somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমান দাস-দাসীদের প্রেরনাদ্বীপ্ত ইতিহাস

২৩ শে নভেম্বর, ২০১২ রাত ১০:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমান দাস-দাসী আমদানীর প্রারম্বিকতা
কলম্বাস পূর্বযুগ থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথার প্রচলন ছিল। বস্তুত সে সময় যুদ্ধবন্ধী এবং ঋণ পরিশোধে অপারগ ব্যক্তিদের দাসকর্মে বাধ্য করা হত। কলম্বাস পূর্ব যুগের অনেক ইতিহাস অজানা হলেও ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাস-দাসীর সন্ধান পাওয়া যায়। ১৫২৮ সালে এস্তেভানিকো (Estevanico) নাকম একজন মরক্কীয় নাগরিককে দাসকর্মে বাধ্য করা হয়। যতদূর জানা যায় তিনিই ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম মুসলমান দাস। এস্তেভানিকো এর প্রকৃত নাম ছিল মুস্তাফা ঝামুরি (Mustafa Zemmouri) যিনি একদল পর্তুগীজ দস্যুর হাতে আটলান্টিক মহাসাগরের মরক্কো উপকূল থেকে অপহৃত হন। ১৫২০ সালে তাকে ডোরানটেস ডি ক্যারানজা (Dorantes De Carranza) নামক একজন স্পেনীয় নাগরিকের নিকট বিক্রয় করা হয়। ১৫২৭ সালে তিনি ডোরানটেস ডি ক্যারানজা এর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় গমন করেন এবং পরের বছর তাকে বর্তমান আরিজোনায় (Arizona) দাস কর্মে বাধ্য করা হয়। দু একটি সূত্রমতে পরবর্তীতে মুস্তাফা ঝামুরিকে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহনেও বাধ্য করা হয়। জানা যায় মুস্তাফা আঝ-জামুরি ছিলেন ঔষুধ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, কারো মতে তিনি ছিলেন একজন চিকিৎসক।

১৬১৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রিকান দাস-দাসী আমদানীর গোড়াপত্তন হয়। সে বছর বিশজন মতান্তরে ত্রিশজন আফ্রিকান নাগরিককে অপহরন করে একটি ডাচ জাহাজে করে আমেরিকার ভার্জিনিয়া (Virginia) প্রদেশে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকেই আমেরিকার সর্বত্র দাসপ্রথার ব্যাপক প্রসার ঘটতে শুরু করে। ঔপনিবেশকদের পাশাপশি স্থানীয় স্বচ্ছল নাগরিকদের মাঝেও দাস গ্রহনের প্রবনতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। কৃষি, শিল্প প্রভৃতি ক্ষেত্রে অদক্ষতার কারনে আমেরিকার তৎকালীন পর্তুগীজ এবং বৃটিশ ঔপনিবেশকদের একেবারেই সুবিধা হচ্ছিল না। উপরন্তু বৃটেন এবং পর্তুগাল থেকে যে সকল গরীব কৃষক এবং শ্রমিকদের কৃষি এবং অন্যান্য কাজ সম্পাদন করানোর উদ্দেশ্য আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া হত তাদের চেয়ে আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গরা ছিল অধিকতর কর্মঠ এবং দক্ষ। ফলে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আফ্রিকার সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল থেকে তারা কৃষ্ণাঙ্গদের অপহরন শুরু করে এবং তাদেরকে আমেরিকায় বিভিন্ন জায়গায় ধরে নিয়ে দাসকর্মে বাধ্য করে।

