কক্সবাজার, সুন্দরবন, কুয়াকাটা, সিলেটের চা-বাগান, নয়নাভিরাম পার্বত্য অঞ্চলসহ শতাধিক দৃষ্টিনন্দন পর্যটন স্পট ছড়িয়ে আছে গোটা দেশজুড়ে। এসব পর্যটন স্পটকে চিহ্নিত করে এ খাতে রাষ্ট্র ও সরকারের একটু সুদৃষ্টি বদলে দিতে পারতো দেশের সামগ্রিক পর্যটন খাত তথা অর্থনীতির চিত্র। শুধু পর্যটন দিয়েই বদলে যেতে পারতো বাংলাদেশ। বিশ্ব কেবল বন্যা আর সিডরের দেশ হিসেবেই বাংলাদেশকে চিনতো না। বিশ্বে বাংলাদেশ পরিচিতি পেতে পারতো পর্যটনের দেশ হিসেবে। বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করতে পারতো কক্সবাজার আর কুয়াকাটার মতো চোখ ধাঁধানো স্থানগুলো। ইতিবাচক ভাবমূর্তির দেশ হতে পারতো বাংলাদেশ।
ঠিক এমনই অবস্থায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো গতকাল বাংলাদেশেও পালিত হলো বিশ্ব পর্যটন দিবস। পর্যটন শিল্পের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অবদান এবং গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতাকে সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘ ২৬ সেপ্টেম্বরকে বিশ্ব পর্যটন দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। সেই ঘোষণার সূত্র ধরে প্রতিবছরের ২৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশেও দিনটি পালন করে আসছে। সেই থেকে আজ অবধি প্রতিবছর চলছে বিশ্ব পর্যটন দিবস পালনের নামে চলছে র্যালি আর সভা-সেমিনারের আয়োজন। কিন্তু বাস্তবতা বড়ই নির্মম। গোটা বিশ্ব যখন একটু পানি থাকলেই ‘সি-বিচ’ আর সামান্য বন থাকলেই ‘ফরেস্ট এরিয়া’ বলে পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে, তখন বাংলাদেশে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের শহর কক্সবাজারকে ঢেলে সাজাতে নেই কোনো কার্যকর উদ্যোগ।
কক্সবাজারকে নিয়ে গৃহীত ১৬টি প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে চলছে ব্যাপক দুর্নীতি। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এ ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে যেখানে সরকারের উচিত ছিল কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ, সেখানে তা না করে পর্যটন মন্ত্রণালয় র্যালি-আলোচনা সভা করে দায়িত্বের ইতি টানছে। অথচ দেশব্যাপী অবহেলা আর অযত্নে ছড়িয়ে থাকা পর্যটন স্পটগুলোকে যথাযথভাবে ব্র্যান্ডিং করতে পারলে এটি হতে পারতো জাতীয় আয়ের একটি বিশাল খাত। এগুলোকে চিহ্নিত করে যদি সরকার উন্নয়নের সিঁড়ি তৈরি করতো উপকৃত হতো দেশের সাধারণ মানুষ। পর্যটনকে কেন্দ্র করে দেশে গড়ে উঠতো নিত্য নতুন নানা ব্যবসায়িক খাত। মূল্যস্ফীতির এ যুগে সাধারণ মানুষ ফিরে পেতো তাদের হারানো স্বচ্ছলতা। কেননা পর্যটক আসা মানেই নগদ বিদেশি টাকা; এ কথা সবাই জানে। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের শহর পর্যটন নগরী কক্সবাজারকে বিশ্ববাসীর কাছে আরো আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলতে বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছিল স্থানীয় প্রশাসন। কার্যক্রমও শুরু হয়ে গিয়েছিল। লাবণী পয়েন্টে ‘বিচ পার্ক’ ও ডায়াবেটিক পয়েন্টে ‘সি মিউজিয়াম’ নির্মাণের কাজ শুরুও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ অবধি আর শেষ হয়নি এ উন্নয়নের ধারা। এমতাবস্থায় আমাদের দেশ জাতির উন্নয়নের জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে মঙ্গল মানসিকতা নিয়ে।
পর্যটন দিবস এলেই আমরা শুধু পত্রিকার পাতায় পড়তে চাই না, ‘দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাণীতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পর্যটন শিল্পের দ্রুত বিকাশ ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে বিনিয়োগের আহ্বান জানান। দিবসটি পালন উপলক্ষে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন আজ দিনব্যাপী শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, সেমিনার এবং স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোতে প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছে।’
