২৯ হাজার ২৯ ফুট উঁচু বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট। আকাশছোঁয়ার প্রত্যয়ে প্রতিবছর এভারেস্টে ছুটে আসেন বহু রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষ। ১৯৫৩ সালের ২৯ মে নিউজিল্যান্ডের এডমান্ড হিলারি ও নেপালের তেনজিং নরগে প্রথম মানুষ হিসেবে এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করেন
মাঝে মাঝে আকাশ ছুঁতে ইচ্ছা করে। ভুলে যাই আকাশটা ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাতে কি? একটু সাহস করে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৯ হাজার ২৯ ফুট উঁচু মাউন্ট এভারেস্ট ছুঁয়ে ফেললেই তো হয়। পৃথিবীর সর্বোচ্চ এ শৃঙ্গটির অবস্থান হিমালয় পর্বতমালায়। আকাশ ছোঁয়ার প্রত্যয়ে প্রতিবছর এভারেস্টে ছুটে আসেন বহু পর্বতারোহী। দুনিয়ার সর্বোচ্চ বিন্দুতে সফলভাবে আরোহণের জন্য পেশাদার পর্বত পথ-প্রদর্শকদের পিছনে দেদার খরচ করতে দ্বিধাবোধ করে না সাহসী আর রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষ। উচ্চতা, প্রতিকূল আবহাওয়া, বাতাস ইত্যাদি কারণে এখানে আরোহণ বেশ বিপজ্জনক।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২০টি দেশের ৩ হাজার ১০০ জন পর্বতারোহী সর্বমোট ৫ হাজার ১০০ বার এভারেস্ট জয় করেন। নেপালের জাতীয় আয়ের একটা বড় অংশজুড়ে রয়েছে পর্যটন খাত। আর এই পর্যটনের মেরুদণ্ড বলা যায় হিমালয় তথা মাউন্ট এভারেস্টকে। এভারেস্টে আরোহণে ইচ্ছুক প্রত্যেক পর্বতারোহীকে নেপাল সরকারের কাছ থেকে ২৫ হাজার মার্কিন ডলারের বিনিময়ে পারমিট সংগ্রহ করতে হয়। পর্বতচূড়া মানেই রোমাঞ্চ আর অ্যাডভেঞ্চারের হাতছানি নয়। আছে জীবনের ঝুঁকিও। এভারেস্টে আরোহণ করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ২১০ জন পর্বতারোহী। ১৯৯৬ সালে পর্বতের বেশ উঁচুতে উঠে ঝড়ের কবলে পড়ে প্রাণ হারান ৮ পর্বতারোহী। এখানকার ডেথ জোনের আবহাওয়া এতটাই প্রতিকূল যে বেশিরভাগ সময় হতভাগ্য পর্বতারোহীদের মৃতদেহ সেখান থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হয় না।
পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতগুলোর অবস্থান ও পরিচয় শনাক্ত করার লক্ষ্যে ১৮০৮ সালে ব্যাপক আকারে ত্রিকোণমিতিক জরিপ শুরু করে তত্কালীন ব্রিটিশ ভারতের কর্তৃপক্ষ। জরিপে নিখুঁত পরিমাপের জন্য ১১০০ পাউন্ড ওজনের থিয়োডোলাইট ব্যবহূত হয়। দক্ষিণ ভারত থেকে জরিপকাজ আরম্ভ করে জরিপকারী দল ক্রমাগত উত্তরদিকে সরতে থাকে। ১৮৩০ সালে তারা হিমালয়ের পাদদেশে পৌঁছায়। কিন্তু রাজনৈতিক ও ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের ভয়ে নেপাল সরকার ব্রিটিশদের নেপালে প্রবেশাধিকার