মুসলমান দাস-দাসীদের সার্বিক অবস্থা
ইতিহাসবিদদের মতে আফ্রিকা থেকে ধৃত আমেরিকায় পাচারকারী দাস-দাসীদের শতকরা দশ থেকে ত্রিশ ভাগ ছিল মুসলমান এবং মুসলমান দাসীদের সংখ্যা ছিল শতকরা প্রায় ১৫ ভাগ। এমনও দেখা গেছে পুরো একটি জনগোষ্টিতে ছিল একজন মাত্র মুসলমান যাকে আফ্রিকা থেকে ধরে এনে দাসকর্মে বাধ্য করা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমান দাস-দাসীদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত করুন। নিজেদের ইচ্ছামত ধর্ম কর্ম পালন করা ছিল অনেকটাই অসম্ভব, তার উপর অনেক মুসলমান দাস-দাসীদের জোরপূর্বক খৃষ্টধর্ম গ্রহনেও বাধ্য করা হত। প্রথমদিকে আমেরিকায় আগত আফ্রিকান মুসলমান দাস-দাসীদের অধিকাংশের নামই অজানা থেকে যায়। ক্রীতদাসদের সম্পত্তির তালিকায় কারো কারো নাম পাওয়া গেলেও তাদের আগমনের ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোন তথ্য জানা সম্ভব হয় নি। মুসলমান দাস-দাসীদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক লোকই স্কুলে যাওয়ার, সম্পত্তির মালিক হওয়ার, বিয়ে করার, আদালতের দ্বারস্ত হওয়ার অথবা তাদের মৃত্যু আইনগতভাবে নথিভুক্ত করার সুযোগ পেতেন। এদের উপর নির্যাতনের নানামুখী মাত্রা ছিল অসহনীয় যা পরবর্তীতে বিভিন্ন লেখকের সত্যসন্ধানী রচনা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তখন অনেকেরই ইসলাম সম্পর্কে খুব একটা ধারনা ছিল না। ক্রয় করার সাথে সাথে মালিকেরা দাস-দাসীর নতুন নামকরন করতেন। অনেক মুসলমান দাস-দাসীকেও মুসলিম নাম বাদ দিয়ে ভিন্ন নাম দেওয়া হত। ইসলাম সম্পর্কে তাদের নূন্যতম ধারনা না থাকায় খ্রিষ্টধর্মের রীতি-নীতি পালনে অনেক মুসলমান দাস-দাসীকে বলপ্রয়োগ করা হত। তথাপি অনেকে গোপনে যথাসাধ্য ইসলাম পালন করার চেষ্টা করতেন। পক্ষান্তরে কতিপয় দাস মালিক ছিলেন কিছুটা নমনীয়। তারা মুসলমান দাস-দাসীদের স্বীয় ধর্ম পালনে অন্তরায় হতেন না। ১৮৫৪ সালে চার্লস বল (Charles Ball) নামে একজন দাস যিনি ছিলেন খিস্টধর্মাবলম্বী একজন শিক্ষিত ব্যক্তি তার লিখিত একটি বইয়ে উল্লেখ করেন, "আমি কয়েকজন দাসকে চিনতাম যারা ছিল মুহাম্মাদ এর অনুসারী শিক্ষিত লোক। সে সময় পর্যন্ত আমি কখনই মুহাম্মাদের ধর্ম (ইসলাম) সম্পর্কে কিছুই শুনিনি। আমার উপনিবেশে একজন লোক ছিল যিনি প্রত্যহ পাচঁ বার নামাজ আদায় করতেন, এবং নামাজ আদায় করার সময় সর্বদাই পূর্ব দিকে ঘুরে দাড়াতেন (I knew of several slaves who must have been from what I have seen learned Mohammadin. I knew of people I did not know who they were back then, now I know they were Muslims. At that time I had never heard of the religion of Muhammad. There was a man on my plantation who prayed five times a day, always turning to the east when he performed his prayer)"।