বাংলাদেশে একের পর এক সরকার পর্যটন খাতের উন্নয়নের কথা বললেও পরিস্থিতিতে বলার মতো কোনো উন্নয়ন হয়নি। হালে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে দেশি পর্যটকদের আনাগোনা বাড়লেও বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে বলার মতো কোনো সাফল্য বাংলাদেশের নেই। অপার নৈসর্গিক সৌন্দর্য, প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শন সমৃদ্ধ বাংলাদেশে অনন্য ও আন্তর্জাতিক মানের প্রচুর পর্যটন পণ্য রয়েছে। একটি দেশের সুপ্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্য আর বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে পর্যটন অপরিহার্য নিয়ামক। পর্যটনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশের প্রতি আগত পর্যটকের ইতিবাচক ধারণা জন্মে। এতে পর্যটকের কাছে দেশটির ভাবমূর্তি যেমন বাড়ে, তেমনি অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক লাভবান হয় সে দেশ। ‘পর্যটন’ অর্থনীতির একটি বিশেষ খাত বাংলাদেশে এমন ধারণার বিকাশ ঘটে পঞ্চাশ-ষাটের দশকে। তবে আমাদের দেশে অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটলেও পর্যটন শিল্পের অবস্থান এখনো অনেক পিছিয়ে। আমাদের পাশের অনেক দেশ যখন শুধু পর্যটনকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধন করছে তখন বাংলাদেশের অবস্থা মোটেই সন্তোষজনক নয়। পর্যটনকে কেন্দ্র করে অর্থনীতির বিকাশ ঘটিয়ে এরই মধ্যে বিশ্বের অনেক দেশ প্রমাণ করেছে ‘পর্যটন গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শক্তি’।
বিশ্ব পর্যটন সংস্থার হিসাব মতে, সিঙ্গাপুরের জাতীয় আয়ের ৭৫ শতাংশই আসে পর্যটন খাত থেকে। তাইওয়ানের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ জাতীয় আয়ের ৬৫ শতাংশ, হংকংয়ের ক্ষেত্রে পরিমাণ ৫৫ শতাংশ, ফিলিপাইনের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ৫০ শতাংশ, থাইল্যান্ডের ক্ষেত্রে তা প্রায় ৩০ শতাংশ। মালদ্বীপের অর্থনীতির প্রায় পুরোটাই পর্যটন খাতের ওপর নির্ভরশীল। মালয়েশিয়ার বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ৭ শতাংশই আসে পর্যটন খাত থেকে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পর্যটন শিল্প রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কেননা পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশের রয়েছে অপার সম্ভাবনা, যা আমাদের পাশের অনেক দেশের-ই নেই।
বাংলাদেশকে সারাবিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল ১০টি পর্যটন মার্কেটের একটি হিসাবে ভাবা হচ্ছে। ১৯৫০ সালে বাংলাদেশে পর্যটকের সংখ্যা ছিল ২৫ মিলিয়ন মাত্র, আয় ছিল ২ বিলিয়ন ডলার। ২০০৬ সালে পর্যটকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৪২ মিলিয়নে, আয় হয় ৭৩৫ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ ভ্রমণকারী পর্যটকের সংখ্যা ২০০৩ সালে ছিল ২ লাখ ৪৪ হাজার, ২০০৪ ও ২০০৫ সালে ২ লাখ ৭১ হাজার, ২০০৬ সালে ২ লাখ ৩১১ জন এবং ২০০৭ সালে এ যাবত্কালের সর্বোচ্চ সংখ্যক ২ লাখ ৮৯ হাজার। ২০০৬ সালের শেষের দিকে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পর্যটক অনেক কম আসে বাংলাদেশে। ফলে ২০০৬ সালে পর্যটন খাত থেকে ৮০.৪৪ মিলিয়ন ডলার আয় হলেও ২০০৭ সালে এর পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৭৫.২২ মিলিয়ন ডলারে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ৯০ কোটি, ধরা হচ্ছে ২০২০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়াবে ১৬০ কোটি। পর্যটন বিশেষজ্ঞদের মতে, এ বিপুল সংখ্যক পর্যটকের প্রায় ৭৩ শতাংশ ভ্রমণ করবে এশিয়ার দেশগুলো।
২০১১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর দৈনিক আমাদের অর্থনীতিতে প্রকাশিত
https://www.facebook.com/MesbahPatwaryBd