২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।
মানুষ, নানারকম মানুষ আমার সব'চে বড় আগ্রহের জায়গা। মানুষকে জানতে চাই, শুনতে চাই। নানান রকম মানুষ, নানারকম চিন্তা, মতামত, আবেগ, পরিকল্পনা আর ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ ভঙ্গির মিথষ্ক্রিয়া আমার নিজেকে চিনে নিতে, বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করে খুব। আমি আমাকে একটা চলমান ভাঙা-গড়ায় রাখতে পারি। মজার কথা হলো, এই অদ্ভুত উপায়ে নিজেকে শক্তিশালী করতে আমার মানুষ খুঁজে নিতে হয়না কখনও। আপনা থেকেই জুটে যায়। চলার পথে, দৈনন্দিন কাজে কিংবা একটা ভালো বইতে, গানে বা নাটকে অথবা নিতান্তই ছোট্ট কোন দোকানে, বাগানে এমন কি সম্পূর্ণ একা একা হাঁটতেও। আমার 'একা'র ভেতরেও নানারকম মানুষের অস্তিত্ব দেখি- সেসব নিয়ে পরে বলছি।
নিশ্চিতভাবেই বই, সঙ্গীত, নাটক, সিনেমা এবং সামাজিক যোগাযোগ এই রকম আগ্রহ মেটাবার বড় জায়গা সেটা বিশ্বাস করি। সৌভাগ্যবশত এক বিশাল পারিবারিক পাঠাগার, ভ্রমণ, মা এবং বড়ভায়ের বেছে দেয়া ভাল বই, সিনেমা, নাটক, ভাল গান শোনা বা একটুখানি চর্চার সুযোগ, অবাধ খেলাধুলার এবং নানারকম মানুষের সাথে মেশার পরিবেশ পেয়ে বড় হয়েছি। পাশাপাশি শৈশব থেকেই ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে পড়ে এবং শুনে শুনে চোখ-কান খুলতে শুরু করেছে। নানারকম মানুষের সাথে যোগাযোগের সুযোগ হয়েই চলেছে। আমি আনন্দ নিয়ে মানুষ দেখি, শুনি, বোঝার চেষ্টা করি বিশেষ আগ্রহ নিয়েই। দেশে-বিদেশে কেবল নানারকম মানুষ আর সংস্কৃতি নিয়েই আমার হাজারো কথা আর গল্প রয়েছে মনে, মাথায়। কত কিছু যে আমার বলার আছে। আমার একটুখানি 'বলা'য় অন্যদের অনেক কিছু বলিয়ে নিতে আমার খুব আনন্দ। কত কত বর্ণময় বিষয় তাতে আমি পেয়ে যাই। সেসব শুনে, জেনে, শিখে জীবন চলার পথে যোগ-বিয়োগ করি। এতে আমি নিজেকে ভাঙা-গড়ার সুযোগ পেয়ে আনন্দ পাই।
শৈশবে বাড়িতে অবজারভার আর সংবাদ এই দু'টো দৈনিক কাগজ রাখা হতো। আমার সপ্তম শ্রেণীর এক রোববারের সকাল। মা সহ সবাই মিলে নাশ্তার টেবিলে। সেদিনের দৈনিকের কোন একটা বিশেষ বিষয় নিয়ে কথা বলছেন মা। আমার বড় ভাই-বোন দু'টো মায়ের সাথে আলোচনা করছেন। আমি শুনছি, ভাবছি। সবার মতামত কখনও এক কখনও আলাদা। আমার ভাল লাগছে শুনতে, জানতে। বিষয়টি নিয়ে আমার ভেতরে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা ভাবনা ছটফট করছে বেরিয়ে আসার জন্যে। মনে মনে চাইছি, আহা যদি এমনটা হতো, আমাদের সবার এই আলাদা আলাদা কথাগুলো, চিন্তাগুলো সবাই জানতে পারতো! এভাবে যে হাজারো মানুষের বিভিন্ন বিষয়ে নানান মত রয়েছে তাতো কেউ জানতে পারে না! সাহস করে বলে বসলাম, 'মা, খবরের কাগজের লেখাগুলোতো একপক্ষীয়। সবাইকে শুধু পড়ে যেতে হয়। এর পক্ষে বা বিপক্ষে যে হাজরো কথা সবার মনের ভেতর ছটফট করে তাতো কেউ জানতে পারেনা। তাই সবার মতামত সবাই জানতে পারবে এমন একটা কোন উপায় থাকা উচিত ছিল। মা হেসে বললেন, তবে, অত বড় খবরের কাগজ পড়তে তোমার কতদিন লাগতো জানো? আর তাতে হাজারো বক্তব্য-মন্তব্য যাচাই বাছাই, হাজারো লোকবল নিয়োগ, বিপুল পয়সা-কড়ি যোগাড় করতে খবরের কাগজওয়ালাদের কি দশা হতো বলতো? প্রতিদিন আর ঘরে ঘরে খবরের কাগজ আসতো? খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে ভাবলাম, সত্যি তো!
