somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বামিঙ্গিয়ান উপাখ্যান

১০ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




মাঝ রাতে কড়া একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুম ভাঙলো জ্যাকের৷ ঘুমের ঘোরে দেখতে পেল কেউ চোখ ধাঁধানো পোষাক পরে ডাইনিংয়ে একটা চামচ রেখে দরজা গলিয়ে চলে যাচ্ছে৷ গা ও পোষাকের উজ্জ্বলতা এতটাই প্রখর যে চেহারা বোঝার কোনো উপায় নেই৷ অগত্যা আড়মোড়া ভেঙেই জ্যাক ডাকতে চাইল তাকে।

বিছানা থেকে উঠতে যাবে এমন সময়ই এক অতিমানবীয় শক্তি টেনে ধরল জ্যাককে। মুখে হাত রেখে বলল, “সাবধান! অপেক্ষা কর। ওটাকে আমিও দেখেছি৷ তোমার চামচ বিছানাতেই আছে৷ দুশ্চিন্তা কর না।” সম্বিৎ ফিরে ও ভয়ে চুপসে আছে৷ কারণ, বাসায় জ্যাক ছাড়া দ্বিতীয় কোনো জীব নেই। স্পষ্টভাবেই দরজা লাগানোর কথা মনে করতে পারছে ও৷ তাহলে জ্বলজ্যান্ত দুইজন মানুষ কীভাবে ঢুকল? তাও আবার মানুষ দুইজন একে পরের অস্তিত্ব সম্পর্কেও অজ্ঞ৷ কী হতে যাচ্ছে তাহলে?


এক.

সকাল আটটা৷ বিছানা ছেড়ে উঠল জ্যাক। শরীরটা অন্যদিনের তুলনায় একটু বেশি সতেজ। তবুও রাতে ঘোর কাটেনি এখনও৷ প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে রাতের ঘটনা পুরোটা মনে পড়ল ওর৷ বিছানায় কোনো সুস্থ মানুষ চামচ নিয়ে ঘুমায় না। বাচ্চারাও এই কাজ খেলার ছলে করে না৷ তবে কি শুধুই স্বপ্ন ছিল ওটা৷ উত্তর খুঁজতে খুঁজতে আবার বিছানার দিকে এল ও৷ বালিশের পাশেই জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে আছে রূপার চামচ টা৷

দীর্ঘদিন যাবত ক্যান্সারে ভুগছিল জ্যাক। ইংল্যান্ডের নামীদামী ডাক্তার ব্যর্থ হয়েছে৷ বড্ড দেরি হয়ে গেছে চিকিৎসা নিতে৷ উপরন্তু একা মানুষ হিসেবে শরীরের যত্নও নেই। তাই হাল ছেড়ে বসে মৃত্যুর জন্য দিন গুনতে শুরু করেছিল ও৷ এমতাবস্থায় হঠাৎ একদিন অদৃশ্য থেকে শব্দ ভেসে এসেছিল৷ ওকে বলা হলো, ভিন্ন এক চিকিৎসার কথা। কখনও কখনও বিজ্ঞান যেখানে মাথানত করে প্রকৃতি সেখানে মাথা তুলে দাঁড়ায়৷ ওর ব্যাপারেও এমনটাই ঘটেছিল৷ অদৃশ্য শব্দের নির্দেশনা পেয়ে ও চলে এসেছিল ভারতে চিকিৎসার খোঁজে। তবে ভাগ্য তখনও সুপ্রসন্ন ছিল না৷ ওকে বলা হয়েছিল ধ্বংসাত্মক এক নদীর মাঝে জেগে ওঠা চরে বসবাসরত একটা গোত্রেই মিলবে সেই অমূল্য রতন৷ তাদের কাছে পৌঁছাতে পারলেই হবে৷ লাগবে না কোনো টাকা পয়সা৷ কিন্তু সে যাত্রা সহজ ছিল না৷

