আমাদের লেখকগণ অধিকাংশই ইউরোপের লেখার ধরন অনুসরণ করেই কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প বা নাটক লিখেন। কিন্তু একজন ইংরেজি ভাষার লেখকের তুলনায় বাংলাদেশের লেখকদের লেখা কেন চলে না। কেন আমাদের শ্রেষ্ঠ কবিদের কাব্যগ্রন্থ এক হাজার কপিও চলে না। আমার কাছে মনে হয়- সাহিত্য রচনার মানের সাথে লেখকদের ব্যক্তিত্বও ভূমিকা রেখেছে। আমরা মোটের উপর অনতজানু ব্যক্তিত্বের মাত্র কয়েকজন লেখকই দেখেছি প্রভাব বিস্তার করতে। হুমায়ূন আহমেদের ব্যক্তিত্বে সংকট থাকলেও মাঝেমধ্যে শক্তিও দেখেছি। তিনি প্রথম দিকে ধর্ম অবিশ্বাসের কথা এবং পরবর্তীতে সন্দেহবাদিতার কথা প্রকাশ্যেই বলতেন। কন্যার প্রতিদ্বন্দ্বীকে বিয়ে করা এমনকি প্রথম বিয়ের ক্ষেত্রেও অল্প বয়সী নারীকে বিয়ে করে তার নেতিবাচক মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তিনি ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে বাকের চরিত্রকে ফাঁসির হাত থেকে বাঁচাতে সকল চাপই অগ্রাহ্য করেছেন। সাহিত্যকদের মধ্যে হুমায়ুন আজাদ ও আহমদ ছফাকেও দেখেছি সাদাকে সাদা ও কালোকে কালো বলতে। হুমায়ুন আজাদের তীব্র কটাক্ষ ও সাহসী উচ্চারণ তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিল। এক্ষেত্রে একমাত্র তসলিমা নাসরিনই ছিলেন বেপরোয়া। তিনি সাদার ভিতরে থাকা কোন লুক্কায়িত রঙের কথাও বলতেন। বিশেষ করে নারী নিপীড়নের বহু মাত্রিক ধরন ও নিজের অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ্যে এনেছেন প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে। তাতেই বহুজনকে ভেঙ্গে পড়ার ভয়ে তাঁর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখেছি। এখনো তাদের কেউ কেউ ইনিয়ে বিনিয়ে তসলিমার বিরুদ্ধে কথা বলতে চায়।
সাম্প্রতিক সময়ে ৪২ জন নাগরিক নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এনে পত্র দিয়েছেন রাষ্ট্রপতিকে। তাদের মধ্যে কোন কবি বা উপন্যাসিক কি আছেন? বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের তালিকায় কোন কবি-সাহিত্যিক কি পড়েন না? অথচ এসব ক্ষেত্রে তাদেরই এগিয়ে থাকার কথা। প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এসব ক্ষেত্রে সবসময়ই অগ্রগণ্য। দেশের শ্রেষ্ঠ কবিকে ফেসবুক স্ট্যাটাস দিতে হয় পুরস্কার পাওয়ার হাহাকার নিয়ে। কেউ অর্থের জন্য, কেউ অনুদানের জন্য, কেউ পুরস্কারের জন্য লাইন দিয়ে থাকেন- তাদের গ্রন্থ তিনশ কপিও বিক্রি না হলেও। আবার এই নতজানু ব্যক্তিত্বের কারণেই মানুষও এদের লেখা পড়ে দেখতেও চায় না। যার দিকে মানুষ তাকিয়ে থাকে না- কোন জাতীয় সমস্যায় তার বক্তব্য শুনতে, তার বই কেনার জন্য মানুষ লাইন দিবেই বা কেন?