বলছিলাম, আমার 'একা'র ভেতরে প্রায়শই আরেকটি জলজ্যান্ত অন্য মানুষের অস্তিত্বের কথা। খুব অদ্ভুত শোনালেও কৈশরের কোন একটা সময়ে আমার ভেতর আমি এক ভিন্ন আমি টের পেয়েছি। শান্ত এবং একটুখানি অন্তর্মূখী সেই আমি আমার ভেতরে আরেকটা 'আমি' কল্পনা করে পছন্দসই কোন বিষয় নিয়ে বিতর্ক করতাম মনে মনে। পক্ষে বিপক্ষে দুটোতেই যুক্তি দাঁড় করিয়ে তুমুল বিতর্ক হতো ভেতরে ভেতরে। নিজের যুক্তির শক্তিমত্তা যাচাইয়ের এক অদ্ভুত খেলা। অনেক সময় এমন হয়েছে যে আমার পড়ায় মন নেই, খেলায়, সঙ্গীত চর্চায় মন নেই। এমন কি খাবার টেবিলেও চামচ থেমে গেছে। আমি হয়তো মনে মনে খুব সাধারণ কিছু নিয়েই ভেতরে তুমুল বিতর্ক করে চলেছি নিজের সাথেই। বিষয়টা নিয়ে হয়তো কখনও মা বা ভাই-বোনদের সাথে কথা বলেছি। ভাইবোনরা দুষ্টুমি করে বলেছে এটা তোমার এক রকম পাগলামো। কিন্তু মা কখনও তা বলেননি বরং আমার বিতর্কের বিষয় জানতে চেয়েছেন, যুক্তিগুলো শুনতে চেয়েছেন। বুঝতে চেয়েছেন আমার এমন ব্যতিক্রম উপায়ে ব্যক্তিগত আনন্দ পাবার পথটা।
শৈশবে রূপকথার পাশাপশি প্রায় সবারই কম-বেশী 'ভূত' এর গল্প শোনার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এটা খুব প্রচলিত একটা বিষয় বিশ্ব জুড়েই। অনেক সময় দেখা যায় যে, বড়দের কেউ কেউ অকারণ শিশুদের 'ভূত'এর ভয় দেখিয়ে মজা পায়। আমারও ঘরে বাইরে পরিচিত কেউ কেউ তো ছিলেন এমন। এতে শিশুর মনে অদেখা 'ভূত' নিয়ে অকারণ বিচিত্র এক ভীতি জায়গা করে নেয়। এটা কতখানি সঠিক বা ভুল তা নিয়ে আজকে অজস্র লেখা, যুক্তি রয়েছে। আমি সেসব নিয়ে বলছিনা আজ। বরং আমার অন্যরকম 'আমি' নিয়ে বলি। আমারও 'ভূত' এর ভয় ছিল শৈশবে এবং তা বেশ জোরালোই ছিল দশ বারো বছর বয়স পর্যন্ত। আমার অকারণই মনে হতো কিছু একটা অদ্ভূত জিনিষ আমার বিছানার নীচে লুকিয়ে আছে যার নাম 'ভূত'। বিছানায় ওঠার সময় সে আমার পা টেনে ধরবে- ভেবে সারা শরীর হীম হয়ে যেত। ১০-১২ বছর বয়সের কোন এক শীতের সন্ধ্যায়, সেই অদেখা ভয় আমার ভেতরে অন্যরকম এক বিবেচনার জায়গা নেয়। আমি অদেখা সেই 'ভূত'কে দেখতে চাই। বড় একটা জানালার সাথে লাগোয়া আমার পড়ার টেবিল। সন্ধ্যেবেলায় মা জানালার পর্দা টেনে দিয়ে পড়তে বসিয়ে নিজের কাজে চলে যান আর আমি ভয়ে শিঁটিয়ে যাই 'ভূত' দেখতে না পেয়ে। বিচিত্র সব