শঙ্খচিলের সবটা জুড়ে বাংলা, বাঙ্গালী আর বাংলাদেশ। কিন্তু যে চোখে দেখেছি সে চোখটা আপন মনে হয়নি। যেন অন্য জেলার কেউ আমার এক পড়াশির গল্প বলছে আমার কাছে। যে পড়শির বিষয়ে গল্পকথকের চেয়ে আমি ঢের জানি। বাংলাদেশের মানুষ ও তাদের হাসি কান্না কেমন তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠেছে সীমান্তের ওপার থেকে ভিনদেশী স্বজাতীরা আমাদের নিয়ে কিভাবে ভাবে, কতটা ভাবে, আমাদের ভাবাবেগ গুলো কতখানি মিলে যায় তাদের সাথে। ছবিটি চেতনা, আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গির দিক দিয়ে সম্পূর্ন ভারতীয়, যৌথ নয়। ছবির বিষয় বস্তু আমরা কিন্তু ছবিটা আমাদের নয়, অন্যরা আমাদের নিয়ে কিভাবে ভাবছে এটা টার প্রতিচ্ছবি।
হালকা মাথাব্যাথার পর কেউ যখন মরনব্যাধিতে ভোগে, সে অনায়াসে ভুলে যায় তার আগেকার মাথাব্যাথা। দেশভাগটা আমাদের কাছে মাথাব্যাথা আর মুক্তিযুদ্ধ হলো মরনব্যাধি। দেশভাগ আমাদের ভাবায় না, আমাদের চিন্তা অত দুরে যায় না। আমরা এখনো ধুকছি নানা ব্যাধিতে। ব্যাধিগ্রস্থরা অতীত দুঃখ নিয়ে ভাবার সময় পায় না। তাই শঙ্খচিল আমাদের চেতানার কাছে পৌছেনি।
বাঙালী ভাঙতে ভালোবাসে, শহীদমিনার থেকে মন্দিরের অথর্ব মুতি। সবকিছু ভেঙে বাঙালী পুলকিত বোধ করে। সেই ভাঙ্গাভাঙ্গীর অংশবিশেষ বাঙালী বাংলাদেশ ভেঙ্গেছিল। এরা স্বভাষী মানুষদের সাথে ভাঙ্গাভাঙ্গী করে মরুবাসি চাদতারা মার্কা শুকরদের সাথে পিরিত করে, সহবত করে, বাচ্চা উৎপাদন করে। বাঙালীর আরেক অংশ বাংলার চেয়ে হিন্দি বলতে গাধার মত স্বাছন্দ ও গর্বিত বোধ করে, স্বভাষীদের কাঙলাদেশী মনে করে আর আগ্রসনবাদী স্বদেশী বেজাতীদের পদলোহন করে। আপমর বাঙালী বাহিরে বাহিরে দেশভাগের দুঃখের কথা বললেও এরা জানে দেশভাগ তাদের সুখ দিয়েছে। দেশ যদি ভাগ না হতো হুজুগে বাঙালী দাঙ্গার পর দাঙ্গা বাধিয়ে নিজেদের নিঃশেষ করে ফেলতো। বাঙালীর যে আবেগ ছবিতে ধরা হয়েছে তা কৃত্রিম, দেশভাগ নিয়ে বাঙালীর চিন্তা ভিন্ন।
দেশভাগের পর অনেক জল গড়িয়েছে, দুই বাংলার মানুষের মধ্য সাংস্কৃতিক ও মানসিক ব্যাবধান বেড়ে গেছে মারাত্মকভাবে। সংলাপ রচয়িতা এই ব্যাবধানটা অগ্রাহ্য করে চলচ্চিত্রের শিল্প মানের প্রতি অবিচার করেছেন, যা শুধু মাত্র সদেচ্ছা থাকলে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল। বাংলাদেশের চরিত্রগুলো কথা বলেছে কলকাতার শহুরে ভাষায়, যা চিন্তারও অতীত। অজোপাড়াগায় একুরিয়মের শখ বড্ড বাড়াবাড়ি। রুপসা যে কতখানি স্বাধীনচেতা তার প্রতিকি রুপে