somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একিলিস–কচ্ছপ এবং আলেফ–নাল

২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১০ বিকাল ৫:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


থেসালি
থেসালি নগরীর উপকণ্ঠে, ঈজিয়ান সাগরের তীরে একদা রোদ পোহাচ্ছিল একিলিস। মনটা বেশ ফুরফুরে তার, টানা সপ্তম বারের মতো অলিম্পিক দৌঁড়ে জিতেছে কিছুদিন আগে, জলপাই পাতার মুকুটটি তরতাজা এখনও। ঠোঁটের কোনে তার প্রাচীন গ্রিক সঙ্গীতের গুনগুন, মাঝেমাঝে সে নেড়েচেড়ে দেখছে জলপাতার মুকুট। এমন সময় পণ্ডিত চেহারার এক কচ্ছপ এসে হাজির হল তার কাছে।

"কী চাস?" অবজ্ঞাভরে তাকায় একিলিস। মেজাজ খানিকটা চড়ে উঠে তার, কচ্ছপ ব্যাটা রোদটা একেবারে আড়াল করে ফেলেছে।
"তোমাকে নাকি সবাই ক্ষীপ্র পায়ের একিলিস, Achilles of the nimble feet, বলে?"
"তো?" চোখের ভ্রু'র পেশীগুলি নড়েচড়ে উঠে একিলিসের।
"তারা ভুল বলে," কচ্ছপের ঠোঁটে দুষ্টু হাসি। "আমি তোমাকে দৌড়ে হারিয়ে দিতে পারি।"
"তাই নাকি?" মেজাজ বেশিই খারাপ হ্য় একিলিসের। ইচ্ছা করে বেয়াদব কচ্ছপটির গালে একটি চড় লাগিয়ে দিতে।
"হ্যাঁ, যদি তুমি আমাকে একটু আগে থেকে শুরু করতে দাও আর কি।"
"কতটুকু চাস?"
"এই, ধরো, ১০ হাত।"
"তোকে আমি এক নগর আগে থেকে দিতে পারি।"
"না না, কী বলো! অতটা লাগবে না।" বিনয় ঝরে পরে কচ্ছপের চেহারায়। "১০ হাতই যথেষ্ট আমার জন্য।"
"চল তাহলে, শুরু করি।"

"আচ্ছা একিলিস, তোমার তো, যতদূর জানি, বুদ্ধিশুদ্ধি ভালোই আছে, আর গণিতও তুমি জানো মোটামুটি" গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে পড়ে গেছে, এমন ভাব করে কচ্ছপ বলে। "খামোখা আমরা না দৌঁড়ে, যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করে দিচ্ছি যে তোমাকে আমি হারাতে পারি। ঠিক আছে?" কচ্ছপের স্বরে একটু খোঁচা মনে হলো।
"আচ্ছা, দেখা।" রেগে যায় একিলিস।
"ধরো, তুমি আমাকে ১০ হাত অগ্রযাত্রা দিলে। তুমি কি বলবে যে আমাদের মাঝের এই ১০ হাত তুমি খুব তাড়াতাড়ি অতিক্রম করে ফেলবে?"
"অবশ্যই, খুব দ্রুত।" একিলিসের ঝটপট জবাব।
"এবং এই সময়ে, তোমার কী মনে হয়, আমি কতটুকু এগিয়ে যাব?"
"হয়তো ১ হাত, তার বেশী নয়।" এক মুহূর্ত চিন্তা করে বলে একিলিস।
"খুব ভালো," উত্তর দেয় কচ্ছপ। "অতএব আমাদের মাঝে এখন ১ হাত দুরত্ব। আর এই ১ হাত তুমি খুব দ্রুত অতিক্রম করে ফেলবে, তাই না?"
"আসলেই খুব দ্রুত অতিক্রম করে ফেলব।"