দিতে রাজি হয়নি। জরিপ দলের দেশটিতে প্রবেশের সব আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়। নেপাল সরকারের অসহযোগিতা উপেক্ষা করে ব্রিটিশ জরিপকারী দল কাজ চালিয়ে যায়। তারা ১৫০ মাইল (২৫০ কিলোমিটার) দূরে অবস্থিত পর্যবেক্ষণ স্টেশন থেকে হিমালয়ের জরিপ কাজ সম্পন্ন করে। তবে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে কেবল বছরের শেষ তিন মাস জরিপকাজ চলত।
১৮৪৭ সালের শেষ দিকে প্রধান জরিপকারক এন্ডু ওয়াহ হিমালয়ের পূর্বদিকে অবস্থিত সবাজপুর স্টেশন থেকে বেশকিছু পর্যবেক্ষণ সম্পন্ন করেন। সে সময় বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতচূড়া হিসেবে বিবেচিত হতো হিমালয়ের আরেক পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা। ওয়াহ কাঞ্চনজঙ্ঘার ১৪০ মাইল (৭ লাখ ৩৯ হাজার ২০০ ফুট) পূর্বে আরও উঁচু একটি পর্বতশৃঙ্গ লক্ষ্য করেন। নতুন শৃঙ্গটি কাঞ্চনজঙ্ঘার চেয়ে উচ্চতর। তারপরও প্রমাণের জন্য আরও নিকটতর স্থান থেকে পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন ছিল। কিন্তু মেঘের কারণে জরিপকাজ চালানো সম্ভব হয়নি। ১৮৫২ সালে বাঙালি গণিতবিদ ও জরিপকারক রাধানাথ শিকদার ত্রিকোণমিতিক পদ্ধতিতে এভারেস্টের উচ্চতা নির্ণয় করে একে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতচূড়া হিসেবে পরিচিত করেন। তিনি নিকলসনের তথ্যের ভিত্তিতে ত্রিকোণমিতিক পদ্ধতিতে এই হিসাব সম্পন্ন করেন।
নামকরণ: একসময় এভারেস্ট পরিচিত ছিল পিক ১৫ বা ১৫ নং চূড়া নামে। ১৮৬৫ সালে ব্রিটিশ ভূতাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠান রয়েল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি আনুষ্ঠানিকভাবে এর নামকরণ করে মাউন্ট এভারেস্ট। ভারতের সাবেক জরিপ পরিচালক জর্জ এভারেস্টের নামে এ নামকরণ করা হয়।
শুরুর দিককার অভিযান: ১৮৫৫ সালে আলপাইন ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন টমাস ডেন্ট তার বই ‘এভাব দ্য স্নো লাইন’-এ মন্তব্য করেন, এভারেস্টে আরোহণ করা সম্ভব। জর্জ ম্যালোরি তার ১৯২১ সালের অভিযানের সময় উত্তর দিক থেকে এভারেস্টে আরোহণ করার পথ আবিষ্কার করেন। ওই অভিযানটি ছিল মূলত অনুসন্ধানমূলক অভিযান, চূড়ায় ওঠার মতো প্রয়োজনীয় উপকরণ অভিযাত্রী দলটির ছিল না। ম্যালোরির (যিনি এই অভিযানের মাধ্যমে এভারেস্টের পাদদেশে পা রাখা প্রথম ইউরোপিয়ানে পরিণত হন) নেতৃত্বে দলটি উত্তরের গিরিখাদের ৭,০০৭ মি (২২,৯৮৯ ফুট) আরোহণ করে। সেখান থেকে চূড়ায় ওঠার জন্য ম্যালোরি একটি সম্ভাব্য রুট পরিকল্পনা করেন, কিন্তু তার সহযাত্রীরা এরকম একটি দুঃসাহসিক অভিযানের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। তাই