কয়েকজন উল্লেখযোগ্য মুসলনমান দাসের দাস জীবন
সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকে পর্তুগীজ এবং বৃটিশ অপহরনকারীরা কোনরকম বাছবিচার ছাড়াই সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল থেকে গণহারে আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ অধিবাসীদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করে দেয়। তাদের অস্ত্রের কাছে দারিদ্রপীড়িত সাধারন আবাল-বৃদ্ধ থেকে আরম্ভ করে শিক্ষিত এমনকি রাজপুত্ররাও ছিল অসহায়। অপহরনকারীদের নিষ্ঠুর থাবা থেকে বাদ পড়ত না নারী এবং শিশুরাও। সমুদ্র উপকূলে বেড়াতে যাওয়া কিংবা প্রাত্যাহিক কোন কাজ করতে গিয়েই সাধারনত জনপদের অধিবাসীরা অপহরনের স্বীকার হতেন। ফলে এক কাপড়েই সকল দাস-দাসীদের আটলান্টিক পাড়ি দিতে হত। এক্ষেত্রে ধর্মপ্রান মুসলমানদের যন্ত্রনা ছিল আকাশছোঁয়া। সুন্দরভাবে নিজ ধর্ম-কর্ম পালন করার রসদ কেউই সঙ্গে করে নিতে পারেন নি, সঙ্গে নিতে পারেন নি নিত্য দিনের চলার সঙ্গী পবিত্র কুরআন। দাসকর্মে বাধ্য হয়ে অমানবিক পরিশ্রম করে নয়, মুসলমানদের সবচেয়ে বড় কষ্ট ছিল পবিত্র কুরআনের অনুপস্থিতি, রাসূল (স) এর দেখানো জীবনদর্শনের অনুপস্থিতি।

তখনকার সময়ে মুসলমানরা ছিল সর্বক্ষেত্রে অগ্রগামী। লেখাপড়া, জ্ঞান-গবেষনা, সমুদ্র অভিযান ইত্যাদি ক্ষেত্রে মুসলমানদের ছিল অসামান্য পারদর্শিতা। ষোড়শ শতক থেকে উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত সাধারন লোকজনের পাশাপাশি আফ্রিকার বিভিন্ন জায়গা থেকে উল্লেখ্যযোগ্য সংখ্যক শিক্ষিত মুসলমান এবং বনিয়াদী ঘরের ছেলে মেয়েদের অপহরন করেও মার্কিন মুল্লুকে দাসকর্মে বাধ্য করা হয়। ১৭৩০ সাল থেকে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত এমনই পচাত্তর জন মুসলমান দাসদের নিয়ে অ্যালান ডি অস্টিন (Allan D, Austin) রচনা করেছেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ আফ্রিকান মুসলিমস ইন এন্টিবেল্লাম আমেরিকা (African Muslims In Antebellum Ameica)। এডওয়ার্ড বল (Edward Ball) যার পূর্বপুরুষদের হাতে দুইশত বছর ধরে দাস-দাসীর মালিকানা ছিল, তিনি দাস-দাসীদের জীবনী নিয়ে লিখেছেন 'স্লেইভ ইন দ্য ফ্যামিলি (Slaves in the family)'। গ্রন্থটিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, তার পূর্বপুরুষরা যখন প্রথমবারের মত দাস ক্রয় করেছিল তাদের মধ্যে ফাতেমা নামে একজন মুসলমান মহিলাও ছিল। তিনি আরও উল্লেখ করেন ১৭৫৬ সালে তার আরেকজন পূর্বপুরুষ সিয়েরা লিয়নের বংশোদ্ভুত একজন দাসী ক্রয় করেছিলেন।