"তা সত্ত্বেও, এ সময়ে আমি তো আর বসে থাকব না, আরো একটু এগিয়ে যাব। আর এর ফলে তোমাকে ঐ নতুন দূরত্বটুকুও যেতে হবে, তাই না?"
"হ্যাঁ," একটু আস্তে আস্তে বলে একিলিস।
"এবং তুমি যখন আমাকে ধরতে আসছ, তখন আমি আরো একটু এগিয়ে যাব, আর এর ফলে প্রতিবার আমাকে নতুন জায়্গায় ধরার চেষ্টা করবে।" ক্চ্ছ্প মসৃণভাবে বলে। একিলিস চুপ।

"তাহলে তুমি দেখো, প্রতি মুহূর্তে তোমাকে আমাদের মাঝের দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে, এবং সে সময়ে আমিও তোমার জন্য নতুন দূরত্ব যোগ করতেই থাকব। প্রক্রিয়াটির পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে, কখনো শেষ হবে না, যাকে বলে একেবারে অসীমসংখ্যক (infinity) বার। দূরত্ব, তা যতই ছোট হোক না কেন, সে দূরত্ব তোমার সামনে থেকেই যাবে।" দাঁত বের করে হাসে কচ্ছপ।
"তাই তো দেখি।" আমতা আমতা করে একিলিস।
"আর তাই তুমি কখনো আমাকে ধরতে পারবে না," সহানুভূতির স্বরে বলে কচ্ছ্প।
ক্ষীপ্র পায়ের একিলিস, অলিম্পিকের মাঠে জিউসের হাত থেকে জলপাই পাতার মুকুটগ্রহণকারী একিলিস, ভেঙে পড়ে একেবারে। ঈজিয়ানের মর্মর ধ্বনি ছাড়া কয়েক মুহূর্ত আর কোনো শব্দ শোনা যায় না।

লম্বা গলা বাড়িয়ে একিলিসের পিঠ স্পর্শ করে কচ্ছপ, সমবেদনার স্বরে বলে, "বুঝলে, একিলিস, হাঁটুর বুদ্ধির চেয়ে মাথার বুদ্ধি বেশি কাজের জিনিস। তবে হতাশ হয়ো না, একজনের ঠিকানা দিচ্ছি তোমাকে। এঁর কাছে যাও, অসীম-এর ব্যাপারে ভালো কিছু বিদ্যাশিক্ষা হবে তোমার, আশা করি।
ঝিনুকের খোলে গোটা গোটা করে ঠিকানা লিখে কচ্ছপ: জেনো, এলিয়া নগর। ঠিকানা পেয়েই এলিয়া'র উদ্দেশ্যে দৌঁড় শুরু করে একিলিস।

এথেন্স
আনাতোলিয়া (Turkey) ভূখণ্ডের আয়োনিয়ান গ্রিকরা পারস্যরাজের তাড়া খেয়ে দশ বছর ঘুরে বেড়ায় ঈজিয়ান সাগরে, তারপর একদিন বসত গেড়ে এই এলিয়া নগরে। ধীরে ধীরে বেড়ে উঠে এলিয়ার প্রাণচাঞ্চল্য, গড়ে উঠে সক্রেটিসপূর্ব যুগের দর্শনের শক্তিশালী এক ধারা, এলিয়াটিক স্কুল। এলিয়াটিকরা বিশ্বাস করত, "জগতে সবকিছুই আসলে এক, কিন্তু মানুষের ইন্দ্রিয় জগতের ব্যাপারে ভ্রান্ত ধারণা দেয়। গভীর চিন্তাভাবনার মাধ্যমেই কেবল ইন্দ্রিয়ের ভ্রান্তি এড়িয়ে মানুষ পেতে পারে পরম সত্যের সন্ধান।" পারমেনাইদেস (Parmenides) প্রতিষ্ঠা করেন দর্শনের এ ধারাটি, জেনো (Zeno) তার সুযোগ্য শিষ্য ও প্রচারক।

