চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু। লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে বলি। ১৯৮২ সাল। ম্যাককয় হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠতে নেপাল যান। প্রথম কয়েক মাস নেপালের ছোপখাটো পাহাড়ে হাইকিং করে কঠোর প্রস্তুতি নেন। সর্বশেষ তিনি হিমালয়ের সবোর্চ্চ চূড়ায় ওঠতে শুরু করেন। তার সাথে ছিলেন নিউজিল্যান্ডের স্টিফেন। আরো ছিলেন সুইজারল্যান্ড ও জাপানের আরোহীরা। তাদের সাহায্যে ছিল নেপালের গাইড আর কিছু কুলি। সেসময় হিমালয়ের চূড়ায় ওঠা যেমন ব্যয়বহুল তেমন কষ্টসাধ্য ছিল। ওই সময় ভাগ্যের জোরে পর্বতারোহীরা হিমালয়ের চূড়ায় উঠতে পারতেন। অনেকের জীবন চলে যেতো। অনেক কষ্টে কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে তারা একসময় এমন একটি স্থানে পৌঁছান যে সেখান থেকে হিমালয়ের চূড়া দেখা যাচ্ছিল। এসময় স্টিফেন একটু এগিয়ে ছিলেন। তিনি হঠাৎ একজন ভারতীয় সাধুর দেহের মুখোমুখি হলেন। সামান্য পোশাক পরা এবং তীব্র ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে সে সবে বেঁচে ছিল। স্টিফেন সাধুকে দ্রুত গরম কাপড়ে ঢেকে দেন। দেখলেন, প্রচণ্ড ঠান্ডায় সাধুর হাইকোথার্মিয়া হয়েছে। তিনি দ্রুত সাধুকে তুলে নিয়ে ম্যাককয়ের কাছে নিয়ে গেলেন। ম্যাককয় তাকে নিয়ে ডিলেমায় পড়ে গেলেন। সাধুকে বাঁচাতে হলে দ্রুত ক্যাম্পে পৌঁছাতে হবে। নিচের ক্যাম্পে যেতে হলে কম করে হলেও দুই দিন লাগবে। একবার নেমে গেলে আর ওঠা সম্ভব নয়। কারণ জীবন বাজি রেখে কঠিন পথটা তারা পাড়ি দিয়েছেন। হিমালয়ের চূড়ায় ওঠার জন্য বহু বছর ধরে তারা প্রস্তুতি নিয়েছেন। কঠোর পরিশ্রম ও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। অনেক পাহাড়ে উঠে মহাড়া দিয়েছেন। এখন একজন সাধুর জীবন রক্ষা করতে গেলে সারা জীবনের লালিত সাধ আর দেশের গর্ব বিসর্জন দিতে হবে। বিসর্জন দিতে হতে ইতিহাসে নাম লেখানোর সুযোগ। ম্যাককয় সাধুকে কিছু খাবার, পানীয় ও ওষুধ দিয়ে জাপানির কাছে দিলেন। জাপানি তাকে সেবা শুশ্রুষা করে সুইস ব্যক্তির কাছে দিলেন। সুইস ব্যক্তি সাধ্যমতো সোবযত্ন করে নেপালিদের কাছে তাকে দেন। পরে সবাই তাকে ওখানেই ফেলে রেখে চূড়ার পথ ধরেন। পরবর্তীতে কি হয়েছিলো সাধুর? সবাই সবার কাজ করেছেন। দে ডিড দেয়ার বিট। সবাই সবার অংশ যথাসাধ্য করেছে। তাতে আখেরে সাধুর জন্য মঙ্গলজনক কিছুই হয়নি। ম্যাককয় আফেসাসের সুরে পরবর্তীতে লিখেছিলেন, সাধুর এ অবস্থায় যে প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছিল তিনি কখনই সেই প্রশ্নের উত্তর শিখেননি। পরিবর্তিতে, সাধুর গল্পটি বিশ্ব বিবেককে নাড়িয়ে দেয়। বহু আলোচনা হয়। বহু মতবাদ ও দৃষ্টিভঙ্গি এ বিষয়কে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে। ফলে আরও প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। হিমালয়ের ঢালে, একদল ব্যক্তি আকস্মিক এই ঘটনার জন্য অপ্রস্তুত ছিল। তারা সকলেই 'তাদের কাজ করেছে', কিন্তু একটি জীবনের জন্য চূড়ান্ত দায়িত্ব নেওয়ার জন্য দলটি যথেষ্ট সংগঠিত ছিল না। ম্যাককয় জিজ্ঞাসা করেছেন, কিভাবে, একটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে, আমরা কি আমাদের সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠানগুলিকে প্রস্তুত করি যাতে তারা নৈতিক সংকটে যথাযথভাবে সম্মিলিতভাবে সাড়া দেয়? নাকি যে যার কাজটাই করে যায়!