আকারের অদেখা ভূতের চেহারা মাথায় জড়ো হতে থাকে। বড় অদ্ভুৎ ব্যপার। পড়া মাথায় উঠলো। কিছুক্ষণ পরে মা ফিরে এসে মেয়ের পাংশুটে মুখ দেখে অবাক। মা'কে আমার বিচিত্র চিন্তার কথা অকপটে জানিয়ে দিই। আমি বিশ্বাস করি নিশ্চিতভাবেই পর্দায় ঢাকা জানালার ওপাশে 'ভূত' আছে এবং সেটা আমি যতক্ষণ নিজে চোখে না দেখতে পাচ্ছি ততক্ষণ আমার মাথায় তাদের ভয়ঙ্কর সব চেহারা এবং কার্যকলাপ ঘুরে চলেছে। তারচে' পর্দা সরিয়ে জানালা খুলে দাও। আমি সরাসরি 'ভূত'দের দেখতে পেলে ওরা কতখানি ভয়ঙ্কর, তা দেখে ভয় নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো। আর যদি ভূত বলে কিছহু না-ই থেকে থাকে তবে সেটাও নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে চাই। মা সেই ব্যবস্থাই করলেন আর আমার 'ভূত'এর ভয় ভিন্ন চিত্র পেল। আমার সেই বিশ্বাস হাজার গুণে শক্তিশালী হয়েছে পরে। আমি সবরকম 'ভূত' এর মুখোমুখি হতে চেয়েছি সবসময়, তার/তাদের রূপ এবং কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে প্রস্তুত থাকতে চেয়েছি, সজাগ থাকতে চেয়েছি, আজও চেয়ে চলেছি। পরে বড় হয়ে "ভূত" নিয়ে আমার উল্টো-পাল্টা ভাবনাগুলো একেবারেই ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় মাথায় জায়গা নিয়েছে। এখন আমি জানি এবং মানি "ভূত" এর অস্তিত্ব চীরকালই ছিল এবং রয়েছে। এরা সমাজেই, আশেপাশেই রয়েছে বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন স্বভাবে-আচরণে। এরা নিজেদের কুৎসিত চেহারা, "শক্তি" এবং "সাহস" মনুষ্য সমাজে দেখাতে এবং নিজেদের টিকিয়ে রাখতে স্বাভাবিকভাবেই মুখিয়ে থাকে যেহেতু এরা নগন্য, অস্থায়ী, বোধ-বিবেচনাহীন এবং অগ্রহণযোগ্য। তাই এদের বা এদের মতোদের গুরুত্ব দেবার কারণ নেই। তবে, অবশ্যই পরিস্থিতি অনুযায়ী এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার সুযোগ তো মানুষের রয়েছেই।
মানুষের বুদ্ধিমত্তা, বিবেক-বিবেচনাবোধ, আত্নসম্মানবোধ, পারষ্পরিক সম্মানবোধ সহ যাবতীয় মানবিক গুনাবলী সত্যিকার অর্থে অপ্রতিরোধ্য শক্তিশালী এবং গতিশীল। ইতিবাচক, সুস্থ ও মুক্তচিন্তা মানুষকে জাগিয়ে রাখে। মানুষ এবং মানবিকতার জয় হোক, চীরস্থায়ী হোক সম্মানজনক জীবন এবং ভালোবাসা
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৩৫