এলিয়া নগরে এসে একিলিস শুনতে পায় এক মাস পূর্বেই এথেন্স চলে গেছেন জেনো; সাথেসাথেই ফিরতি পথে এথেন্সের রাস্তা ধরে সে। আগে জানলে অবশ্য অনেকটা পথ কমে যেত, কিন্তু জীবনে এই প্রথম বার একিলিস জানার রোমাঞ্চকর আনন্দ অনুভব করতে লাগল।

অ্যাগোরায় বিতর্ক ভাষণ শেষে তার চত্বরে আগুনের কুণ্ডলী জ্বালিয়ে খোলা আকাশের নিচে বসে আছেন জেনো, বৃদ্ধ গুরু পারমেনাইদেস ঘুমিয়ে পড়েছেন অনেক ক্ষণ। এথেন্সবাসীদের সাথে দীর্ঘ আলোচনায় ক্লান্ত আনন্দময় কেটেছে সারা দিন। এথেন্সের সক্রেটিস ছেলেটি জেনোর মন কেড়েছে বেশ—তীক্ষ্ণধী, কালে কালে বড় এক নৈয়ায়িক (ন্যায়শাস্ত্র বা dialectic-এ পারদর্শী) হবে নিশ্চিত।

হঠাৎ পায়ের শব্দে পিছন ফিরে তাকান জেনো।
"কে, কে ওখানে?"
"আমি, একিলিস।" নম্র স্বরে বলে একিলিস।
"থেটিসপুত্র একিলিস, তুমি এখানে!" অবাক হন জেনো।
"আমি আপনার কাছেই এসেছি, জনাব।" ধীরে ধীরে সব ঘটনা খুলে বলে একিলিস।
"হা হা হা," অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন জেনো। লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে উঠে একিলিস।
"কচ্ছপ ঠিকই বলেছে," জেনো দৃঢ়ভাবে বলেন। "আসলে কচ্ছপের সাথে প্রতিযোগিতা কেন, তুমি নিজে একা একা দৌঁড়েও কখনো কোনো মাঠ পেরুতে পারবে না।"
"এ আপনি কী বলেন, জেনো! পরপর সাত বার অলিম্পিক দৌঁড়ে পদক জিতলাম আমি, দেবরাজ জিউস স্বয়ং পুরস্কৃত করেন আমাকে।" একিলিসের স্বরে সুস্পষ্ট অভিমান।

"ঠিক আছে, প্রমাণ দিচ্ছি আমার কথার। ধরো, একটি মাঠ অতিক্রম করতে চাও তুমি। মাঠের এক মাথা থেকে যাত্রা শুরু করলে এবং মাঠের অর্ধেক, অর্থাৎ ১/২ অংশ অতিক্রম করলে। তোমার সামনে আর কতটুকু পথ রইল?" জেনো শুরু করেন।
"মাঠের ১/২ অংশ বাকি থাকবে আর," উদ্বিগ্নতার সাথে জবাব দেয় একিলিস।
"বাকি অর্ধেকেরও অর্ধেক অতিক্রম করলে তুমি, এবার তাহলে কতটা পথ রইল?"
"মাঠের ১/৪ অংশ।"
"চমৎকার," একিলিসের হিসেব করার ক্ষমতাকে প্রশংসা করেন জেনো। "এখন এই ১/৪ অংশেরও অর্ধেক যদি অতিক্রম করে ফেলো, কত থাকে বাকি?"
"পথের আর ১/৮ ভাগ বাকি থাকবে।"

"ঠিক বলেছ। এভাবে পরের ধাপে তোমার সামনে বাকি থাকছে মাঠের ১/১৬ অংশ; এরপর ১/৩২, ১/৬৪, ১/১২৮, ..., এরূপ অংশ বাকি থাকছে তো থাকছেই। তাই না?"
"হ্যাঁ," ক্ষীণ স্বরে বলে একিলিস।
"অতএব দেখতেই পাচ্ছ, অবশিষ্ট অংশটি কখনো একেবারে শেষ হয়ে যাচ্ছে না, ক্রমাগত ছোট হচ্ছে কেবল, আর চলবে তা অনন্তকাল ধরে। ১/১২৮ বলো, ১/২৫৬ বলো, ১/৫১২ বলো, এভাবে যত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশই পাও না কেন, কখনো তা শূন্য হবে না!" রহস্যময় নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বলেন জেনো, রাতের ধূসর আকাশে অনন্ত নক্ষত্রবীচির ফাঁকে তার দৃষ্টি আবদ্ধ।