যারা এ লেখা পড়ছেন, তাদের কাছে আমার প্রশ্নটা হলো- আপনি যদি ভ্রমণকারীদের অবস্থানে থাকতেন তবে আপনি কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতেন? হিমালয়ের চূড়া আরোহন বাদ দিয়ে সাধুকে নিয়ে ফেরার চেষ্টা করতেন? আপনার সাথে কেউ কী সঙ্গী হতো? তারা কী ফিরে যেতে রাজি হতো! সঙ্গী না হলে সাধুর সাথে আপনারও জীবন অবসান হতো। এ পরিস্থিতিতে কী করতেন?
দুই.
দ্বিতীয় সমস্যাটা কলেবরে বাড়াবোনা। খুব সংক্ষেপে বলছি।
কল্পনা করুন যে, আপনি একটি জাহাজডুবির পরিস্থিতিতে পড়েছেন। জাহাজটিতে আপনি আরোহী আর সমুদ্রের মাঝখানে সেটি ডুবতে শুরু করেছে। এ পরিস্থিতিতে একটি লাইফ বোট দেখে ঝাপ দিলেন। আপনার দেখাদেখি আরো দশজন ওই লাইফবোটে ঝাপ দিয়েছে। সব মিলিয়ে ১১ জন মৃত্যূভয়ে কম্পমান বিপন্ন মানুষ নৌকায় ওঠেছে। তবে নৌকাটি কেবল সর্বোচ্চ দশজনের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এগারো জন ওঠায় লাইফ বোটটিও ডুবতে শুরু করেছে। প্রশ্ন হলো- যাত্রীদের কি করা উচিত? একজনকে লাইফ বোট থেকে ফেলে দশজনের জীবন বাঁচাবেন? নাকি "মারবেন না" নীতিতে লেগে থাকবেন, যার মানে সবাই ডুবে মরবেন?
তিন.
দুটি ঘটনাই নৈতিকতার প্রশ্ন। একজনকে মারতে হবে। নয়তো নিজে মারা পড়বেন। আরেকজনকে মেরে নিজে যদি বেঁচে যান, তাহলে পরবর্তীতে আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে। বহু দিন আগে এক মানসিক রোগে আক্রান্ত বৃদ্ধের কথা বলেছিলাম। যিনি চট্টগ্রামের বাঁশখালি উপজেলায় ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে নিজের শিশু সন্তানকে শরীরের সাথে বেঁধে একটি নারিকেল গাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তবে প্রবল জলোচ্ছ্বাসে গাছটি পানির মধ্যে হারিয়ে যেতে থাকে আবার জেগে ওঠে। এভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে লড়ে যাচ্ছিলেন পিতা ও পূত্র। পুত্রকে আগেই বলে রেখেছিলেন, যাই হোকনা কেন, সে যেন বাবাকে কোনমতে না ছেড়ে দেয়। একপর্যায়ে বাবার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। তিনি পুত্রকে শরীরের সাথে বেঁধে রাখা গামছাটা খুলে দিলেন। ভারমুক্ত হতে চাইলেন। তবে পুত্র দু হাত দিয়ে শক্ত করে বাবাকে চেপে ধরে। বাবা সংকটের মুহূর্তে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পরে নিজেই নিজের পুত্রের হাতে জোরে কামড় বসিয়ে দেন। পুত্র হাত ছেড়ে দিয়ে জলের স্রোতে ভেসে যায়। আর তাকে কখনোই পাওয়া যায়নি। পরে বাবা বেঁচে গেলেও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। সংকটে নিজেকে বাঁচালেই যে বেঁচে গেলেন তা ঠিক নয়। চলুন এধরণের সংকটকে মতবাদগুলো কী ব্যখা করছে তা জেনে আসি।
