মিডিয় প্রভাবিত সংস্কৃতি ও তরুণ সমাজ (পর্ব-১)
মেসবাহ উদ্দীন
বিভিন্ন ভাবে মিডিয়ার সংজ্ঞা দেয়া যায়। তবে এক কথায় বলা যায় যোগাযোগের মাধ্যম হচ্ছে মিডিয়া। মিডিয়ার পরিধি ব্যাপক; যা সৃষ্টির শুরু থেকেই বিভিন্ন ভাবে যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমানে মিডিয়ার ব্যবহার সবধরনের প্রচারণা কার্যক্রম থেকে শুরু করে শিক্ষা-সংস্কৃতি, উৎপাদন, ব্যবসা, বিনোদন জগতে ক্রমশই বাড়ছে। মিডিয়ার উদাহরন স্বরুপ বলাযায় সংবাদপত্র-পত্রিকা, অনলাইন সংবাদ, রেডিও, টেলিভিশন, মোবাইল(স্মার্টফোন-ট্যাব), কম্পিউটার-ইন্টারনেট, ফেসবুক-টুইটার, ইউটিউব, ভাইবার, বই-পুস্তক, চিঠি-পত্র, পোষ্টার-লিফলেট ইত্যাদি। এসব মিডিয়াকে ২ ভাগে ভাগ করা যায় প্রথমত- প্রিন্টিং মিডিয়া এবং দ্বিতীয়ত ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল মিডিয়া। এসব মিডিয়াকে আরও গতিশীল করেছে স্যাটেলাইট মিডিয়া।
একুশ শতকের এই দুর্বোধ্য চ্যালেঞ্জিং সময়কে আমরা উত্তর আধুনিক যুগ, বিজ্ঞানের যুগ, তথ্য প্রযুক্তির যুগ, বিশ্বায়নের যুগ, গণতন্ত্রের যুগ ইত্যাদি নামে ডাকি। আবার কেউ কেউ একে মিডিয়ার যুগ হিসেবে অভিহিত করেন। কারণ উপরোক্ত সকল যুগের প্রচার প্রসার হয় মিডিয়ার মাধ্যমে। কোন এজেন্ডা বাস্তবায়নে মিডিয়ার মিডিয়ার চেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র দ্বিতীয়টি নেই। প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষতায় মিডিয়ার উপাদান হিসেবে যুক্ত হয়েছে স্যাটেলাইট, অপটিক ফাইবার, ওয়াই-ফাই ইত্যাদি। যার ফলে পৃথিবীটা ক্রমশ ছোট হতে হতে আমাদের হাতের মুঠোয় এসে গেছে। আমাদের সকল কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছে মিডিয়া, আর আমরা হয়ে উঠছি মিডিয়া নির্ভর। আর তাইতো কোন মতবাদ, দর্শন, ধর্ম, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, ব্যবসায়িক-পন্য ইত্যাদির প্রচার-প্রসার ও বাস্তবায়নে সবাই মিডিয়া ব্যবহার করছে।
মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা যা পাই তা হলো তথ্য। তথ্য লিখিত, চিত্র, অডিও, ভিডিও ইত্যাদি আকারে আদান-প্রদান করা হয়। তথ্যের বিভিন্ন ধরন রয়েছে, তাই তথ্যের ধরনের উপর নির্ভর করে মিডিয়ার ধরন। মিডিয়া সমাজের আয়না, এর মাধ্যমে সমাজের চিত্র সঠিক ভাবে ফুটে উঠবে অর্থাৎ আমরা সত্য বস্তুনিষ্ঠ তথ্য পাব এটাই স্বাভাবিক অবস্থা। অন্যদিকে অস্বাভাবিক অবস্থা হচ্ছে মিথ্যা, বিকৃত, উদ্দেশ্য-প্রণোদিত তথ্য পাওয়া। বর্তমানে এই অস্বাভাবিকতাই হচ্ছে বাস্তবতা। মিডিয়ার এই অসত্য, বিকৃত, উদ্দেশ্য-প্রণোদিত, তিলকে তাল বা তালকে তিল হিসেবে উপস্থাপনা করা ইত্যাদি কর্মকান্ডকেই বলা হয় হলুদ সাংবাদিকতা অথবা প্রগতিশীল-সুশীল এর মুখোশধারী শয়তান-মানুষ। আর তাদের এই কর্মকাণ্ডকে বলা হয় তথ্য সন্ত্রাস।
