বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র দেশ নয় যেখানে যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়নি তবে সম্ভবত: একমাত্র দেশ যে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ যথেষ্ট প্রমাণ থাকা সত্বেও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রত্যাহার করেছে । আমি এখানে পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের কথা বলছি । এইসব পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের এ দেশীয় দোসর যেসব যুদ্ধাপরাধী আছে তারা সময়ের পালাবদলে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসেছে, এখন সময় সুযোগমত তাদের করা যুদ্ধাপরাধকেও অস্বীকার করছে । পরবর্তীতে এইসব কুলাংগারদের কথাও আসবে, এদের যুদ্ধাপরাধের বিচারে আমাদের ব্যর্থতার কথাও আসবে । তবে এই সিরিজে আমি মুলত: পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী যারা আটক ছিল, যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ ছিল, বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার উদ্যোগ নেবার পরও কোন পরিস্থিতিতে, কি কারনে একটি নব্য-স্বাধীন দেশ তার জন্মযুদ্ধের সময় যারা মানবতার বিরুদ্ধে ঘৃণ্য অপরাধ সংঘটন করলো তাদের বিরুদ্ধে আনা সকল চার্জ "as an act of clemency" বা "দয়াশীলতা ও ক্ষমার মহত্ব" দেখিয়ে প্রত্যাহার করলো সেটি তুলে আনার চেষ্টা করবো । (২)
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ভারত-বাংলাদেশের যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পনের পরে প্রায় ৯০,৫০০ জনকে যুদ্ধবন্দী হিসাবে আটক হয় । এই যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে ছিল প্রায় ৮০,০০০ উর্দিধারী সদস্য যার মধ্যে ছিল আর্মি (৫৫,৬৯২), নেভী ও এয়ার ফোর্স (১,৮০০), প্যারামিলিটারি (১৬,৩৫৪) বা পুলিশ সদস্য (৫,২৯৬)এবং বাদবাকী ১০,৫০০ ছিল সিভিলিয়ান (মুলত: বিহারী) যারা পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করেছে । (৩)
এই যুদ্ধবন্দীদের সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও অধিকার সংরক্ষণ করে আটক রাখার মত অবকাঠামো না থাকায় সিদ্ধান্ত হয় ভারত এই ৯০,৫০০ যুদ্ধবন্দীকে আটক রাখবে এবং এদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তাসহ ভরণপোষনের দায়িত্ব পালন করবে । এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যুদ্ধবন্দীদের ভারতের নিকট হস্তান্তর করা হয় । এই যুদ্ধবন্দীদের জন্য তখনকার হিসাবে প্রতিমাসে ভারতের খরচ ছিল ১,০০০,০০০ মার্কিন ডলার । (৪)
এই যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে থেকে প্রাথমিকভাবে প্রায় ১৫০০ জনকে চিন্হিত করা হলেও চূড়ান্তভাবে সর্বমোট ১৯৫ জনকে সুনির্দিষ্টভাবে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করা হয় । এবং এদের যুদ্ধাপরাধের জন্য বিচারের সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার । (৫) বাদবাকী যুদ্ধবন্দীদের পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের যৌথ উদ্যোগে আলোচনা শুরু হয় । বাংলাদেশ তখন স্বাধীন রাষ্ট্র হলেও এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সহায়তা প্রয়োজন ছিলো ।
পাকিস্তান তখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে নাই এবং পাকিস্তানের মিত্র রাষ্ট্র চীনের প্রদত্ত ভেটোর কারনে বাংলাদেশ তখনো জাতিসংঘের সদস্যপদও লাভ করে নাই । ১৯৭২ সালের আগষ্ট মাসে চীন বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্যপদ দেয়ার ব্যাপারে আনা প্রস্তাবের বিপক্ষে ভেটো দেয় । এটি ছিল চীনের জাতিসংঘে প্রদত্ত প্রথম ভেটো । (৬)
এই অবস্থায় ১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ যখন আনুষ্ঠানিক ভাবে ১৫০০ জন যুদ্ধাপরাধী থেকে ১৯৫ জনকে সুনির্দিষ্ট যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারের উদ্যোগ নিল এবং জুলাই মাসে সংসদে "International Crimes Act 1973 " পাশ করলো তখন পাকিস্তান এই বিচারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুললো । (৭) পাকিস্তানের মতে এটি জেনেভা কনভেনশনের লংঘন কেননা বাংলাদেশ তখনো জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র নয় ।
জেনেভা কনভেনশনের আর্টিকেল ৫, ৬ অনুযায়ী বাংলাদেশের এই বিচার প্রক্রিয়ার উদ্যোগের কোন সমস্যা ছিলোনা । বাংলাদেশ পাকিস্তানের দাবী প্রত্যাখ্যান করে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের এই বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতা পর্যবেক্ষণ করার আমন্ত্রণ জানায় । পাকিস্তান এই পরিস্থিতিতে পরিস্থিতিতে পাকিস্তানে আটকে পড়া ৪০০,০০০ বাঙালীকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের অনুমতি দিতে অস্বীকার করে । (৭)
(চলবে)
তথ্যসূত্র :
১। http://www.unhchr.ch/html/menu3/b/91.htm
২। Time, Monday April 22, 1974
৩। en.wikipedia.org/wiki/Indo-Pakistani_War_of_1971
৪। Time, Monday September 17, 1973
৫ । Bangladesh in 1972: Nation Building in a New State
Rounaq Jahan
Asian Survey, Vol. 13, No. 2 (Feb., 1973), pp. 199-210
৬ China, the Soviet Union, and the Subcontinental Balance
Sheldon W. Simon
Asian Survey, Vol. 13, No. 7 (Jul., 1973), pp. 647-658
৭। The weakness in the International Protection of Minority Rights, Javaid Rahman, Kluwer Law International, Page 96-97
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ রাত ১২:৪০