ভিনগ্রহের প্রাণী এলিয়েন নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। কিন্তু এরই মধ্যে নাকি গোপন মার্কিন বিমান ঘাঁটি ‘এরিয়া ৫১’ ঘুরে গেছে এলিয়েনের দল। ঘাঁটিটি থেকে অতি উচ্চতায় অজ্ঞাত উড়ন্ত বস্তু (ইউএফও) উড্ডয়নের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার পরই এলিয়েন নিয়ে নানা গুজব-গুঞ্জন ডালপালা মেলতে শুরু করে। মানচিত্র এমনকি গুগল আর্থেও দেখা মেলে না জায়গাটির। নীল আর্মস্ট্রংয়ের চন্দ্র অভিযানের যে ইতিহাস সবার জানা, সেটাও নাকি পুরোটাই সাজানো। আর এ নাটকের মঞ্চ হিসেবে ব্যবহূত হয় ‘এরিয়া ৫১’
বহুল আলোচিত গোপন মার্কিন বিমান ঘাঁটি এরিয়া ৫১। এখানকার ২৬ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ। দুর্ভেদ্য বেষ্টনীতে ঘেরা ঘাঁটিতে আজ পর্যন্ত বেসামরিক কেউ প্রবেশের দাবি করেনি। যদি কেউ ঢুকেও থাকেন তাহলে তিনি জীবিত আর বের হতে পারেননি বলে ধরে নেয়া যায়। মার্কিন বিমান বাহিনী কী কাজে এ ঘাঁটি ব্যবহার করে এ সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু জানা যায়নি। অতীতের বিভিন্ন নথিপত্র অনুসারে বলা যায়, পরীক্ষামূলকভাবে বিভিন্ন উড়োজাহাজ এবং ভারী অস্ত্র তৈরির কাজ করা হয় এ ঘাঁটি থেকে। ধারণা করা হয়, এ ঘাঁটিতে অজ্ঞাত উড়ন্ত বস্তু (ইউএফও) নিয়ে গবেষণা করা হয়। এখানে মার্কিন বিজ্ঞানীরা ভিনগ্রহের প্রাণী এলিয়েন নিয়ে গবেষণা করেন। অনেকে বিশ্বাস করেন, অজ্ঞাত উড়ন্ত বস্তু ‘ইউএফও’র সাহায্যে এলিয়েনদের সঙ্গে যোগাযোগও করা গেছে। এরিয়া ৫১-কে গুগল আর্থের সাহায্যেও খুঁজে পাওয়া যায় না। মানচিত্রেও ওই অঞ্চল দেখানো হয় না।
আমেরিকার নেভাদা অঙ্গরাজ্যের দক্ষিণাংশে লাস ভেগাস থেকে ১৩৩ কিলোমিটার উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে গ্রুম হ্রদের দক্ষিণ তীরে এরিয়া ৫১-এর অবস্থান। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম এ ঘাঁটির অস্তিত্বের কথা স্বীকার করে সিআইএ। ঠিক কবে থেকে গোপন এ ঘাঁটি এরিয়া ৫১ নামে পরিচিত হতে শুরু করে তা নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্রে জানা যায়নি। এ পর্যন্ত এখানে যত গবেষণাকার্য সম্পন্ন হয়েছে, এর সব কয়টিতে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছে। ঘাঁটি এলাকাটি মার্কিন বিমান বাহিনীর বিস্তৃত পরীক্ষা এবং প্রশিক্ষণ সীমায় অবস্থিত। সামরিক পাইলটরা এখানকার ভিত্তির চারদিকের আকাশসীমাকে বাক্স বলে ডাকেন। ভিত্তিটি যে উচ্চ স্তরের গোপনীয়তা পরিবেষ্টন করে তাই এর ভিতরকার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সন্দেহ পোষণের জন্য যথেষ্ট। ২০০৯ সালে এরিয়া ৫১ থেকে অবসরপ্রাপ্ত কিছু কর্মকর্তা মানুষের কৌতূহল নিবারণের জন্য বলেছিলেন, তারা এমন কিছু করছেন না যা মানবজাতির ক্ষতি করতে পারে। বরং অন্যান্য দেশের তুলনায় নিজেদের প্রযুক্তি উন্নত করার জন্য কাজগুলো কিছুটা গোপনীয়তার সঙ্গে করা হচ্ছে। এখানে সামরিক বিমান, চন্দ্র মডিউল ও এ ধরনের কিছু অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করা হয়। ঘাঁটিতে সাতটি বিমান উড্ডয়ন পথ রয়েছে।