সেবার তিনি ফিরে যান। ব্রিটিশরা ১৯২১ সালের অভিযানে হিমালয়ে প্রত্যাবর্তন করে। এতে জর্জ ফিনচ প্রথমবারের মতো অক্সিজেন ব্যবহার করে পর্বতারোহণ করেন। তার আরোহণের গতি ছিল বিস্ময়কর— ঘণ্টায় প্রায় ৯৫০ ফুট (২৯০ মি)। তিনি ৮,৩২০ মিটার (২৭,৩০০ ফুট) ওপরে ওঠেন, যা ছিল সর্বপ্রথম কোনো মানুষের ৮০০ মিটারের বেশি উঁচুতে আরোহণ। ম্যালোরি ও কর্নেল ফেলিক্স দ্বিতীয়বারের মতো ব্যর্থ অভিযান করেন। ম্যালোরির নেতৃত্বাধীন দলটি উত্তরের গিরিখাত বেয়ে নামতে গিয়ে ভূমিধসের কবলে পড়ে এবং সাতজন কুলি নিহত হয়।
পরবর্তী অভিযান হয় ১৯২৪ সালে। ম্যালোরি ও ব্রুসের প্রাথমিক প্রচেষ্টা স্থগিত করতে হয় যখন খারাপ আবহাওয়ার কারণে ক্যাম্প-৬ নির্মাণ অসম্ভব হয়ে পড়ে। পরবর্তী প্রচেষ্টা চালান নর্টন এবং সমারভিল, তারা অক্সিজেন সিলিন্ডার ছাড়াই অভিযানে নামেন এবং চমত্কার আবহাওয়ার সুবিধা পেয়ে নর্থ ফেস থেকে গ্রেট কুলোয়ির পর্যন্ত পরিভ্রমণ করেন। নর্টন ৮,৫৫৮ মিটার (২৮,০৭৭ ফুট) পরিভ্রমণ করেন, যদিও যদিও শেষ এক ঘণ্টায় তিনি মাত্র ১০০ ফুটের মতো উঠেছিলেন। ম্যালোরি শেষ চেষ্টা হিসেবে দ্রুত অক্সিজেন সরঞ্জাম জোগাড় করে এভারেস্টে অভিযানের আয়োজন করেন। এবার তিনি সঙ্গী হিসেবে নেন তরুণ এন্ড্রু আর্ভিংকে। ৮ জুন, ১৯২৪ তারিখে জর্জ ম্যালোরি ও এন্ড্রু আর্ভিং উত্তর গিরিখাত দিয়ে এভারেস্ট-চূড়া বিজয়ের মিশন শুরু করেন। এই অভিযান থেকে তাদের আর ফিরে আসা হয়নি। ১৯৯৯ ম্যালোরি ও আর্ভিং রিসার্চ এক্সপেডিশন নর্থ ফেসের নিচে, ক্যাম্প-৬ এর পশ্চিমে একটি তুষার গহবর থেকে ম্যালোরির মৃতদেহ উদ্ধার করেন। তবে তারা দুজন এভারেস্ট চূড়ায় ১৯৫৩ সালে হিলারি ও তেনজিংয়ের স্বীকৃত সর্বপ্রথম বিজয়ের আগে আরোহণ করতে পেরেছিলেন কি না তা নিয়ে যথেষ্ঠ বিতর্ক রয়েছে।
১৯৫২ সালে এডওয়ার্ড উইস-ডুনান্টের নেতৃত্বাধীন একটি সুইস অভিযাত্রী দল নেপাল দিয়ে এভারেস্টে আরোহণ অভিযানের চেষ্টা করার অনুমতি পায়। দলটি খুম্বু আইসফলের মধ্য দিয়ে একটি রুট প্রতিষ্ঠা করে এবং দক্ষিণ গিরিখাদের ৭,৯৮৬ মিটার (২৬,২০১ ফুট) আরোহণ করে। রেমন্ড ল্যাম্বার্ট এবং শেরপা তেনজিং নোরগে দক্ষিণ-পূর্ব রিজের ৮,৫৯৫ মিটার (২৮,১৯৯ ফুট) ওপরে ওঠেন, যা ছিল উচ্চতা আরোহণে মানুষের নতুন রেকর্ড। তেনজিংয়ের এই অভিজ্ঞতা ১৯৫৩ সালে ব্রিটিশ অভিযাত্রী দলের সঙ্গে কাজ করার সময় সহায়ক হয়।
