ইংরেজীতে বহুল প্রচারিত একটি কথা আছে- "Well plan is half done", অর্থাৎ সুপরিকল্পনা মাধ্যমে অর্ধেক কাজ সম্পন্ন হয়। পশ্চিমা দেশগুলোতে দেখেছি তারা প্রতিটি কাজ অত্যন্ত সুপরিকল্পনা মাফিক সম্পন্ন করে হোক না সেটা অতিতুচ্ছ কিংবা মস্তবড়। আমাদের দেশে সুপরিকল্পনাকে সোনার হরিন বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না। প্রতিটি ক্ষেত্রে সুপরিকল্পনার দারুন অভাব চোখে পড়ে। বিশেষ করে সন্তান লালন-পালন এবং সন্তানের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার গঠনে প্রতিটি পিতা-মাতা কিংবা অবিভাবকের আকাশ ছোয়া আকাঙ্খা থাকলেও সময়মত সুষ্ঠ এবং সুন্দর পরিকল্পনা নেই বললেই চলে। সন্তানের সার্বিক বিষয়গুলো অনেকটা গৎবাধা নিয়মে অতিবাহিত হয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ পিতা-মাতা সন্তান মাতৃগর্ভে থাকাকালীনই সন্তান ভবিষ্যতে কি হবে তার ছক কষা আরম্ভ করে যাকে ব্যক্তিগত খায়েশ ছাড়া মোটেও সুপরিকল্পনা বলা যায় না।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে নবম শ্রেনীতে কিছুটা এবং এসএসসি পাশ করে একাদশ শ্রেনীতে ভর্তি হওয়ার সাথে সাথে একজন ছেলে বা মেয়ের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার অনেকটা নির্ধারিত হয়ে যায়। একাদশ শ্রেনীকে ক্যারিয়ার গঠনের প্রাথমিক ধাপ বলা যায়। এখানেই অনেককে সিদ্ধান্ত নিতে হয় সে কোন বিভাগে পড়াশোনা করবে যা তাদের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ারের নির্দেশিকা বহন করে। আর ১৫-১৭ বছর বয়সী একজন ছেলে অথবা মেয়ের পক্ষে এমন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া মোটেও সহজ কাজ নয়। যার কারনে সন্তানের ক্যারিয়ার গঠনে পিতা-মাতার ভুমিকা উল্লেখযোগ্য। আমাদের দেশে সাধারনত ছেলে মেয়েদের ক্যারিয়ার বিষয়ক সিদ্ধান্তটা মা-বাবাই গ্রহন করেন। তাই প্রতিটি অবিভাবকেরই উচিত সন্তানের ক্যারিয়ার নির্ধারনে কয়েকটি বিষয় খুব গুরুত্ব সহকারে চিন্তা ভাবনা করে সঠিক সিদ্ধান্তটা নেওয়া।
সন্তানের মেধা এবং সামর্থের উপর গুরুত্ব দেওয়া
বাংলাদেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পিতা-মাতা সন্তানের সামর্থ এবং পারদর্শীতা বিবেচনায় না নিয়ে তাদের স্বীয় আকাঙ্কা চাপিয়ে দেন সন্তানের উপর। যেহেতু ১৫-১৬ বছর বয়সী একজন ছেলে মেয়ের পক্ষে সঠিক সিদ্ধান্তটা নেওয়া বেশ কঠিন, এক্ষেত্রে পিতা-মাতার দ্বায়িত্ব সন্তানের মেধা, শক্তি-সমার্থ এবং পারদর্শিতা বিবেচনায় নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্টা গ্রহন করা। অন্যথায় অনেক ক্ষেত্রেই মেধার অমূল্যায়ন হতে বাধ্য। উদাহরনস্বরুপ, যে ছেলের সামর্থ নেই বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার, তাকে বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে বাধ্য করলে ব্যাপারটা মোটেও সুখকর হয় না। ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলিনার (University of North Carolina) একটি গবেষনায় নিয়োজিত কয়েকজন গবেষক সন্তানের সামর্থ এবং ইচ্ছার উপর গুরুত্বারোপ করে ক্যারিয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পরামর্শ দিয়েছেন।
সন্তানের ইচ্ছা অনিচ্ছা মূল্যায়ন করা
