কয়েক মাস আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া দৈনিক বর্তমানের মূল প্রতিষ্ঠান মুন গ্রুপ। রিয়েল এস্টেট খাতের বিতর্কিত এ গ্রুপটিকে উদারহস্তে ঋণ দিয়েছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ও বেসরকারি ব্যাংকগুলো। আর এতে সহযোগিতা দিতে পিছিয়ে থাকেনি বাংলাদেশ ব্যাংকও।
রাজধানীর দিলকুশায় নির্মাণাধীন সানমুন স্টার টাওয়ারের নকশা
একদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ দেওয়ার জন্য অগ্রণী ব্যাংককে তিরস্কার করেছে, অন্যদিকে নিজেরাই মুন গ্রুপের তৈরি করা ভবন দিলকুশার সানমুন স্টার টাওয়ারে উচ্চমূল্যে জায়গা ভাড়া নিয়েছে। অথচ নানা অনিয়ম করে ভবনটি তৈরি করা হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানে তথ্য মিলেছে।
রাজধানীর দিলকুশায় সরকারি জায়গায় সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর অনুমোদন ছাড়াই ‘সানমুন স্টার’ নামে ৩০ তলা ভবন তৈরি করেছে মুন গ্রুপ। এর স্বত্বাধিকারী মিজানুর রহমান ওরফে কুত্তা মিজান এখন অন্য মামলায় পুলিশি হেফাজতে।
মুন গ্রুপের স্বত্বাধিকারী ও দৈনিক বর্তমান সম্পাদক মিজানুর রহমান ওরফে কুত্তা মিজান
ভবনটি ৩০ তলা করা হলেও কথিত অনুমোদনে এর ২৩ তলার অনুমতি রয়েছে। দুটি বেসমেন্টসহ এর পাঁচটি ফ্লোর তৈরি হয়েছে সিটি করপোরেশনের টাকায়। এগুলো গত মঙ্গলবার সিটি করপোরেশন নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে।
মিরপুরের কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন আরও একটি ২০ তলা ভবন তৈরি করেছে মুন গ্রুপ। তবে যে জমির ওপর এই দুই ভবন তৈরি হয়েছে, তার নিরঙ্কুশ মালিকানা মুন গ্রুপের নয়।
মুন গ্রুপের মালিকানাধীন সংবাদপত্র দৈনিক বর্তমান
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক দুটি পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, টাকা ফেরত পাওয়া যাবে না, এমন আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রমালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড মুন গ্রুপকে ২৩৮ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে।
বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংক গ্রুপটিকে ঋণ দিয়েছে ৬০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, জনগণের আমানতের এই ২৯৮ কোটি টাকা ঝুঁকিপূর্ণ খাতে চলে গেছে।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংক আরও বলেছে, মুন গ্রুপকে ঋণ দিতে বেশি মনোযোগী ছিল অগ্রণী ব্যাংক। গ্রুপটি থেকে সব টাকা উদ্ধার করা জরুরি। ব্যাংকের প্রধান শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক মিজানুর রহমান খান (বর্তমানে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক-ডিএমডি) এ জন্য দায়ী। প্রধান শাখার কর্মকর্তারাও দায় এড়াতে পারেন না। অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে গত ১৮ জুন অগ্রণী ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আবার অর্থ মন্ত্রণালয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংক মিলে উল্টো জড়িত এই কর্মকর্তা মিজানুর রহমান খানকে পুরস্কৃত করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে। তাঁকে ডিএমডি পদে পদোন্নতি দিয়েছে সরকার।
এক মাসের ছুটিতে মিজানুর রহমান খান ১৭ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। তাই তাঁর বক্তব্য নেওয়া যায়নি। তবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব এম আসলাম আলম বলেন, ‘এই পদোন্নতি দেওয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সুপারিশক্রমে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ বিষয়ে বলেন, ‘মিজানুর রহমানদের মতো লোকদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকেও লবিস্ট রয়েছেন। যে কারণে তাঁরা নিয়মবহির্ভূত ঋণ পেয়ে থাকেন এবং ওই ঋণে নির্মিত ভবনে বাংলাদেশ ব্যাংককে অফিস ভাড়া নিতেও প্রভাবিত করতে পারেন।’
কাগজপত্র ঠিক না থাকা সত্ত্বেও মুন গ্রুপের পক্ষে ঋণ অনুমোদন, ঋণ ছাড় ও ওই গ্রুপের ভবনে বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিস ভাড়া নেওয়ার নেপথ্য কারণ খতিয়ে দেখতে উচ্চপর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠনের পরামর্শ দেন ইব্রাহিম খালেদ।
এদিকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঋণ নিতে অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান ও নিজ জেলার বরগুনা শাখাকে বেছে নেন মিজানুর রহমান।
সানমুন স্টার ভবনের নির্মাণকারী গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এম আর ট্রেডিংসহ মুন বাংলাদেশ, মুন ইন্টারন্যাশনাল, মুন গার্মেন্টস অ্যান্ড কম্পোজিট টেক্সটাইলের নামে অগ্রণী ব্যাংক ৩৮১ কোটি টাকা মঞ্জুর করলেও ছাড় করে ২৩৮ কোটি টাকা। ভাড়ার নামে আরও দেয় ৩৩ কোটি টাকা। তিন বছরের কম সময়ে মুন গ্রুপকে এসব ঋণ দেওয়া হয়েছে, বিপরীতে গ্রাহক কোনো টাকা দেয়নি।
অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ আবদুল হামিদ গত বুধবার বলেন, মুন গ্রুপের বিষয়ে তিনি কোনো কথা বলবেন না। তবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে খুঁটিনাটি সবকিছু দেখা সম্ভব হয়নি বলে স্বীকার করেন তিনি।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার ন্যাশনাল ব্যাংকের এমডি এ কে এম শফিকুর রহমান ঘটনাটি তাঁর এই ব্যাংকে যোগ দেওয়ার আগের উল্লেখ করে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক বদিউল আলমের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। বদিউল আলমও কথা বলতে চাননি।
অভিনব আবদার
বিপুল পরিমাণ ঋণ পাওয়ার পর মুন গ্রুপ অগ্রণী ব্যাংকের কাছে অভিনব এক আবেদনপত্র পাঠিয়ে বলেছে, ২০২১ সালের আগে তারা কোনো টাকা পরিশোধ করতে পারবে না।
তবে ২০২১ সালের পর ১২ বছরে ত্রৈমাসিক কিস্তিতে সুদাসলে সব টাকা পরিশোধ করতে পারবে। এ জন্য সময় দিতে হবে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত।
অগ্রণী ব্যাংক ২০২৮ সাল পর্যন্ত সময় দিলেও বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদন করেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তিন বছর সময় দিলে অগ্রণী ব্যাংক তা পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কল্যাণপুরের ভবন তৈরির জন্য ঋণ নিতে মিথ্যা তথ্য দিয়েছে মুন গ্রুপ। ভবনটির ভূমির পরিমাণ ৫২ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ২২,৬৭২ বর্গফুট। কিন্তু ঋণ প্রস্তাবে ২২,৫০০ বর্গফুট ফ্লোর স্পেস নির্মাণ করার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, এটি অবাস্তব প্রস্তাব। এ ছাড়া টাকা বের করে নেওয়ার কৌশল হিসেবে ভবনটির নির্মাণ ব্যয় ২৭০ কোটি টাকা এবং কয়েকটি ফ্লোরের প্রাক্কলিত বিক্রয়মূল্য প্রতি বর্গফুট ১৫ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে।
গতকাল শনিবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কাঠামো তৈরি হওয়া ২০ তলা ভবনটির গায়ে মিজানুর রহমান মেডিকেল কলেজ (প্রস্তাবিত) নামে একটি সাইনবোর্ড। পাশেই একই গ্রুপের ‘রাজিয়া টাওয়ার’ নামে আরেকটি ২০ তলা ভবন। এতে ফ্ল্যাট রয়েছে ১৬০টি।
স্থানীয়রা জানান, ভবনের সামনের গলির নাম রাজিয়া সড়ক রেখেছেন মিজানুর রহমান নিজেই। অগ্রণী ব্যাংকের কাছে এটিও বন্ধক রাখা হয়েছে। মিরপুর ভূমি কার্যালয় বাংলাদেশ ব্যাংককে জানিয়েছে, রাজিয়া টাওয়ার সরকারি জমিতে তৈরি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সানমুন স্টার ভবনের নির্মাণকাজ বন্ধে ২০১১ সালেই নোটিশ দিয়েছিল রাজউক। তার পরও গ্রুপটিকে ঋণ দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। এ ছাড়া গ্রুপের অন্য তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে গ্রুপের মালিক মিজানুর রহমান বিধিবহির্ভূতভাবে তাঁর ব্যক্তিগত হিসাবে সরিয়েছেন।
এদিকে, পুলিশের কাছে মিজানুর রহমান ৩০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, নামে-বেনামে মিলিয়ে তাঁর নেওয়া ঋণ ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকাণ্ড: ১২ কোটি টাকা অগ্রিমে বাংলাদেশ ব্যাংক দিলকুশার সানমুন স্টার ভবনের ৩০ হাজার বর্গফুটের ১৪তম তলা ভাড়া নেয়। ৩৩ কোটি টাকায় অগ্রণী ব্যাংক নেয় তিনটি ফ্লোর। মার্কেন্টাইল ব্যাংক আট কোটি টাকা, সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক ১২ কোটি টাকা এবং সোনালী ব্যাংক ১২ কোটি টাকায় ওই ভবনের ফ্লোর ভাড়া নেয়। প্রতি বর্গফুট মার্কেন্টাইল ব্যাংক ৭৫ টাকা, অগ্রণী ব্যাংক ১০৮ টাকা করে ভাড়া নিলেও সবচেয়ে বেশি ১১০ টাকা দরে ভাড়া নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, সানমুন স্টার ভবনের মালিকানা অবৈধ থাকার বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইন বিভাগ শুরুতেই কর্তৃপক্ষের নজরে এনেছিল। কিন্তু তা আমলে নেওয়া হয়নি। তবে সিটি করপোরেশন ভবনের নিজস্ব অংশ দখলে নিতে ২২ সেপ্টেম্বর অভিযান চালানোর পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক চুক্তি বাতিল করে ১২ কোটি টাকা ফেরত নিয়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘অফিসের জন্য আমরা বড় জায়গা খুঁজছিলাম। কিন্তু এত বড় জায়গা এই ভবনটি ছাড়া আর কোথাও খুঁজে পাইনি।’ সেনাকল্যাণ ভবনে তখনো জায়গা ছিল—এমন তথ্য তুলে ধরলে তিনি বলেন, ‘ছিল, তবে আমাদের চাহিদা অনুযায়ী ছিল না।’
তবে সূত্রগুলো বলছে, মুন গ্রুপের মালিক মিজানুর রহমান ওরফে কুত্তা মিজান কয়েক দফা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গিয়ে বৈঠক করে এই ভাড়া চূড়ান্ত করেন।
মুন গ্রুপের লোগো
Courtesy: Prothom Alo
facebook.com/JournalistMesbahPatwary