বিভিন্ন গোষ্ঠী তাদের বিভিন্ন আদর্শ, দর্শন, মতবাদ, সাংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার জন্য মিডিয়া ব্যবহার করছে। এ ব্যবহার অনেক পুরানো হলেও সু-পরিকল্পিত ভাবে এর ব্যবহার দেখা যায় ১৮শতকে। সে সময়ে এশিয়া ও আফ্রিকায় বিষেশ করে মুসলিম দেশগুলোতে সাম্রাজ্যবাদের সামরিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক নীতির সমর্থনে গড়ে ওঠে ওরিয়েন্টালিজম বা প্রাচ্যবাদ ধারনা। এ বিষয়ে তাদের মূল কথা হচ্ছে এখানকার (এশিয়া ও আফ্রিকা) শাসিতরা যেহেতু অনুন্নত ও সভ্য নয় এবং তাদের সাংস্কৃতি ও জীবনাচরন পশ্চিমাদের (সাম্রাজ্যবাদীদের) তুলনায় নিম্নমানের সেহেতু তাদের উন্নত করার নিমিত্তে শাসন করার নৈতিক ও প্রাকৃতিক অধিকার তাদের রয়েছে। তাদের এ অপ-নীতির সমর্থনে সে সময়ে পুরো ইউরোপ জুড়ে একদল লেখক, বুদ্ধিজীবি, দার্শনিক, শিল্পী তৈরি হয়। তারা তাদের (এশিয়া-আফ্রিকার) ধর্ম, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, ভাষা ও জীবনাচরণ নিয়ে গবেষণা করেন এবং উত্তরণের পথ নির্ণয় করেন। অর্থাৎ তাদের উন্নতির জন্য কি করতে হবে এবং কিভাবে করতে হবে তা নির্ধারণ করে দেন। আর এ কাজে তারা তৎকালীন মিডিয়ার সহায়তা নেন। ইউরোপীয়রা যখন এদেশে আসে তখন এখানকার (এশিয়ার) সামাজিক ও অর্থনীতিক অবস্থা তাদের তুলনায় শ্রেয় ছিল, কিন্তু বুদ্ধিজীবি-ঐতিহাসিকরা সেময়টাকে সব রকম অবনতি, অগতি আর অন্ধকারের যুগ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাদের মতে, তাঁরা এখানে না এলে আমাদের উদ্ধারের আর কেউ ছিলনা। আমাদের অনেক বুদ্ধিজীবিই আজ মনে করেন নিজেদের বুদ্ধি ও শক্তিতে বিবর্তিত হলে আমাদের সমাজ উন্নত ও যুগোপযোগী হতে পারতো না। আমাদের নোবেল পাওয়া এক কবি তাদেরকে ভাগ্য বিধাতা বলেছেন। তাদের প্রচারণায় আমাদের মধ্যেও আজ এমন ধারনা বদ্ধমূল যে ইংরেজী না জানলে জাতে ওঠা যায় না। বর্তমানে ইংরেজীর দরকার আছে সত্যি, কিন্তু তাদের সাংস্কৃতিও কি আমাদের গ্রহণ করতে হবে? ভাষার সাথে সংস্কৃতি নিবিড় ভাবে জড়িত, ভাষা টান দিলে সংস্কৃতিও চলে আসে। তাই ভাষা গ্রহণের সময় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঠেকাতে না পারলে আমাদের অস্তিত্ব ও স্বকীয়তা টিকে থাকবে না।
সাম্রাজ্যবাদী-গোষ্ঠী জানতো উপনিবেশ চিরস্থায়ী হবে না। তাই উপনিবেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যবস্থা চিরস্থায়ী করার জন্য তারা সুকৌশলে একটা শ্রেণী তৈরি করে গেলেন যারা তাদের অগ্রবাহিনী হিসেবে কাজ করে চলছে। যারা বর্তমানে সুশীল-প্রগতিশীল-চিন্তাশীল সমাজ নামে এদেশের মিডিয়ায় কাজ করছে। আর এ ক্ষেত্রে তাদের যথাযত গাইড লাইন দিয়ে যাচ্ছে ইহুদী- খ্রিষ্টান ও পৌত্তলিক মিডিয়া। তাই বর্তমানে আগের মত সৈন্য দিয়ে কোন দেশ দখল করতে তেমন দেখা যায় না, এক্ষেত্রে তাদের সৃষ্ট মিডিয়া এবং সুশীল-প্রগতিশীল-চিন্তাশীল সমাজ-ই যথেষ্ট। আর মিডিয়া যে অগ্রবাহিনী তৈরি করে দেয় তা যে কোন ধরনের আগ্রাসন চালানোর জন্য পর্যাপ্ত। ফলশ্রুতিতে আমরা আত্মভোলা হয়ে আমাদের পরিচয় দিচ্ছি বাঙালী/বাংলাদেশী হিসেবে, মুসলিম হিসেবে নয়। আমাদের মনে এরকম ধারনা বদ্ধমূল যে ইসলাম একটি লৌকিক ধর্ম; যা শুধু কিছু আচার-অনুষ্ঠান সর্বস্ব, সামগ্রীক ও সার্বজনীন নয়। এভাবে আমাদের জীবন ব্যবস্থায় যাবতীয় অপসংস্কৃতি-শিরক-বিদাত জড়িয়ে যাচ্ছে। আমাদের সংস্কৃতসেবীদের অনেকেই বলছেন- বিপদে, শংকায়, অস্বস্তিতে রবীন্দ্র-সংগীত শ্রবণ ইবাদতের মত। একজন মুসলিমের জন্য এরচেয়ে অজ্ঞতা-পথভ্রষ্টতা আর কি হতে পারে?