"হিসেব বা যুক্তির মারপ্যাঁচ যা-ই বলি, এ তো সত্য নয়, মহান জেনো!" একিলিস প্রতিবাদ করে মৃদু। "আপনার খোঁজে গত দু'মাস, বলা যায় একটানাই দৌঁড়েছি আমি। দৌঁড়ে যদি কোনো মাঠই পার হতে না পারি, তাহলে থেসালি থেকে এলিয়া, এলিয়া থেকে এথেন্স কীভাবে আসলাম আমি?"
মৃদু হাসেন জেনো। বয়স্করা বাচ্চাদেরকে প্রবোধ দেন যেভাবে, সেভাবে বলেন, "হে থেটিস-পুত্র, পঞ্চ ইন্দ্রিয় মানুষের চারপাশে নিরন্তর ভ্রান্তির জাল বিছিয়ে রাখে, ফলে মানুষ যা দেখে ভুল দেখে। জিতেন্দ্রিয় মানুষই কেবল সন্ধান পায় পরম সত্যের। পৃথিবীতে গতি (motion) বলে কিছুই নেই, সবই স্থির— গতি, সে তো মায়া, সে তো বিভ্রম (illusion)!" উদাস হয়ে উঠেন জেনো।
একিলিসের চোখে তখনও সন্দেহের দোলাচল। জেনো বলেন, "আরেকটি উদাহরণ দিচ্ছি। তোমার হাতের বর্শাটি ছুঁড়ে মার ঐ ঝোঁপে।" বর্শা নিক্ষেপ করে একিলিস।

"তুমি কি বলবে বর্শাটি গতিময় ছিল, একিলিস?" প্রশ্ন করেন জেনো।
"হ্যাঁ। তা না হলে ওখানে কীভাবে গেল?"
"বর্শা ছুঁড়ে দেয়ার পর কোনো একটি মুহূর্তের (instant) কথা চিন্তা করো। ঐ মুহূর্তে বর্শাটি চলমান থাকতে পারে না, কারণ মুহূর্তের কোনো সময়কাল (duration) নেই, অর্থাৎ একটি মুহূর্ত শূন্য সময়কালের (zero duration) একটি ব্যাপার। কাজেই বর্শাটি যদি সে মুহূর্তে গতিশীল থাকে, তার মানে হবে, শূন্য সময়কালে [অর্থাৎ আসলে একই সময়ে] দু'টি ভিন্ন জায়গায় অবস্থান করছে সেটি—এ তো অসম্ভব! এভাবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অসীমসংখ্যক মুহূর্তের কথা চিন্তা কর, দেখবে কোনো মুহূর্তেই বর্শাটি গতিশীল থাকতে পারে না।" মুচকি হাসেন জেনো।

অসীমকে জানতে গিয়ে বরং আরো জটিল ধাঁধায় পড়ে গেল একিলিস, অনেকক্ষণ কথা জোগায় না তার মনে। একসময় সাহস সঞ্চয় করে একিলিস বলে, "অনন্ত অসীমের ব্যাপারে জানতে এসেছিলাম আপনার কাছে।"
"এ-ই তো অনন্ত অসীম, হে পেলেউসপুত্র। জীবনে চলার পথে যেকোনো কাজ করতে গেলে, অর্ধেক অর্ধেক করে অসীমসংখ্যক বার একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছ তুমি। অসীম সংখ্যকবার কোনো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছ তুমি, ফলে তা সমাপ্ত হচ্ছে না কখনো।"