শুধু মেধা এবং সামর্থ নয়, সন্তানের ইচ্ছা অনিচ্ছার ব্যাপারটাও বিবেচনার দাবীদার। জোর করে গিলানোর বেশ শক্ত একটা রেওয়াজ চালু আছে আমাদের সমাজে যা কোনভাবেই কাম্য নয়। যে সন্তান ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হতে চায় না, তার জন্য ভিন্নতর চিন্তা করাটাই বিবেচনাপ্রসূত । যে ছেলের খেলাধুলার প্রতি বেশি ঝোক, তাকে নিয়ে সহজসাধ্য কোন চিন্তা করাটাই শ্রেয়। দির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে পড়াশুনা করতে না পারলে ভবিষ্যৎ ভাল হবে না এমন চিন্তা ভাবনা একেবরেই অবান্তর। অগনিত চাকুরীর ক্ষেত্র রয়েছে দুনিয়ায়।
ব্যক্তিগত আবেগ কিংবা ঈর্ষাকে পরাজিত করা
পিতা-মাতা কিংবা অবিভাবকদের আবেগ অথবা ঈর্ষা অনেকক্ষেত্রে সন্তানের ক্যারিয়ার ধ্বংসের কারন হয়। দুনিয়ার সব মা-বাবাই নিজ সন্তানকে উচ্চ আসনে দেখতে চান। অনেক মা-বাবা স্বীয় সন্তানকে সম্মানজনক পেশা যেমন ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দেখতে চান। শুধু মা-বাবার এমন উচ্চাকাঙ্খাই সন্তানের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার একমাত্র উপকরন হতে পারে না। কোন কোন ক্ষেত্রে ঈর্শার বশবর্তী হয়েও সন্তানের ক্যারিয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অমুকের ছেলে ডাক্তারি পড়ে, তো আমার ছেলেকেও ডাক্তারি পড়াতে হবে- ইত্যাদি ঈর্ষান্বিত কার্যকলাপ একেবারেই ভাল ফলাফল বয়ে আনে না। সন্তানের সামর্থ থাকলে ডাক্তারি পড়বে না হলে অন্য কিছু পড়বে। সুতরাং আবেগ কিংবা ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে সন্তানের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার নির্ধারন করা একেবারেই অনুচিত।
বাস্তবতার গুরুত্ব অনুধাবন করা
সন্তানকে নিয়ে সুপরিকল্পনা গ্রহন না করায় আমাদের দেশের অধিকাংশ মা-বাবাকে হতাশার মধ্যে পড়তে হয়। বিশেষ করে চাকুরীর গুটিকয়েক ক্ষেত্রকে এত বড় করে দেখা হয় যা অনেককে পরবর্তীতে হতাশ হতে বাধ্য করে। বাংলাদেশে মোটামুটি সন্তানকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ম্যাজিস্ট্রেট অথবা সেনা কর্মকর্তা হিসেবে দেখতে চান বেশিরভাগ পিতা-মাতা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সকলের পক্ষে এমনকি অধিকাংশের পক্ষে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা ম্যাজিস্ট্রেট হওয়া সম্ভব নয়। এ বাস্তবতা সকল অবিভাবককেই স্বীকার করতে হবে। অবিভাবকদের মধ্যে এমন ধারনা জন্ম নিয়েছে যে তার সন্তান ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হতে না পারলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার আর ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হতে পারলে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল যা একেবারেই অমূলক এবং সুবিবেচনা বহির্ভূত। ভুলে গেলে চলবে না দুনিয়ায় চাকুরীর ক্ষেত্র অগনিত।
সন্তানকে সত্যিকার শিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রচেষ্টা