একুরিয়ামের মাছ গুলোকে নদীতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। একুরিয়াম বিষয়টা যোগ করা হয়েছে শুধুমাত্র এই কারনে কিন্তু অন্য কোন স্থানীয় উপাদান দিয়ে কি রুপসার প্রতিকি রুপটা তুলে ধরা যেত না? আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে কলকাতায় ভাষা দিবস বলা হয় যা আমরা ভুল করেও কখনো বলিনা। কিন্তু বাংলাদেশের বাদল মাষ্টার অবলিলায় বলে গেল ভাষা দিবস। বাদল মাষ্টার অসুস্থ মেয়েকে দেশে চিকিৎসা না করিয়ে অবৈধ ভাবে সীমান্ত পার হওয়ার পিছনে যে কারন দেখানো হয়ে তা পরিপুষ্ট ছিল না যদিও সেখানে সয়ংসম্পুর্নভাবে পরিপুষ্ট করার মত উপাদান ছিলো। তবে ছবিটিতে বর্তমান ভারত নিয়ে বাংলাদেশের হিন্দু ও মুসলমানের দৃষ্টিভঙ্গি অনন্যরুপে ফুটি উঠেছে। বাংলাদেশের মুসলমানরা ধর্মীয় কারনে ভারতকে ঘ্রিনা করে এবং হিন্দুদের ভারতে চলে যাওয়া উচিত বলে মনে করে। ছবিটির শেষ দিকে স্কুলের হিন্দু হেড মাস্টার কে একজন বলে ” যাওনা কেন ভারত চলে”। এই কথাটি অধিকাংশ বাঙালী মুসলমানের কথা যা আমাদের জন্য বিব্রতকর সত্য। তারচেয়ে বিব্রতকর ছবির শুরুর অংশটি, ঠিক যেন কোন আনাড়ী নির্দেশকের ডকুমেন্টরির প্রাবম্ভ।
ছবিটি বাংলাদেশ ভারত যৈথ প্রযোজনার, চিন্তার ক্ষেত্রে ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গির আধিপত্য থাকেলে সার্বিক বিবেচনায় ও এই যৈথ প্রতারনার সম্রাজ্যকালে এটা সহিহ যৈথ প্রযোজনার উদাহরণ হতে পারে। বলা বাহুল্য ক্যামেরার পেছনে অধিকাংশ কারিগরগন ছিলেন ভারতীয়।
সবার অভিনয় ভালো লেগেছে। কাহিনী সাজানো গোছানো শতভাগ পরিকল্পিত, কোথাও অপেশাদারিত্বে কোন ছোয়া নেই। গল্পের মোড়গুলো শক্ত ও কাহিনী প্রবাহ আড়ষ্ট হয়ে বসে থাকার মত। চিত্রনাট্যকে ভালই বলতে চাই তবে গল্পটা বাংলাদেশকে ঘিরে কথাটা মাথায় থাকলে আরো ভালো হতো। চিত্রধারনে শতভাগ শিল্পের ছোয়া আছে, অনেক খানি সংযত। যে গানগুলো ব্যবহার করা হয়েছে তার মধ্য আবার আসিব ফিরে ব্যাতিত কোন গানের দরকার ছিল না, হয়তবা ব্যাবসার কথা চিন্তা করে গানগুলো রাখা হয়েছে, তবে উপমহাদেশীয় অন্য ছবির মত এই ছবির গানগুলো কাহিনী প্রবাহে বাধা দেয়নি যা ইতিবাচক। ছবিটির কারিগরি দিকে অসামঞ্জস্য নেই বললেও চলে তাই বিশদ বর্ননা অপ্রয়জনীয়।
আমার রেটিং- ০৭/১০
ছবির নাম: শঙ্খচিল
পরিচালক: গৌতম ঘোষ
দেশ: বাংলাদেশ, ভারত
ভাষা: বাংলা
শ্রেষ্টাংশে: প্রসেনজিত, কুসুম সিকদার, সাজবাতি।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মে, ২০১৬ রাত ১১:৫৮