ভারতের বিখ্যাত নদ-নদীগুলোর আদ্যোপান্ত তালাশ করে যখন ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাচ্ছিল তখনই মনে পড়ল একদা ভারতের অন্তর্ভুক্ত ছিল বাংলাদেশ৷ যা এখনও নদীমাতৃক দেশ হিসেবে পরিচিত।বাংলায় এসেই ও বুঝতে পারল দুই দেশের পার্থক্য। শুরু হলো আবার সেই ঔষধের সন্ধান। পদ্মা-মেঘনার অসংখ্য চর ঘুরে জ্যাক যখন হাল ছেড়ে দিতে যাচ্ছে তখন অজপাড়াগাঁয়ের এক জেলে তাকে জানালো যমুনার কালো পানির কথা৷ টনক নড়ে জ্যাকের৷ ধ্বংস সবসময়ই বাহ্যিক হতে হবে— এমন তো শর্ত নেই৷ শক্তি আর সামর্থ্যের শেষ বিন্দু নিয়ে ও বেরিয়ে গেল আবার।

যাত্রাটা খুব সহজ ছিল না। বলা হয় তপস্যার ফল মেলে শেষ পর্যায়৷ জ্যাকেরও সেই দশাই হয়েছিল। পূর্ণিমার এক রাতে যমুনার প্রলয়ঙ্কারী ঝড়ের মুখোমুখি হয় জ্যাক৷ তীব্র ঝড়ের দাপটে ওদের নৌকা নদীর ঘূর্ণিপাকে হারিয়ে যায়৷ এর চেয়ে বেশি কিছু মনে নেই। এক সপ্তাহ পরে চেতনা ফিরে এলে নিজেকে এক কুড়ে ঘরে আবিষ্কার করেছিল ও। ওর চিকিৎসা যত্নআত্তিও করছিল সভ্য দুনিয়ার মানুষ৷ সজীবতা ফিরে পেয়ে বুঝতে পারছিল, অবস্থা আগের থেকে বেশ উন্নতি হয়েছে। কালক্ষেপণ না করে রহস্য খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে ও। তেমন সহায়তা অবশ্য পায়নি কোথাও৷ কেউ তাকে সে রাতের কথা খুলে বলেনি।

দিন দশেক পার হওয়ার পরেও সে চরের লোকজন কোনো ইংরেজি শিক্ষিত ব্যক্তি ডেকে এনে তার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা জরুরি মনে করেনি৷ সে দিনের কথা খুব ভালো করেই মনে আছে ওর৷ দুপুরের প্রখর রোদে নদীর কিনারে বসে যখন বিষণ্ণ সময় কাটাচ্ছিল তখন এক বৃদ্ধ এসে ওর হারিয়ে যাওয়া ব্যাগপ্যাক ফিরিয়ে দিল৷ একদম আগের মতো চকচকে অবস্থায়৷ সাথে হাতে বানানো পাটের ব্যাগে এক কৌটা ঔষধি গুড়ো, রূপোর চামচ আর একটা চিরকুট দিয়েছিল৷ ইশারা করেছিল সেটা যেন ও কাউকে দিয়ে পড়িয়ে নেয় শহরে৷

জ্যাক সেদিনই ফিরে এসেছিল। ব্যাগে তার পাসপোর্ট ছিল ঠিকঠাক। ভারত আসার সময় যে পরিমাণ ডলার নিয়ে এসেছিল ঠিক যেন সেগুলোই আবার তার কাছে ফিরে এসেছে। এ যেন ঘুমের ঘোরে স্বপ্নের মতো অবস্থা ছিল তার৷ শহরে এসে সর্বপ্রথম সেই চিরকুটটার পাঠোদ্ধার করে ফেলেছিল ও৷ ওটায় লেখাছিল, প্রতিদিন রাত তিনটে পনের মিনিটে এই চামচের এক চামচ গুড়ো শুকনো চিবিয়ে খাবেন। চল্লিশ দিনের মধ্যে এটা শেষ করবেন। উল্লেখ্য, কখনও কিছু জানার উদ্দেশ্য এখানে আসার ভুল করবেন না। সুখে থাকুন।”

দুই.
ঠিক চল্লিশ দিনের মাথায় ঘটনাটা ঘটেছে৷ জ্যাক আগে কখনও সেই চামচ বা অপ্রত্যাশিত কিছু বিছানায় নিয়ে ঘুমায়নি৷ এমন অভ্যাসও তার নেই। আজ নিশ্চিতভাবেই কিছু একটা হয়েছে। জীবনের শেষ দিনগুলোর জন্য যখন ও অপেক্ষা করছিল তখন যে কণ্ঠটা ওকে আবার বেঁচে ওঠার তাগিদ দিয়েছিল আজও ঠিক সেই কণ্ঠটা তাকে সাবধান করছে। অতিমানবীয় শক্তি দিয়ে চেপে ধরেছিল৷