নীল আর্মস্ট্রংয়ের চন্দ্র অভিযানের শুটিং: এরিয়া ৫১ নিয়ে সবচেয়ে বড় বিতর্কের সূত্রপাত মানুষের চাঁদে যাওয়া নিয়ে। ‘একজন মানুষের জন্য ছোট্ট একটি পদক্ষেপ কিন্তু মানব জাতির জন্য অনেক বড় পাওয়া’— ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই এভাবেই নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেন চাঁদে পা রাখা (!) পৃথিবীর প্রথম মানুষ নীল আর্মস্ট্রং। অনেকেই মনে করেন সেদিন চন্দ্র অভিযানের বদলে শুধু একটি নাটকের মঞ্চায়ন করা হয়। আর এ মঞ্চটি হচ্ছে এরিয়া ৫১। মজার বিষয় হচ্ছে, খোদ আমেরিকার ২০ শতাংশ মানুষ নীল আর্মস্ট্রংয়ের চন্দ্র অভিযানের প্রচলিত গল্প বিশ্বাস করে না। অ্যাপোলো রকেট ডিজাইন করা কোম্পানি রকেটডাইনের একজন ইঞ্জিনিয়ার ও পর্যবেক্ষকের নাম বিল কেইসিং। ১৯৭৪ সালে ‘উই নেভার ওয়েন্ট টু দি মুন’ শিরোনামে তার লেখা একটি বই প্রকাশিত হয়। এই বইয়ে তিনি দাবি করেন, অ্যাপোলো মিশন ছিল বড় একটা মিথ্যা। পুরোটাই আইওয়াশ। তিনি বৈজ্ঞানিক নানা তথ্য-উপাত্ত ও যুক্তি তুলে ধরে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন বাস্তবে ওই অভিযানের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। বিল কেইসিং একা নন। তার দলে আছেন ষাটের দশকে নাসায় কর্মরত মহাকাশচারী ও অ্যাপোলো মিশনের সায়েন্টিফিক অ্যাডভাইজার ব্রাইয়ান ওলেরি। তিনি বলেন ‘আমি শতভাগ নিশ্চিত করে বলতে পারছি না যে সত্যিই তারা চাঁদে গিয়েছিল।’
তাহলে এতদিন ধরে মানুষ যা জেনে আসছে তার সবই কি ভুল? উত্তর জানতে আমরা ফিরে যাই চার দশক আগে, যখন আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন পৃথিবীতে একক আধিপত্য বিস্তার করতে চাচ্ছিল। দুই দেশের মধ্যে তখন একটা শীতল যুদ্ধ চলছিল। যুদ্ধজয়ে মরিয়া দুই পক্ষই। তখন এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, যে দেশ মহাকাশে আগে আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে সেই যেন এই শীতল যুদ্ধে জয়ী হবে। ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশে পাঠায় পৃথিবীর প্রথম স্যাটেলাইট ‘স্পুটনিক’। মহাকাশে সোভিয়েতের এমন সাফল্য মানতে পারেনি আমেরিকা। আমেরিকা ধারণা করছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো চাঁদে মিসাইল বেইজ বানানো। বিল কেইসিংয়ের মতে, ওই সময়ের প্রযুক্তিতে মানুষের চাঁদে যাওয়া এবং নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসার সম্ভাবনা দশমিক .