জব বেন সলোমন (Job Ben Solomon)
জব বেন সলোমন একজন উল্লেখ্যযোগ্য দাস যার প্রকৃত নাম ছিল আইয়ুব সোলাইমান দিয়ালো (Ayuba Suleiman Diallo)। তিনি ছিলেন উচ্চবংশীয় মর্যাদাসম্পন্ন। তার দাদা ছিলেন পশ্চিম আফ্রিকার বন্দু (Bondu) শহরের ত্রানকর্তা। আইয়ুব সোলায়মান ১৭৩১ সালে বন্ধুর সাথে দেখা করে ফেরার পথে গাম্বিয়া থেকে অপহৃত হন। তকে প্রথমে ম্যারিল্যান্ডে (Maryland) তামাক ক্ষেতের কাজে নিয়োগ করা হয় এবং পরবর্তীতে গবাদি পশু রক্ষনাবেক্ষনের দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়। একাধিক ভাষায় পারদর্শী আইয়ুব সোলায়মান ছিলেন শিক্ষিত, বিচক্ষন এবং দাবী আদায়ে বদ্ধ পরিকর। দাস মালিকেরা তাকে দ্বোভাষী হিসেবেও ব্যবহার করতেন। দাস হওয়া সত্ত্বেও আইয়ুব সোলায়মান মুসলমানদের মধ্যে ইসলামী শিক্ষা প্রচারে লিপ্ত ছিলেন। আইয়ুব সোলায়মানের ব্যক্তিত্ত্বে মুগ্ধ হয়ে তার মালিক তাকে রয়াল আফ্রিকান কোম্পানির (Royal African Company) কাছে পয়তাল্লিশ পাউন্ডে বিক্রি করে দেন এবং তাকে কোম্পানির লন্ডন কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। একদিন কতিপয় বৃটিশ চিত্রকর তার নগ্ন ছবি অঙ্কন করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। অতপর আইয়ুব বিন সোলায়মান নগ্ন হতে অস্বীকার করেন এবং পোষাক পরিহিত অবস্থায়ই তাদেরকে নগ্ন ছবি অঙ্কন করার আর্জি পেশ করেন। জবাবে লোকেরা বললেন, আমরা তোমার শরীর না দেখে কিভাবে তা চিত্রায়িত করব। আইয়ুব সোলায়মান উত্তর দিলেন, সামান্য পোষাকের অন্তরালে থাকা শরীরের ছবিই তোমরা অঙ্কন করতে পার না; তাহলে কিভাবে তোমদের কিছু চিত্রকর সৃষ্টিকর্তার ছবি অঙ্কন করে যাকে কেউই কখনও অবলোকন করে নি?

শেষ পর্যন্ত তিনি যুক্তরাজ্যে রাজ পরিবারের সাথে দেখা করতে সমর্থ হন এবং দাসকর্ম থেকে মুক্তি পেয়ে ১৭৩৪ সালে নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। থমাস ব্লুয়েট (Thomas Bluett) নামক একজন আইনজীবী যিনি তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমন করেছিলেন, আইয়ুব সোলাইমান সম্পর্কে বলেন, "তার সাথে কথোপকথন এবং তার প্রতি সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করার আগে তিনি একটি বা দুটি চরন লিখলেন এবং অতঃপর যখন সেটা পড়লেন, তিনি 'আল্লাহ' এবং 'মুহাম্মাদ' শব্দগুলো উচ্চারন করলেন; তিনি এক গ্লাস মদ গ্রহন করতেও অস্বীকার করেছিলেন যা আমাদের পক্ষ থেকে তাকে দেওয়া হয়েছিল, আমরা উপলব্ধি করলাম তিনি একজন মুহাম্মাদীন (মুসলিম), কিন্তু ঠিক কোন দেশ থেকে এসেছে তা ঠাহর করতে পারলাম না....আমরা বুঝতে পারলাম তিনি কোন সাধারন দাস ছিলেন না (Upon our Talking and making Signs to him, he wrote a Line or two before us, and when he read it, pronounced the Words Allah and Mahommed; by which, and his refusing a Glass of Wine we offered him, we perceived he was a Mahometan, but could not imagine of what Country he was.... we could perceive he was no common Slave)"। উল্লেখ্য আইয়ুব সোলায়মান পবিত্র কুরআনের তিনটি কপি স্বহস্তে রচনা করেছিলেন যা এখনও বর্তমান রয়েছে।