প্রথম এভারেস্ট জয়: ১৯৫৩ সালের ২৯ মে নিউজিল্যান্ডের নাগরিক এডমান্ড হিলারি ও নেপালের তেনজিং নরগে প্রথম মানুষ হিসেবে এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৬ মে প্রথম নারী হিসেবে এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করার কৃতিত্ব লাভ করেন জাপানের জুনকো তাবেই। প্রথম প্রতিবন্ধী হিসেবে ১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টম হুইটেকার এভারেস্টের চূড়ায় উঠেন। একটি কৃত্রিম পা নিয়েও তিনি এভারেস্ট জয় করে বিশ্ববাসীকে চমকে দেন। সবচেয়ে বেশিবার এভারেস্ট জয় করেছেন নেপালের আপা শেরপা। ১৯৯০ সালের ১০ মে থেকে ২০১১ সালের ১১ মে পর্যন্ত তিনি মোট ২১ বার তিনি এভারেস্টের চূড়ায় পা রেখেছেন। নন শেরপা হিসেবে এই রেকর্ড আমেরিকান পর্বতারোহী ও অভিযানের গাইড ডেভ হানের দখলে। ১৯৯৪ সালের ১৯ মে থেকে ২০১২ সালের ২৬ মে পর্যন্ত মোট ১৪ বার এভারেস্ট জয় করেছেন তিনি। উল্লেখ্য, শেরপারা হচ্ছে হিমালয়ের পাদদেশে বসবাসকারী উপজাতি সম্প্রদায়। পর্বতারোহণে খুব দক্ষ হওয়ায় এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে শেরপাদের সাহায্য নেন পর্বতারোহীরা।
এভারেস্টে আবর্জনা: ছয় দশক আগে মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছিলেন এডমান্ড হিলারি এবং তেনজিং নোরগে। এরপর এখন পর্যন্ত তিন সহস্রাধিক অভিযাত্রী এভারেস্টের চূড়ায় ওঠেছেন। এছাড়া প্রতি বছর হিমালয়ে আরোহণ করেন কয়েক হাজার মানুষ। তবে এঁদের প্রত্যেকেই যে পর্বত আরোহণের জন্য প্রশিক্ষিত, তা নয়। অনেকের দুঃসাহসিক অভিযান বা রোমাঞ্চের একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে এটি। ফলে প্রশিক্ষণ না থাকায় তারা এভারেস্টের পরিবেশ দূষিত করছেন, রেখে আসছেন নানা আবর্জনা। যার মধ্যে রয়েছে অক্সিজেন সিলিন্ডার, মনুষ্য বর্জ্য, মৃত পর্বত আরোহীদের শরীর প্রভৃতি। এভাবে গত ছয় দশকে অন্তত ৫০ টন আবর্জনা জমেছে সেখানে। এজন্য এভারেস্টকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ‘ডাস্টবিন’। সম্প্রতি এভারেস্টের আবর্জনা পরিষ্কারের উদ্যোগ নিয়েছে নেপাল।
নতুন একটি আইন অনুযায়ী এভারেস্ট আরোহীদের প্রত্যেককে নামার সময় ফিরতে হবে আট কেজি আবর্জনা নিয়ে। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে আইনটি কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে। আরোহীকে প্রতিটি বেজ ক্যাম্পে কর্তৃপক্ষের কাছে ওই আবর্জনা হস্তান্তর করতে হবে। এছাড়া, এভারেস্ট অভিযানে পর্বতারোহীরা যেসব দ্রব্য সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন, নেমে আসার সময় তা ফেরত নিয়ে আসতে হবে। পর্বতাভিযানের সময় এজন্য নির্ধারিত ফি’র বাইরে অতিরিক্ত ৪ হাজার মার্কিন ডলার জমা রাখতে হবে। আবর্জনা নিয়ে নামলে তারা সেই অর্থ ফেরত পাবেন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, লাইভ সায়েন্স, গার্ডিয়ান, ডেইলি মেইল, হিমালয়ান টাইমস।
https://www.facebook.com/MesbahPatwaryBd