০০১৭ শতাংশ। কিন্তু পুরো অ্যাপোলো মিশন যদি মিথ্যা হয় তাহলে আমেরিকা কিভাবে এত বড় মিথ্যা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করল? বিল কেইসিংয়ের মতে, ‘অ্যাপোলো মহাকাশযানগুলো মহাকাশে গিয়েছিল। কিন্তু চাঁদে মানুষ পাঠানো হয়নি। অ্যাপোলো ১১ মহাকাশযানটি ৮ দিন পৃথিবীর কক্ষপথে ঘুরেছিল। এরপর মূল যানটি আলাদা হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসে। আর টিভিতে যেটা দেখানো হয়েছিল সেটা ছিল পূর্বে ধারণ করা।’
অনেকে মজা করে বলেন, অ্যাপোলো মিশন দুনিয়ার সর্বাপেক্ষা বড় বাজেটের মুভি। ১৯৭৭ সালের ২ জুন হলিউডে মুক্তি পায় ‘কেপ্রিকন ১’ নামের একটা মুভি। ৫০ লাখ মার্কিন ডলার বাজেটের মুভিটিতে দেখানো দৃশ্য চাঁদ থেকে মহাকাশচারীদের পাঠানো ভিডিওর সঙ্গে প্রায় পুরোপুরি মিলে যায়। প্রযোজক পল এন ল্যাজারুসের মতে, নাসা ৪০ বিলিয়ন বাজেটের প্রোগ্রাম অ্যাপোলো মিশনে যে ভিডিও দেখিয়েছে, সেটা তারা মাত্র ৪ মিলিয়ন বাজেট নিয়ে করে দেখিয়েছেন এবং এটা করেছেন একটা টিভি স্টুডিওতে। বিল কেইসিংয়ের মতে নাসার অ্যাপোলো মিশনের চিত্রায়ন করা হয়েছিল এরিয়া ৫১-তে। নাসার সরবরাহ করা ফুটেজে দেখা যায়, দুটি বস্তুর ছায়া পরস্পরকে ছেদ করেছে। অথচ আলোর উত্স হওয়ায় তা সমান্তরাল হওয়ার কথা। চাঁদে কোনো বাতাস নেই। কিন্তু ভিডিওতে আমেরিকান পতাকা উড়তে দেখা যায়, যা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এটাও সন্দেহের একটা বড় কারণ। জায়গাটি নিয়ে মার্কিন লুকোচুরির মধ্যেই ওখানকার কিছু ছবি তুলেছে রুশ স্পাই স্যাটেলাইট। এসব ছবিতে দেখা যায় সেখানে মুভি সেট রয়েছে এবং কিছু জায়গা চাঁদের পৃষ্ঠের মতো দেখতে। অনেকে মনে করেন, চাঁদে যাওয়ার ওই শুটিং স্পট এখনও সেখানে আছে।
এক চন্দ্র অভিযানেই শেষ নয়। সেখানে নাকি এলিয়েনদের নিয়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়া এক ফ্লাইং সসার আছে। ওখানে এলিয়েনটির ব্যবচ্ছেদ করে দেখা গেছে ওই প্রাণীটি এসেছে রেটিকুলাম-৪ নামক জ্যোতিষ্ক থেকে। প্রাণীটির উচ্চতা সাড়ে তিন ফুট। শরীর লোমহীন কালো। বড় বড় চোখ। দেহ ব্যবচ্ছেদ করে নাকি ফুসফুস ও হূিপণ্ডের বদলে বিশাল এক পতঙ্গ পাওয়া গেছে।