এ বিষয়ে উপযোগিতাবাদ (Utilitarianism) কী বলে! উপযোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, উত্তরটি সহজ: দশটি জীবন বাঁচানো সবচেয়ে সামাজিক উপযোগিতা তৈরি করবে, এবং সেজন্য – উপযোগিতাবাদ অনুসারে – একজনকে হত্যা করা নৈতিক। ইংরেজ দার্শনিক জেরেমি বেন্থামকে আধুনিক উপযোগবাদের জনক ধরা হয়। তিনি এটাকে মৌলিক স্বতঃসিদ্ধ সত্য বলেছেন। তার মতে, এটা হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট সংখ্যার সর্বোৎকৃষ্ট সুখ যেটা হচ্ছে সঠিক অথবা ভুলের পরিমাপদণ্ড। তার শিষ্য জন স্টুয়ার্ট মিলও একই চিন্তা ধারণ করেছেন। তিনি গ্রেটার গুড দর্শন দিয়ে গেছেন। বেশির ভাগ মানুষ যাতে সুখ পায় ভালো থাকে সেটাই নৈতিকতা। এর অর্থ সাধুকে হিমালয়ের ঢালে ফেলে রাখা বা লাইফ বোট থেকে একজন মৃত্যূভয়ে কম্পমান মানুষকে ধরে সাগরে ছুড়ে ফেলে দেয়া। তবে এর পরিণতি যে কী হতে পারে তার প্রমাণ আমি নিজে! একজন বৃদ্ধ মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে আমারই তো সাক্ষাত হয়েছিল। বেনথেম বা জন স্টুয়ার্ট মিল সম্ভবত এমন লোকের দেখা পাননি। আমেরিকা এই গ্রেটার গুড নীতিতে চলছে। নিজেদের ভালো থাকার জন্য অন্যকে ধ্বংস করতে দ্বিধা করছেনা। তাদের নীতি হলো-বেশিরভাগ ভালো থাকতে গেলে অন্যকে হত্যা করা বৈধ। এজন্য তারা বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে।
নীতি শাস্ত্র (Deontology) কী বলে! জাহাজডুবির উদাহরণে কাউকে হত্যা করাকে সমর্থন করা সম্ভব নয়। কারণ সার্বজনীন নীতি হল: হত্যা করবেন না। হত্যা করা যায়না। অতএব, পরিণতি যাই হোক না কেন, নৈতিকভাবে সঠিক উত্তর হবে লাইফ বোটে কাউকে হত্যা না করা। দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট এ মতবাদ ধারণ করেন। কান্ট বিশ্বাস করতেন যে নৈতিক কাজ সার্বজনীন নৈতিক আইন অনুসরণ করে, যেমন "মিথ্যা বলবে না। চুরি করো না। প্রতারণা করো না।"
পূণ্য নীতিশাস্ত্র (Virtue ethic) বলে ভিন্ন কথা। নিজেকে প্রশ্ন করা দরকার। আমার কী করা উচিত? নিজের আত্মা বলবে আমাকে পূণ্যবান হওয়া দরকার। একজন পূণ্যবান যেটা বলবেন সেটাই নৈতিকতা। তবে জন স্টুয়ার্ট মিল ব্যাখ্যা করেন, "যখন আমি জিজ্ঞাসা করি, আমার কী করা উচিত, তখন পূণ্য নীতিশাস্ত্র আমাকে বলে যে আমার পূণ্যবান হওয়া উচিত। এটি কোনো সাহায্য নয় যদি না আমি জানি যে কোনটি পূণ্য এবং কোনটি আমার পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করতে হবে। আমি কিভাবে এই সাহায্য পেতে পারি? আমাকে বলা হয়েছে যে একজন পূণ্য ব্যক্তি আমাকে উপদেশ দিতে সক্ষম হবেন। কিন্তু আমি যদি কোনো পূণ্যবান ব্যক্তিকে না চিনি? ব্যাপারটা তিনি গোলেমেলে করে দিয়েছেন। তবে ঘুষ দুর্নীতি করার ক্ষেত্রে কখনোই নিজের আত্মা বা পূণ্যবান কেউ বলবেনা- এটা সঠিক। এ ধরণের পূণ্যবান মানুষ পাওয়া কঠিন নয়।
চার.