ইব্রাহীম আবদ আর-রহমান (Ibrahim Abd Ar-Rahman)
ইব্রাহীম আবদ আর-রহমান (তৎকালীন তিম্বো-Timbo) বর্তমান গিনির (Guinea) এক সময়কার শাসক সোরি (Sory) এর পুত্র এবং সেনাবাহিনীর একজন উর্ধতন কর্মকর্তা। ১৭৬২ সালে ইব্রাহীম তিম্বোতে জন্মগ্রহন করেন। ১৭৮৮ সালে ২৬ বছর বয়সে তিনি অপহৃত হন এবং অপহরনকারীরা তাকে একজন বৃটিশ নাগরিকের কাছে বিক্রি করে দেয় যিনি ইব্রাহীম আবদ আর-রহমানকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অরলিনসে (New Orleans) নিয়ে যান। অতঃপর তাকে দাস কর্মে বাধ্য করা হয়। ইব্রাহীম আবদ আর-রহমান তাকে রাজপুত্র হিসেবে পরিচয় দিলে "থমাস ফস্টার (Thomas Foster)" হিসেবে তার নামকরন করা হয়। তবে তার মালিক তাকে মুক্তি দিতে অস্বীকার করে। দাসত্বের চরম শিকল থেকে নিজেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্য এক সময় সেখান থেকে পালিয়ে গেলেও কোন সাহায্যকারী না পেয়ে কয়েকদিন পর তিনি আবারও তার মালিকের কাছে ফিরে আসেন। রাজপূত্র হয়ে দাসকর্ম করা স্বাভাবিকভাবেই তিনি মেনে নিতে পারেন নি। সময়ে সময়ে তিনি নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে থাকেন এবং কালের বিবর্তনে ইব্রাহীম আব্দুর আর রহমান অনুকরনীয় ব্যক্তিত্বে পরিনত হন। ১৮২৬ সালে তিনি আফ্রিকায় তার এক আত্নীয়ের নিকট পত্র লিখেন। পত্রখানা একজন মার্কিন সিনেটরের হাত ঘুরে মরক্কোর সুলতানের নিকট পৌছে। অতঃপর সুলতানের অনুরোধে ১৮২৮ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামস (John Quincy Adams) এর হস্তক্ষেপে আব্দুর রহমান সস্ত্রীক মুক্তি পেলেও তার সন্তানদের মুক্ত করতে ব্যর্থ হন। সন্তানদের মুক্ত করতে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন এলাকায় অর্থ সংগ্রহ করলেও মুক্তিপনের অর্ধেকের বেশি অর্থ যোগাড় করতে তারা অসমর্থ হন। পরের বছর তিনি সস্ত্রীক লাইবেরিয়ায় গমন করেন এবং চারমাস পর সন্তান হারানোর যন্ত্রনা নিয়ে সেখানেই মৃত্যবরন করেন।

আবু বক্বর আস-সিদ্দিক (Abi Bakar As-Siddeeq)
অ্যালেন ডি অস্টিন (Allan D. Austin) তার "আফ্রিকান মুসলিকম ইন এন্টিবেল্লাম আমেরিকা" বইয়ে যে কজন আফ্রিকান বংশোদ্ভুত দাসদের জীবনালেখ্য নিয়ে আলোচনা করেছেন, তাদের মধ্য অন্যতম হলেন আবু বকর আস-সিদ্দিক যিনি উনিশ শতকের গোড়ার দিকে অপহৃত হয়েছিলেন। আবু বকর আস-সিদ্দীক ছিলেন সুশিক্ষিত এবং প্রচন্ড ধর্মানুরাগী মুসলমান। তিনি তার জীবনচরিতে লিখেছেন, "আমাদের গোত্রের বিশ্বাসই হচ্ছে ইসলামের প্রতি বিশ্বাস। যখন আমার দাস জীবন শুরু হয়েছিল তখন থেকে আজ পর্যন্ত তাদের নিকট থেকে দাস জীবনের অনেক তিক্ততার স্বাদ গ্রহন করেছি। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ, সকল প্রশংসা আল্লাহর যার অধীনস্ত সকল ক্ষমতা এবং সমস্ত কিছু, তিনি যা চান তাই করেন, এমন কেউ নেই আল্লাহ যা হুকুম করেছেন তা বাতিল করতে পারে আথবা আল্লাহর পক্ষ থেকে যা দেওয়া হয়েছে তা অনুমোদন করতে পারে (The faith of our family is the faith of Islam. That was the beginning of my slavery life when I captured until this day, I tasted the bitterness of slavery from them but Alhamdulillah "all praise be to Allah under whose power or all things, He does whatever He wills, no one can turn aside what He has decreed or drained nor can any one with hold what he has given)"। ধারনা করা হয় তিনি কুরআন থেকে শেষোক্ত কথাগুলো লেখার চেষ্টা করেছিলেন। সমুদ্রে জাহাজ চালনায়ও আবু বকরের ছিল অসমান্য দক্ষতা। উনিশ শতকের তৃতীয় দশকের শেষের দিকে একজন সমুদ্র অভিযাত্রী মরক্কো থেকে তিম্বুক্তু (Timbuktu) পরিভ্রমনকালে আবু বকর আস সিদ্দিককে পথ প্রদর্শক নিয়োগ করেন। অতঃপর সেখান থেকে তিনি নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করতে সমর্থ হন।