ঢাকা
"কিন্তু জেনোর যুক্তিতে সমস্যা কোথায়, বাবা?" সারাকা প্রশ্ন করে আমাকে।
"একিলিসের একা একা মাঠ পেরুনোর ধাঁধাঁটির কথা চিন্তা করো। ধরো, মাঠের প্রথম ১/২ পেরুতে একিলিসের সময় লাগল ১/২ মিনিট, তাহলে বাকি অর্ধেকের অর্ধেক, অর্থাৎ সম্পূর্ণ মাঠের ১/৪ অংশ, পেরুতে একিলিসের কত সময় লাগবে?"
"যদি গতিবেগ একই থাকে, তাহলে অর্ধেক পথে অর্ধেক সময়। তার মানে বাকি ১/৪ পেরুতে একিলিসের সময় লাগবে ১/৪ মিনিট।"
"ঠিক বলেছ। এবং এরপর বাকি ১/৮ অংশ পেরুতে তার সময় লাগবে ১/৮ মিনিট, তাই তো?"
"কিন্তু এখানেও সমস্যা কোথায়, বাবা? পথ যেমন ছোট হচ্ছে, সময়ও তেমনি ছোট হচ্ছে, কিন্তু বাকি পথ যেহেতু নিঃশেষ হচ্ছে না, সময়ও তো শেষ হচ্ছে না।"

"জেনো'র যুক্তি চিন্তায় ভুল নেই। কিন্তু বাস্তব জগতে স্থান (space) বা সময়কে (time) তুমি এভাবে ক্রমাগত ভাগ করে যেতে পার না। বাস্তব জগতে তুমি হয়তো অত্যন্ত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র (infinitesimal) দৈর্ঘ্যের একটি স্থান পাবে, কিন্তু তার চেয়ে ক্ষুদ্রতর আর কোনো স্থান জগতে নেই।" আমি বলতে থাকি।
"কল্পনা করো, পৃথিবীতে বালখিল্য নামে অত্যন্ত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি প্রাণী আছে আর প্রাণীটি তার স্বাভাবিক একটি পদক্ষেপে ঐ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দৈর্ঘ্যটি, যার নাম আমরা দিলাম এক বালখিল্য দূরত্ব, অতিক্রম করতে পারে। এখন বালখিল্য তার পরবর্তী পদক্ষেপে চাইলেও কিন্তু ঐ দৈর্ঘ্যের অর্ধেক অতিক্রম করতে পারবে না, তাকে কমপক্ষে উক্ত দৈর্ঘ্যের সমান অতিক্রম করতে হবে। সে অবশ্য ইচ্ছে করলে পরবর্তী পদক্ষেপে লাফিয়ে হয়তো আগের দ্বিগুণ তিনগুণ দূরত্ব চলে যেতে পারবে।

জেনো স্থান'কে অর্ধেক অর্ধেক করে অসীম সংখ্যক ক্রমাগত ছোট ছোট পদক্ষেপে চিন্তা করেছিলেন; তারপর ভেবেছিলেন অসীম সংখ্যক পদক্ষেপের জন্য অসীম সময় লাগবে। কিন্তু যেহেতু সর্বনিম্ন দৈর্ঘ্যের একটি পদক্ষেপের চেয়ে আর ছোট কোনো পদক্ষেপ দেয়া যায় না, কাজেই জেনো চাইলেও অসীমসংখ্যক পদক্ষেপ বাস্তব জীবনে কারো পক্ষে সম্ভব নয়, তা জিনিসটি যত ক্ষুদ্রই হোক।

কাজেই কেউ যদি ভাবে স্থান অসীমসংখ্যকভাবে বিভাজ্য (infinitely divisible), তাহলে ভুল হবে। বরং স্থানকে ভাবতে হবে আমাদের এই বালখিল্যদের পদক্ষেপের মতো। অর্থাৎ ভাবতে হবে একিলিস ও কচ্ছপের সামনে অসীম নয়, হয়তো ১ লাখ বালখিল্য পদক্ষেপ আছে, প্রতিবারে যার একটি বা একাধিক অতিক্রম করতে হবে, একিলিস এবং কচ্ছপ উভয়কে।