আমার স্ত্রীর বড় ভাই তসলিমার সিনিয়র ছিলেন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে। তিনিই একসময় আমাদের তসলিমার কথা বলেছিলেন। তিনি খুবই আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন- এক সময় তসলিমা নাসরিনের নাম সবাই শুনবে, তাঁর লেখা পড়বে। এটা তিনি তসলিমার লেখা ও ব্যক্তিত্ব দেখেই উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁর মতো বিদ্রোহী নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আর কোন নারীকে আমরা দেখিনি। নজরুলের বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গি ও বৃটিশদের হাতে নিপীড়িত হওয়ায় মানুষ তাঁর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়েছিল। তসলিমা মৌলবাদীদের হুমকিতে এবং রাষ্ট্রযন্ত্র বাধ্য করায় দেশ ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু সেখানেও মৌলবাদীরা সোচ্চার হয়ে উঠে। মৌলবাদীরাই সত্যকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। বিজ্ঞান সত্যকে প্রকাশ করে বলেই তারা বিজ্ঞানবিরোধী। তসলিমার প্রতিষ্ঠান বিরোধী লেখা যেমন প্রতিষ্ঠিত কিন্তু নতজানু লেখকরা মেনে নিতে পারেননি আবার মৌলবাদী শক্তিও সোচ্চার হয়ে উঠে। আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলে তিনি বহুমাত্রিক বিপদে পড়েন। যেনো ডাঙায় বাঘ আর জলে কুমির অবস্থা। কিন্তু তিনি তারপরেও নতজানু হননি, নির্বাসিত হয়েছেন। লেখকগণ নিপীড়নের মুখেও সত্য কথা বলবে এটাই বিশ্বব্যাপী সাধারণ বিষয়। তসলিমার ব্যক্তিত্বেও আমরা তেমনটাই দেখেছি। পশ্চিমবঙ্গে গিয়েও তিনি প্রখ্যাত লেখক সুনীল গাঙুলি ও সবচেয়ে শক্তিশালী পত্রিকা আনন্দ বাজারের বিরুদ্ধে কথা বলতে পিছপা হননি। এমনকি বামদের বিরুদ্ধেও কথা বলেছেন। এগুলো সম্ভব হয়েছে তাঁর ব্যক্তিত্বের কারণেই। ব্যক্তিত্বের প্রশ্নে বাংলাদেশের দুজন মানুষের পরিচিতি বিশ্বব্যাপী রয়েছে তারা হলেন- তসলিমা নাসরিন আর ড. ইউনুস।
বাংলাদেশে সম্ভবত তসলিমাই প্রথম নারীদের পাতার বাইরে পুরুষদের সমান তালে কলাম লেখা শুরু করেন। নারীমুক্তি ও নারী স্বাধীনতার জয়গান গাইতে থাকেন। এমন সব অচিন্তনীয় কথা প্রকাশ করতে থাকেন যা আগে কেউ কখনো বলেন নি। কেউ কখনো কোন নারীর মুখে শুনেনি। অচিরেই তাঁর কলামের জনপ্রিয়তা প্রতিষ্ঠিত কলামিস্টদের ছাড়িয়ে যায়। তসলিমার উত্থানের সময়ে দেশে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার উত্থান ঘটে। তবে তারা উঠে আসেন মৃত পিতা ও মৃত স্বামীর হাত ধরেই। কিন্তু তসলিমার উত্থান ঘটে ব্যক্তিগতভাবে। তাঁর পরিবারের কাউকে এখনো কেউ চিনে না। হাসিনা খালেদা তখন প্রধান দুটি বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রধান। সাথে তসলিমার কলাম, উপন্যাস, কবিতা মিলে এক নারী জাগরণের মহাকাল শুরু হয়। বিস্ময়কর যে সে নারী নেতৃত্ব যখন ক্ষমতায় তখনই তসলিমাকে বিদায় নিতে হয় দেশ থেকে। তাঁর প্রখর ব্যক্তিত্বে ম্লান হয়ে যান প্রখ্যাত কলামিস্টরা আর তাতেই ক্ষেপে উঠেন অনেকে। তাকে গালিগালাজ করতে থাকেন কেউ কেউ। তাকে বেশ্যা বানাতে লেগে যান। কেউ কেউ মনে করেন- তসলিমা যেমন প্রকাশ্যে কথা বলেন হয়তো চাইলেই ভোগ করা যাবে। সেই ভুলই করে বসেন একজন শীর্ষস্থানীয় লেখকও। এসময় তিনি বিভিন্ন ধর্মে যে নারী নিপীড়নের ফর্ম রয়েছে তাও বলা শুরু করেন। আর ধর্মান্ধ শ্রেণি তা সহ্য করতে চায়নি বলেই তাঁকে খেদাতে আন্দোলন শুরু করে। যদি তসলিমা তখন টিকে যেতেন তবে ভয়াবহ পতন ঘটতো ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের। তসলিমার চলে যাওয়ার পরে মৌলবাদীদের চাপাতির কোপে খুন হন হুমায়ুন আজাদও। আর তাতেই দেশে থমকে যায় প্রগতিশীলতা ও নারীর উত্থানের মহাযাত্রা।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১০:২০