সবশেষে একটি উদাহরণ দিয়ে লেখায় ইতি টানবো। নীতিশাস্ত্র ও পূণ্য নীতিশাস্ত্রের মধ্যে পার্থক্য কী! ধরুন, একটি শিশু গভীর সমুদ্রে পড়ে যায়। একজন ব্যক্তি উচ্চ ঢেউয়ের বিপদ উপেক্ষা করে তাকে বাঁচাতে লাফ দেয়। অন্য ব্যক্তি লাফ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ এতে তার মারা যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ডিওন্টোলজিস্ট বা নীতিশাস্ত্রবিদ এবং পূণ্য নীতিবিদ উভয়ই নৈতিকভাবে সঠিক কাজ করার জন্য প্রথম ব্যক্তির প্রশংসা করবেন। উপরন্তু তাকে সাহসী হিসাবেও দেখা হবে। যাই হোক, দ্বিতীয় ব্যক্তির অবস্থান অবশ্যই ভুল। সে শুধু পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছিল। সেটা ছিল তার কাপুরুষতা। এটি তার পূণ্যের দাবিকে দুর্বল করে।
অনুরূপ পরিস্থিতিতে, ধরুন শিশুটি বিল গেটসের সন্তান। তাকে রক্ষা করলে এক মিলিয়ন ডলার পুরস্কার পাওয়া যাবে। তাহলে আমরা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি যে দ্বিতীয় ব্যক্তি সম্ভবত সেই শিশু সন্তানকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। কারণ পুরস্কারটি ঝুঁকির চেয়ে অনেক বেশি। ডিওন্টোলজিস্ট বা নীতিশাস্ত্রের বইতে, তিনি একা এই কাজের মাধ্যমে পূণ্যের কাজটি করেন। বিপরীতে, একজন পূণ্য নীতিবিদ বলবেন যে তিনি একজন পূণ্যবান বা সৎ ব্যক্তি তা নির্ধারণ করার জন্য একটি কাজই যথেষ্ট নয়। মোটকথা, তিনি পুরস্কারের লোভে সমূদ্রে ঝাঁপ দিলেও তার ভিতরে কাপুরুষতা বাস করে।
তাহলে বিষয়টা কী দাড়ালো! আইন কানুন আছে বলে কেউ ঘুষ খায়না। তিনি নীতিবান হতে পারেন। এরপরেও একটি ধাপ থেকে যায়। কারণ তিনি পুরস্কারের লোভে বা সবাই ভালো বলবে সেজন্য সৎ হয়েছেন। এরপরেও একটি উচ্চ ধাপ রয়েছে। সেটি হলো- ভার্চু এথিকস। আইন নয়, নিজেকে জিজ্ঞাসা করা- এটা সঠিক কীনা! আমার সাথে এটা যায় কী না? নিজের কাছে বাঁচতে হয়। আর এই বাঁচাটাই এই নশ্বর জীবনে সর্বোত্তম।
পছন্দটা আপনার হাতে।
২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
সার্কিট হাউজ, খুলনা।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৯