এমনি ভাবে সময়েরও সর্বনিম্ন একটি কাল (duration) আছে, যার চেয়ে ছোট কাল বাস্তব জগতে সম্ভব নয়। তার মানে সময় আসলে নদীর স্রোতের মতো ক্রমাগত বয়ে যায় না, বরং থেমে থেমে লাফ দিয়ে দিয়ে বাড়ে।
"অদ্ভুত তো!" সারাকা বলে।

"সর্বনিম্ন সময়কে ধরা যাক এক বালখিল্য কাল," আমি চালিয়ে যাই আলোচনা।
"এখন বালখিল্যরা ১ বালখিল্য কালে দেয় ১ বালখিল্য পদক্ষেপ।
বিভিন্ন প্রাণী বা বস্তুর গতির ভিন্নতার কারণে, একিলিস ১ বালখিল্য কালে দিয়ে ফেলবে হয়তো ১,০০০ বালখিল্য পদক্ষেপ, কচ্ছপটি হয়তো দিবে মাত্র ১০০ বালখিল্য পদক্ষেপ। সুতরাং প্রতি বালখিল্য কাল পর একিলিস ও কচ্ছপের মধ্যে দূরত্ব কমে যাবে ৯০০ বালখিল্য পদক্ষেপ। কাজেই ১ লাখ বালখিল্য পদক্ষেপ অতিক্রম করতে বেশি সময় লাগবে না একিলিসের।"
"কিন্তু, বাবা, ৯০০ দিয়ে ১ লাখকে কি পূর্ণসংখ্যায় ভাগ করা যায়?"
মেয়ের প্রশ্নের তাৎপর্য ও গভীরতা মুগ্ধ করে আমাকে। "ঠিক ধরেছ, এখানে নিঃশেষে বিভাজ্য হচ্ছে না। এক বালখিল্য দূরত্ব পরপর একটি করে বিন্দু চিন্তা কর। সুতরাং একিলিস প্রতি বার যাচ্ছে ১০০০ বালখিল্য বিন্দু, কচ্ছপ যাচ্ছে ১০০ বালখিল্য বিন্দু। তার মানে একিলিস কচ্ছপের ফেলে আসা সব বিন্দুর উপর দিয়ে যাচ্ছে না। এক সময় একিলিস কচ্ছপের খুব কাছে, পেছনে চলে আসবে, পরবর্তী বালখিল্যকালে সে কচ্ছপের বিন্দু না মাড়িয়ে তার উপর দিয়ে হঠাৎ সামনের বিন্দুতে চলে এসে কচ্ছপকে অতিক্রম করে ফেলবে।"

"দুনিয়া কত অদ্ভুত!" চিন্তামগ্ন হয় সারাকা। একটু পর প্রশ্ন করে, "কিন্তু বাবা, এরকম বালখিল্য কাল বা বালখিল্য দূরত্ব কী আসলেই আছে জগতে?"
"হ্যাঁ, মামনি। বিজ্ঞানীরা একে বলেন, প্ল্যাঙ্কের সময় (Planck time), প্ল্যাঙ্কের দূরত্ব (Planck length); তাদের মতে যার চেয়ে ছোট কোনোকিছু কোনো অর্থ বহন করে না।
"কিন্তু এদের চেয়েও ছোট দূরত্ব বা সময় তো আমরা তারপরও কল্পনা করতে পারি।"
"হ্যাঁ, মা। ফলে জেনো'র ধাঁধাঁটি মানুষকে ভাবাবে যুগযুগ। তবে সে কল্পনা যেন তোমাকে জগতের গূঢ় রহস্য উদঘাটনে ধাবিত করে, জগতের প্রতি ভালোবাসা সহমর্মিতা সৃষ্টি করে।"