চামচটা হাতে নিয়ে অদৃশ্য শক্তির কথা ভাবতে ভাবতে ওর খেয়াল হলো ডাইনিংয়ে রেখে যাওয়া চামচটাও একবার দেখা দরকার। ডান হাতে রূপোর চামটা নিয়ে বেডরুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিংয়ে গেল জ্যাক৷ টেবিলের উপর উলটো করে রাখা পাথরের চামচ৷ জ্যাক প্রচণ্ড ভয়ের মধ্যে থেকে সাহস যুগিয়ে চামচ হাতে নিল৷ নাহ, স্বপ্ন দেখছে না ও৷ চামচটার অস্তিত্ব বাস্তবই৷ তবে চামচের চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে অল্প কিছু সময় আগেই এটা ব্যবহার করা হয়েছে৷ তবে হাতের ছোয়া বলছে এটা এই যুগের কিছু নয়।

কালক্ষেপণ না করে জ্যাক ওর ছোটবেলার বন্ধু অলিভারকে ফোন দিল। এর একটা বিহিত করাই দরকার৷ অলিভার অদৃশ্য শব্দের কাহিনী ছাড়া পুরো ঘটনাই আদ্যোপান্ত জানে৷ জ্যাকের সাথে ঘটে যাওয়া এই অদ্ভুত কাহিনী আর কেউ বিশ্বাস না করলেও অলিভার অন্ততঃ হেসে উড়িয়ে দেবে না। “হ্যালো! কী অবস্থা বন্ধু? কেমন আছ?”ফোনের ওপাশ থেকে অলিভার বলল।

“আপাতত ভালো নেই। তুমি কি একটু আসতে পারবে? এখনই দরকার।”

“আসছি। আমি অফিসের জন্যই বেরিয়েছি৷ অতীব গুরুত্বপূর্ণ কিছু হলে বলে ফেল৷”

“আসলে কীভাবে বলল বুঝতে পারছি না। আমি একটা বিষয় তোমার কাছে গোপন করেছিলাম। ভেবেছিলাম শুনলে হয়তো হাসবে। এখন মনে হচ্ছে বলতেই হবে। তুমি এসো আগে এরপর বলছি।”

“আচ্ছা, আমি রাস্তায় আছি। আসছি।”

তিন.
হন্তদন্ত হয়ে অলিভার বাসায় ঢুকল৷ জ্যাক চামচ দুটো হাতে নিয়ে চিন্তিত অবস্থায় বসে আছে চেয়ারে৷ ডাইনিং টেবিলের উপর সেই পাটের তৈরি ব্যাগ, হাতে লেখা চিরকুট আর ঔষধের খালি কৌটা৷ বিধ্বস্ত জ্যাককে দেখে অলিভার জিজ্ঞেস করল, “জ্যাক তুমি ঠিক আছ তো?”

সম্বিৎ ফিরে পেয়ে জ্যাক বলল, “কে? ওহ হ্যাঁ৷ অলিভার এসেছ তুমি!”

“হ্যাঁ, আমি তোমার সামনেই আছি৷ কিন্তু তোমার অবস্থা তো সুবিধের মনে হচ্ছে না৷ ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাব? চল তাহলে৷”

“না না, আমি ঠিক আছি৷ কিন্তু...”

“সত্যিই তুমি ঠিক আছ? কী হয়েছে বল তো?” অলিভার জিজ্ঞেস করল।

“অনেক কিছুই হয়েছে৷ একটু বস।”কেশে গলা পরিষ্কার করে বলতে লাগল, “আমার ভারত ট্যুর আর বাংলাদেশে থেকে ফেরার ঘটনা তুমি পুরোটাই তো জান। তবে আমি শুরুর দিকে একটা কথা বলিনি তোমাকে। বাংলাদেশ থেকে ফেরার পথে আমার ব্যাগে সমপরিমাণ ডলার পাওয়াটা কাকতালীয় মনে হলেও এখন সেটা সুবিধের মনে হচ্ছে না৷ আমার মনে হয় কোনো অদৃশ্য শক্তি আমায় নির্দেশ দিচ্ছে৷ আমায় পরিচালনা করছে...”