সন্তানের ক্যারিয়ার বিষয়টা নির্ধারন হয়ে যাওয়ার পরের ধাপই হচ্ছে আসল শিক্ষা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিক্ষা বলতে আমরা সাধারনত কিছু সার্টিফিকেট প্রাপ্তিকেই বুঝি। যার যত বেশি সার্টিফিকেট সে তত বেশি শিক্ষিত। সার্টিফিকেট সর্বস্ব চলমান শিক্ষাব্যবস্থার সাথে অবশ্য দ্বিমত পোষন করছি না। তবে বাস্তবতা হচ্ছে শুধুমাত্র সার্টিফিকেট অর্জনের মাধ্যমে সত্যিকারের শিক্ষার সন্ধান পাওয়া যায় না। কেননা প্রকৃত শিক্ষা আরও বেশি কিছু ইংগিত করে।
মহাকবি মিল্টন (Milton) বলেছেন, "Education is the harmonious development of body, mind and soul"। শিক্ষা হচ্ছে শরীর, মন এবং আত্মার সুষম উন্নয়ন। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং লেখক হারবার্ট (Herbert) বলেছেন, "Education is the development of good moral character." শিক্ষা হচ্ছে উত্তম নৈতিক চরিত্রের উন্নয়ন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, "মানুষের অন্তর্নিহিত গুনাবলীর উন্নতি ও বিকাশ সাধনের নামই শিক্ষা"। অর্থাৎ পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি সন্তানকে সেই শিক্ষায় শিক্ষিত করা প্রয়োজন যার মাধ্যমে তার নৈতিক চরিত্রের উন্নয়ন সাধিত হয়, মন এবং আত্মার উন্নয়ন সাধিত হয়। পিতা-মাতা কিংবা অবিভাবকদের অন্যতম দ্বায়িত্ব সন্তানকে যথাযথ নৈতিক শিক্ষা প্রদান করা। নৈতিকতা ছাড়া সুন্দর এবং সাবলীল ক্যারিয়ার গঠন কখনই সম্ভব নয়।
সন্তানের দ্বায়িত্ববোধ জাগ্রত করতে সচেষ্ট হওয়া
পড়ালেখার পাশাপাশি ছেলে মেয়েদেরকে বিভিন্ন দ্বায়িত্ব এবং কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করা একান্ত দরকার। অন্তত সন্তানকে এতটুকু বুঝানো উচিত শুধু নিজে বা নিজেদের জন্য নয়; সমাজের প্রতি, মানুষের প্রতিও তার বা তাদের দ্বায়িত্ব এবং কর্তব্য রয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্ট হতে এবং স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে অংশগ্রহনে সন্তানদের উদ্ধুদ্ধকরন ছেলে মেয়েদের দক্ষতা উন্নয়নে সহায়ক হয়।
খেলাধুলা এবং বিনোদনের যথেষ্ট সুযোগ দেওয়া
ক্যারিয়ার গঠনে প্রাথমিক সিদ্ধান্তটি সঠিক নেওয়ার পরও সফল হওয়ার নিশ্চয়তা নেই। কেননা সফলতা নির্ভর করে একটা নির্দিষ্ট সময়সীমার উপর। এই সময়সীমা সঠিকভাবে কাজে কাগাতে ব্যার্থ হলে বিফল হতে হবে কোন সন্দেহ নেই। এক্ষেত্রেও অবিভাবকদের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। বাজেভাবে সময় নষ্ট করার নানা উপকরন এখন হাতের নাগালে যা নৈতিক চরিত্র ধ্বংসের হাতিয়ারও বটে। এজন্য সন্তানদের জন্য খেলাধূলা এবং সুস্থ বিনোদনের যথাযথ ব্যবস্থা করা অবিভাবকদের অন্যতম দ্বায়িত্ব। বর্তমানে ছেলে মেয়েরা খেলাধূলার পিছনে সময় না দেওয়ার কারনে সে সময়টা অনেকেই এভাবে সেভাবে পার করছে। তাই সন্তানদেরকে নিয়মিত শরীরচর্চা কিংবা খেলাধূলার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করায় যত্নবান হলে দুশ্চিন্তামুক্ত জীবন যাপন সহজ হতে পারে।
ভাল কিছুর দিকে উৎসাহ দেওয়া
সন্তান যত কম মূল্যাবান বিষয় নিয়েই পড়াশোনা করুক না কেন, পিতা-মাতা কিংবা অবিভাবকদের উচিত সেই বিষয়ে তাকে একজন দক্ষ কিংবা বিশেষজ্ঞ হতে উৎসাহ প্রদান করা এবং সেই সাথে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করা।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মে, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:৪৯