অস্তিত্বের কথা স্বীকার: গত বছর সিআইএ’র অবমুক্ত করা নথিতে ‘এরিয়া ৫১’-এর অস্তিত্বের কথা স্বীকার করা হয়েছে। তবে সেখানে বলা হয়, বহুল কথিত ‘ভিনগ্রহের’ প্রাণীরা মহাকাশযানের সাহায্যে ‘এরিয়া ৫১’-তে ওঠানামা করত না। বরং ইউ-২ নামের গুপ্তচর বিমানের একটি প্রকল্প পরিচালনায় ব্যবহূত হতো জায়গাটি। স্নায়ুযুদ্ধকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর গোপনে নজরদারি করাই ছিল ওই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। তথ্য অধিকার আইনের আওতায় সিআইএর কাছ থেকে এসব তথ্য পেয়েছে জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয় নিরাপত্তা মহাফেজখানা। ২০১৩ সালের ১৫ আগস্ট প্রকাশ করা ৪০০ পৃষ্ঠার সিআইএর ওই নথিতে বলা হয়, গোপনে গুপ্তচর বিমানের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ১৯৫৫ সালে নেভাদার জনশূন্য মরুভূমিতে ‘এরিয়া ৫১’-এর বর্তমান জায়গাটি বেছে নেয়া হয়। গ্রুম হ্রদবেষ্টিত ওই জায়গাটি বেছে নেয়ার কারণ ছিল, এর কাছেই ছিল পরমাণু পরীক্ষার ক্ষেত্র। সিআইএ বলছে, ‘এরিয়া-৫১’ থেকে পরিচালিত প্রকল্পের গোপনীয়তা বজায় রাখতে ইউ-২ বিমানগুলোকে এমনভাবে তৈরি করা হয়, যাতে ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেক উচ্চতায় উড়তে সক্ষম হয় সেগুলো। আর এই অতি উচ্চতায় ইউ-২ বিমানের চলাচলকে কেন্দ্র করে অজ্ঞাত উড়ন্ত বস্তু (ইউএফও) সম্পর্কিত নানা কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। নথিতে বলা হয়, ‘অতি উচ্চতায় ইউ-২ বিমান ওড়ানোর ফলে দ্রুত একটি অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। ইউএফও সম্পর্কিত নানা খবর মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেতে লাগল।’ অন্য গ্রহের প্রাণীরা ইউএফওতে করে পৃথিবীতে যাতায়াত করে অথবা তারা সেগুলো নানা কারণে পৃথিবীতে পাঠায় এমন কথা প্রচলিত আছে।
গত শতকের পঞ্চাশের দশকে বাণিজ্যিক বিমানগুলো সাধারণত ১০ থেকে ২০ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়ত। বি-৪৭ মডেলের যুদ্ধবিমানগুলো উড়ত ৪০ হাজার ফুট উচ্চতার মধ্যে। সেখানে ইউ-২ বিমানগুলো উড়ত ৬০ হাজার ফুটেরও বেশি উচ্চতায়। ফলে অনেক উচ্চতায় ওড়া এসব বিমানের রূপালী রঙের ডানায় সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে অনেক উজ্জ্বল আলো ছড়াত। কখনও কখনও তা বাণিজ্যিক বিমানের পাইলটদের চোখেও ধরা পড়ত। সাধারণভাবে তখন বিশ্বাস করা হতো, এত উচ্চতায় চালকসহ কোনো বিমানের ওড়া অসম্ভব। এভাবেই ছড়িয়ে পড়ে ভিনগ্রহের প্রাণীদের মহাকাশযানের গুজব! অতি গোপনীয় এ প্রকল্পের কথা যাতে কোনোভাবেই ফাঁস না হয়ে পড়ে, সে কারণে কর্তৃপক্ষও গুজবের ব্যাপারে নীরব থাকে। সিআইএর নথিতে বলা হয়েছে, ‘পঞ্চাশের দশকের শেষে এবং ষাটের দশকজুড়ে ইউএফও সম্পর্কে যত খবর প্রচারিত হয়েছে, তার অর্ধেকেরও বেশি খবরের ভিত্তি ছিল ইউ-২সহ অন্যান্য গোয়েন্দা বিমান।’ ম্যাশএবল, আল জাজিরা, রয়টার্স, গার্ডিয়ান, বিবিসি, এএফপি।
https://www.facebook.com/MesbahPatwaryBd
Click This Link