অলিভার পুরো ঘটনাটা শোনার পর স্তব্ধ হয়ে বসে আছে৷ কারও মুখে কোনো কথা সরছে না। জ্যাকের সাথে ঘটে যাওয়া কাহিনীকে কোনোভাবেই স্বপ্ন বলে ফেলে দেয়ার সুযোগ নেই৷ উপরন্তু জ্বলজ্যান্ত একটা প্রমাণ পাওয়া গেছে৷

ঘড়ির কাটা দেখে সম্বিৎ ফেরে অলিভারের৷ ও বলে ওঠে, “উম্ম, অবস্থাটা ক্রিটিকাল। আপাতত এর সমাধান আমি ভাবতে পারছি না৷ তবে আমি একটা বিষয় সুপারিশ করতে পারি৷ তুমি যদি ভালো মনে করো তবে আমি পাথরের টুকরোটা নিয়ে যেতে চাই৷ আমার ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখতে পারি। আশাকরি, কোনো একটা ফল পাওয়া যাবে৷”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, সেটাই ভালো৷ তাহলে শুধু এটা না। সবকিছুই নিয়ে যাও৷ দুটো চামচই নিয়ে যাও। সাথে পাটের ব্যাগ আর ঔষধের খালি কৌটাটাও। আর যত দ্রুত সম্ভব আমাকে জানাবে।”

চার.
চারদিন পর রাত দশটা। দরজায় কড়া নেড়ে বাসায় ঢুকল অলিভার৷ জ্যাক পড়ার টেবিলে উবু হয়ে পড়ে আছে৷ দুজনের ক্লান্ত বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে এতরাতে কোনো কথা বলার আগ্রহ না থাকলেও ইতিহাসের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে অলিভারের আর তর সইছে না। আলতো করে কপালে হাত বুলিয়ে অলিভার ডাকল, “জ্যাক, জ্যাক! ওঠো জলদি।”

“তুমি এসেছে? কখন এলে?” ঢুলুঢুলু চোখ নিয়ে জ্যাক জিজ্ঞেস করল৷

“কেবলই এলাম। ফ্রেশ হয়ে ঘুম ছেড়ে নাও। গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।”

“লাগবে না৷ বলে ফেল।”

“জ্যাক! আমাদের সামনে মানবজাতির ইতিহাসের নতুন একটা দিগন্ত উন্মোচন হতে যাচ্ছে। গিলগামেশকে বলা হতো পৃথিবীর সর্বপ্রথম মহাকাব্য৷ যা আনুমানিক খ্রীস্টপূর্বে ২০০০ সালে রচিত৷ কিন্তু এখন নিওলিথিক যুগের মহাকাব্য আমাদের হাতে এসেছে!” কোনো ভূমিকা ছাড়াই অলিভার বলে ফেলল৷

“কী সব আবোলতাবোল বকছ তুমি? মদ গিলেছ কয় বোতল সেটা বল?”

“আরে শুনো আমার কথা আগে৷ আমাদের হাতে এখন এমন তথ্যাদি এসেছে যা ইতিহাস গতিপথ পালটে দেবে৷”

“মানে?"

“শুনো, বলছি৷ আমি সর্বপ্রথমে তোমার ঔষধি গুড়োর কৌটা থেকে গুড়ো নিয়ে পরীক্ষা করতে ল্যাবে পাঠাই। ধারণা করছিলাম, বাঙ্গালীরা কোনো ধরনের স্থানীয় মাদক মিশিয়ে তোমার ভ্রমের সৃষ্টি করেছে। তবে প্রাথমিক টেস্টে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি৷ ধারণা করছি তোমার ঐ ঔষধি গুড়ো আসলেই ক্যান্সার প্রতিরোধে কার্যকরী৷ খুব দ্রুতই আমরা সেটা জানতে পারব৷