বিলালী মুহাম্মাদ (Bilali Muhammad)
আঠার শতকের আরও একজন উল্লেখযোগ্য আফ্রিকান বংশোদ্ভুত মুসলমান দাস ছিলেন বিলালী মুহাম্মাদ যাকে জর্জিয়ার স্যাপেলো দ্বীপে (Salelo Island) একজন দাস ব্যবসায়ীর কাছে বক্রি করা হয়। উল্লেখ্য বিলালী মুহাম্মাদের মালিক ছিলেন খুবই সহিষ্ণু এবং উদার মানসিকতা সম্পন্ন যিনি পরবর্তীতে দাসপ্রথা বিলুপ্ত করার জন্য চেষ্টা সাধনা করেন। ইতিহাসবিদদের মতে ১৭৭০ সালের দিকে বিলালী মুহাম্মাদ সিয়েরালয়নের একটি শিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। কিশোর বয়সেই বিলালীকে অপহরন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথায় বাধ্য করা হয়। বিলালী মুহাম্মাদ ছিলেন কুরআন এবং ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞানের অধিকারী। বিলালী মুহাম্মাদ তার দাস জীবনের নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেই জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা বিশেষ করে ইসলামী আইন কানুন বিষয়ে লেখালেখি করেন যা বর্তমানে বিলালী দলিল (Bilali Document) নামে পরিচিত। ১৮৫৭ সালে জর্জিয়ায় বিলালী মুহাম্মাদের মৃত্যুর পর তার কামরা থেকে ১৩ পৃষ্ঠার হস্তলিখিত একটি দলিল উদ্ধার করা হয়। বিলালী মুহাম্মাদের হস্তলিখিত দলিল আরবি ভাষায় লিখিত হওয়ায় অনেক দিন ধরে তা যাদুঘরে পড়েছিল এবং ধারনা করা হয়েছিল এটা বিলালী মুহাম্মাদের ব্যক্তিগত ডায়েরী। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায় 'বিলালী দলিল' ছিল মূলত ইসলামী শরীয়তের বিভিন্ন বিষয়ের দিক নির্দেশনা যাকে বর্তমান সময়ের ইসলামী পন্ডিতরা আমরেরিকার 'প্রথম ফিকাহ' শাস্ত্র হিসেবে অভিহিত করেন।

