যাদের প্রত্যেকেই বাণপ্রস্থ (vanaprastha) অবলম্বনের মাধ্যমে সংসারজীবন পরিত্যাগ করেন এবং কঠোর কৃচ্ছ্রব্রতের (asceticism) মধ্য দিয়ে লাভ করেন সিদ্ধি; সাধনায় এতই উৎকর্ষ লাভ করেন যে তপশ্চর্যার আত্মিক অগ্নিশিখায় সর্বদাই তীব্রভাবে জ্বলতে থাকেন তারা। সূর্যদেবের চক্র পরিভ্রমণের সময় রথের দিকে মুখ করে অগ্রগামী হয়ে থাকেন তারা, বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণপূর্বক (vedic mantras) পূজা নিবেদন করেন তাকে।
ক্রোধে কাজ বন্ধ করে দেন মুনির দল, অভিশাপ দেন ইন্দ্রকে, "এমন এক পুত্র জন্মগ্রহণ করবে কাস্যপের ঘরে যে হবে সকল সৃষ্টির ইন্দ্র!" তারপর সে ইন্দ্র তৈরি করার জন্য কাতর-প্রার্থনায় (penance) বসে গেলেন তারা।
প্রমাদ গুনেন হতবুদ্ধি ইন্দ্র, শরণাপন্ন হন কাস্যপের, "কী এর প্রতিবিধান, হে কাস্যপ?"
"লক্ষণ বেশি সুবিধার ঠেকছে না আমার কাছে, হে ইন্দ্র! ভালো হয় আপনি ব্রহ্মাকে আহ্বান করলে।" কাস্যপ পরামর্শ দেন।
আকুলভাবে ব্রহ্মাকে (Brahma) ডাকেন ইন্দ্র। সব শুনে নিজের ব্রহ্মতালুতেই উত্তাপ অনুভব করেন ব্রহ্মা, "দেখো হে, ইন্দ্র, অভিশাপটি একেবারে নিষ্ক্রিয় করা যাবে না। আমি বরং একটু পরিবর্তিত করে দেই—এমন এক পুত্র জন্মগ্রহণ করবে কাস্যপের ঘরে যে হবে সকল পক্ষির ইন্দ্র, এবং এক সময় সে বন্ধু হবে তোমার, ফলে তার রোষানল থেকে বেঁচে যাবে তুমি।" কালক্রমে কাস্যপের এক স্ত্রী বিনাতার (Vinata) গর্ভে জন্ম নেয় সে অভীষ্ট পুত্র, যার নাম হয় গরুড় (Garuda), যে দেবালয় থেকে অমৃত ছিনিয়ে আনার সময় সত্যি সত্যি ইন্দ্রকে পরাভূত করে—পূর্ণ হয় ক্ষুদ্র মুনিদের অভিশাপ।
মহাভারত ও রামায়ণ উপাখ্যানের বিভিন্ন অংশে উল্লেখিত, বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের সমান আকৃতির এ মুনিদের সম্মিলিত নাম বালখিল্য (Valakhilya)। শারীরিক ক্ষুদ্রাকৃতি ও ঔজ্জ্বল্যের কারণে এরা দেখতে শিশুসুলভ, যেখান থাকে পরবর্তীতে রূপকার্থে বালখিল্যতা শব্দটির প্রচলন, যার মানে "বয়ষ্ক মানুষের অত্যন্ত শিশুসুলভ আচরণ।"
বালখিল্যতার একই উৎস থেকে বালক, বালিকা, বালসুলভ, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা প্রভৃতি শব্দসমূহও বিকাশ লাভ করেছে।
জোনাথন সুইফটের Gulliver's Travels উপন্যাস রচনায় বালখিল্যদের প্রভাব ছিল কি না জানা না গেলেও, আক্ষরিক অর্থে বালখিল্যদের ইংরেজি প্রতিশব্দ হতে পারে Lilliput। _____________________________________________
ইংরেজি শব্দের ব্যুৎপত্তির উপর শব্দ-রাজ্যে অভিযান নামে একটি ধারাবাহিক শুরু করেছিলাম। বেশ কিছু পর্বও হয়ে গেল ইতোমধ্যে। ইংরেজিতে তাই আপাতত সাময়িক বিরতি নিচ্ছি; শুরু করছি বাংলা শব্দের ব্যুৎপত্তি নিয়ে। আজকের পর্ব ছিল বালখিল্যতা।
আশা করি, নতুন এ প্রচেষ্টাকে পাঠকগণ আগের মতোই গ্রহণ করবেন, বালখিল্য কোনো প্রয়াস ভাববেন না।
পুরাণ সংক্রান্ত তথ্যসূত্রঃ
১। http://en.wikipedia.org/wiki/Kashyapa
২। Click This Link
৩। Click This Link