কিছুক্ষণ চিন্তামগ্ন হয়ে কথাটি মনে গেঁথে নেয় সারাকা। তারপর বলে, "জগতের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জিনিসের কথা জানলাম, বাবা। এবার সবচেয়ে বড় জিনিসের কথা বলো। সে জিনিসটি কি অসীম?"
"আচ্ছা, বলো তো জগতে জোড় সংখ্যা বেশি, না বিজোড় সংখ্যা বেশি?" আমি পালটা প্রশ্ন করি।
জোড় মানে ০, ২, ৪, ৬, ..., যার কোনো শেষ নেই, অসীম; বিজোড় মানে ১, ৩, ৫, ৭, ..., এরও শেষ নেই, এ-ও অসীম।" ভাবে সারাকা। তারপর বলে, "দুটোই সমান, বাবা।"
'হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। এবার বলো তো, {১, ২, ৩, ... ... অসীম পর্যন্ত} এখানে বেশি পদ আছে, নাকি {১০১, ১০২, ১০৩, ... ... অসীম পর্যন্ত} এখানে বেশি পদ আছে?"

খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলে, "এ তো বোঝাই যাচ্ছে, প্রথমটিতে পদের সংখ্যা দ্বিতীয়টির চেয়ে ১০০ বেশি।"
মিটিমিটি হাসি আমি, "গণিতবিদগণ এখন বলেন, দুটোতেই পদের সংখ্যা সমান।"
"মজার ব্যাপার তো! তার মানে দুটো জিনিস অসীম মানেই হচ্ছে তারা সমান?" সারাকা সিদ্ধান্তে আসতে চায়।
"না, অসীম নিয়ে গণিতে যুগান্তকারী কাজ করা গণিতবিদ ক্যান্টর বলেন, জগতে অসীমের মধ্যেও ছোট বড় আছে!"
"অদ্ভুত, অদ্ভুত!" সারাকা জানতে চায় আরো। কিন্তু জরুরি একটি কাজে বেরুতে হবে দেখে আপাতত আলোচনার সমাপ্তি টানতে হলো।
_________________________
* একিলিস পৌরাণিক, জেনো ঐতিহাসিক, সুতরাং তাদের সাক্ষাতকারটি কাল্পনিক।
* জেনোর সময়ে গ্রিসে গাণিতিক সংখ্যা শূন্যের ধারণা ছিল না। তাঁর শূন্য ছিল "কিছুই না" "শেষ হয়ে গেছে" এ ধরণের। এ ছাড়া জেনো মূলতঃ
দার্শনিক ছিলেন।
* বালখিল্য প্রাণীটি একিলিস বা কচ্ছপের চেয়ে দ্রুত গতির হলেও, জেনো'র ধাঁধাঁর বাস্তব সমাধানে সমস্যা নেই, তার মূল কারণ স্থান বা সময় অসীম বিভাজ্য নয়। সুতরাং একিলিস ও কচ্ছপকে বালখিল্যবিন্দু ধরে ধরেই যেতে হবে, এবং যেকোনো সময়কালে একিলিস কচ্ছপের চেয়ে বেশি বিন্দু অতিক্রম করবে।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা এপ্রিল, ২০১১ দুপুর ১২:৪৯
৯৪টি মন্তব্য ৯৪টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্যবহারে বংশের পরিচয় নয় ব্যক্তিক পরিচয়।

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৫

১ম ধাপঃ

দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে কত মানুষের সাথে দেখা হয়। মানুষের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য আসলেই লুকিয়ে রাখে। এভাবেই চলাফেরা করে। মানুষের আভিজাত্য বৈশিষ্ট্য তার বৈশিষ্ট্য। সময়ের সাথে সাথে কেউ কেউ সম্পূর্ণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

অধুনা পাল্টে যাওয়া গ্রাম বা মফঃস্বল আর ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া শহুরে মানুষ!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০০


দেশের দ্রব্যমুল্যের বাজারে আগুন। মধ্যবিত্তরা তো বটেই উচ্চবিত্তরা পর্যন্ত বাজারে গিয়ে আয়ের সাথে ব্যায়ের তাল মেলাতে হিমসিম খাচ্ছে- - একদিকে বাইরে সুর্য আগুনে উত্তাপ ছড়াচ্ছে অন্যদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমুল্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

×