শুধু হস্তলিখিত দলিলই নয়, বিলালী মুহাম্মাদ কর্তৃক ইসলামের জন্য যথেষ্ট কাজ করার প্রমান পাওয়া যায়। উনিশ শতকের চল্লিশ দশকের শুরুর দিকে একজন গবেষক স্যাপেলো দ্বীপ ভ্রমন করেন। উক্ত গবেষক সেখানে বসবাসরত বেশকিছু আফ্রো-আমেরিকান নাগরিকের সাথে কথা বলেন যাদের অনেকের পূর্বপুরুষ ছিল মুসলমান। কেটি ব্রাউন নামক একজন মহিলা তার দাদা দাদী সম্পর্কে বলেন, সে তার দাদা দাদীকে নিয়মিত সুর্যদয় এবং সুর্যাস্তের মুহুর্তে এবং ঠিক দুপুরে নামাজ পড়তে দেখতেন। আরেক ব্যক্তি বলেন, আমি আমার চাচা ক্যালিনা এবং চাচী হেনাকে অনেক মজার বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেখতাম এবং তারা তাদের নামাজের ব্যাপারে ছিল খুবই সময়নিষ্ঠ। শ্যাড হল নামক আরেকজন লোক বলেন, দ্রুত অনেকে মাঠের মধ্যে জড়ো হতেন এবং কাপড় বিছিয়ে তার উপর তারা সুর্যদ্বয়, সুর্যাস্ত এবং ঠিক দুপুরে নামাজ আদায় করতেন। অপর একজন বৃদ্ধ মহিলা বলেন, আমি আমার দাদী/নানীকে একটি বই পড়তে দেখতাম এবং আমরা ছেলেমেয়েরা যখন খেলাধুলা করতাম যতদূর মনে পড়ে তখন তিনি আমাদেরকে বলতেন "আশামানাগাদ (Ashamanagad)"। ধারনা করা হয় "আশামানাগাদ" নয় কথাটি ছিল "আশহাদু আন্না মুহাম্মাদ"।

শেষকথা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমান দাস-দাসীদের জীবনচরিত অধ্যয়ন করে নির্দ্বিধায় বলা যায়, মুসলমানেরা সেখানে তিনশ বছর ধরে চরম নিপীড়নের স্বীকার হয়েছিলেন। তথাপি ইসলামী রীতি নীতি পালনে তারা ভীষন অকৃপনতার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন। ইসলামের প্রতি ভালবাসা এবং আল্লাহর প্রতি তাদের সীমাহীন আস্থা এখনও প্রতিটি বিবেকসম্পন্ন মুসলমানকে শিহরিত করে। নানা প্রতিকুলতার মধ্যে থেকেও তারা যেভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইসলামের জন্য কাজ করেছেন তা দৃষ্টান্তস্বরুপ। শত বঞ্চনা, নির্যাতন, নিপীড়নের মাঝেও অনেকেই ছিলেন প্রতিবাদী। তাদের শক্ত এবং পরিচ্ছন্ন প্রতিবাদের ফলেই বহু বছর দাসকর্ম করেও অনেকে এ যন্ত্রনা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে ইসলাম সম্প্রসারনের ক্ষেত্রে কৃষ্ণাঙ্গ মুসলমান দাস-দাসীদের ভূমিকা স্বীকারযোগ্য। তাদের মাধ্যমেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইসলামের বীজ বপন হয়েছিল যার শস্যদানা ছড়িয়ে ছিটিয়ে সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমান মুসলমানের সংখ্যা পার করেছে আড়াই মিলিয়ন।

উৎস:
1) Afirican Muslims in Antebellum America by Allan D. Austin
2) African Muslims in America: A Rich Legacy
3) Berlin,Ira (1998). Many Thousands Gone: The First Two Centuries of Slavery in North
4) Ball, Edward,(1999). Slaves in the Family . New York and Canada: Ballantine Books, Random House.
5) History of Islam in America: Whither and Where - Yasir Qadhi
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তীব্র তাপদাহ চলছে : আমরা কি মানবিক হতে পেরেছি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৯

তীব্র তাপদাহ চলছে : আমরা কি মানবিক হতে পেরেছি ???



আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির মুখে আছি,
আমাদেরও যার যার অবস্হান থেকে করণীয় ছিল অনেক ।
বলা হয়ে থাকে গাছ না কেটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যবহারে বংশের পরিচয় নয় ব্যক্তিক পরিচয়।

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৫

১ম ধাপঃ

দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে কত মানুষের সাথে দেখা হয়। মানুষের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য আসলেই লুকিয়ে রাখে। এভাবেই চলাফেরা করে। মানুষের আভিজাত্য বৈশিষ্ট্য তার বৈশিষ্ট্য। সময়ের সাথে সাথে কেউ কেউ সম্পূর্ণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×