আমার প্রথম ধারণা যখন ভুল প্রমাণ হলো তখন বাধ্য হয়েই তোমার জিনিসপত্র আমার ল্যাবে নিয়ে গেলাম। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় দুনিয়া জোড়া আমার ল্যাবের খ্যাতির খবর তুমি ভালো করেই জানো৷ আমি আর দেরি না করে অন্যান্য সব কাজ থামিয়ে দিলাম। সবার প্রথমে তোমার পাথর টুকরোটা পরীক্ষা করলাম। যা পেলাম তাতে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ৷ এই আকৃতিতে পাথরের বয়স অন্তত বারো হাজার বছর পার হয়েছে৷ তার মানে নিওলিথিক যুগের একটা পাত্র এটা৷ আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এখন পর্যন্ত এটা ব্যবহৃত। এর থেকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট উদ্ধার করার চেষ্টা করা হয়েছে৷ আমরা দু'জনের ছাপ পেয়েছি৷ একটা তোমার৷ আরেকটা অদ্ভুতরকমের৷ মনে হচ্ছে কিছু দিয়ে ঝলসে দেয়া হয়েছে৷ কে বা কারা এটা করেছে সেটা নিয়ে দুনিয়ার বিস্ময় ছিল আমাদের৷ কিন্তু মহাকাব্যের পাঠোদ্ধার করার আমাদের বিস্ময় ভয়ে রূপ নিয়েছে।”

“কেন? কী হয়েছে? মহাকাব্যই বা পেলে কোথায়?"

“বলছি। এরপর তোমার রূপোর চামচ পরীক্ষা করি আমরা। এটা সাধারণ কোনো রূপা নয়৷ এটাকে ঠিক রূপা বলাও অনুচিত৷ স্বর্ণ ও রূপার মাঝামাঝি কিছু হবে। যার সন্ধান দুনিয়াবাসী এই প্রথম পেল৷ তবে এর সময় কাল নির্ধারণ করতে গিয়েও আমাদের বেগ পেতে হয়েছে৷ চার চার বার পরীক্ষা করার হয়েছে৷ আমরা প্রতিবার একই ফলাফল পেয়েছি৷ পাথরের চামচ আর রূপার চামচ উভয়টা একই সময়কালের৷ তুমি ভাবতে পারছ? নিওলিথিক যুগের মানুষ রূপার থেকে উন্নত ধাতু ব্যবহার করত!” আবেগে ফেটে পড়ল অলিভার।

“পাগল নাকি?! কেউ রূপার মতো ধাতু ব্যবহার করতে জানলে পাথরের কাছে যাবে কেন? বিদ্যা ভ্রম হয়েছিল নাকি?”

“প্রশ্নটা লজিক্যাল। কিন্তু কথা হলো মানুষ কখনও কখনও বিদ্যা ভুলে যায়৷ যেমন একটা সময় মিশরীয়রা মমি বানাতে পারত; কিন্তু এখন আর পারে না৷ মানে ভুলে গেছে৷ তো তিন চার হাজার বছরে পরে গিয়ে মানুষ এটা নিয়েও তর্ক করতে পারে যে মিশরীয়রা কোনোদিন মমি বানালে ভুলে গেল কেমনে? অথচ আমরা বিশ্বাস করি যে, তারা পারত মমি বানাতে। আবার মিশরের মতো সব জায়গায় মমি বানাতও না। কয়েক হাজার বছর পরে এটাও প্রশ্ন করতে পারে যে মানবজাতি মমি বানানোর বিদ্যা জানার পরেও কেন লাশ কবর দিত? তারা চাইলে তো মমি বানিয়ে স্মৃতি হিসেবে সামনেই রাখতে পারত৷ এমন অনেক তর্ক করা যায়। কিন্তু এখানে তেমন কিছু ঘটেনি।”

“মানে?” আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করল জ্যাক।

“রূপার মতো পদার্থ ব্যবহার করা মানবজাতি বিদ্যা ভুলেনি আসলে৷ তারা হারিয়ে গেছে৷”

“হেয়ালি বাদ দিয়ে বুঝিয়ে বল৷”

“আমরা তোমার চামচ পরীক্ষা করে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ঠিক তখনই পাটের ব্যাগের কথা মনে পড়ল৷ ওটা দেখতে সাধারণ পাটের ব্যাগ মনে হলেও ওখানে কিছু একটা ছিল৷ ব্যাগের তলায় সেলাই করা কিছু একটা বোঝা যাচ্ছিল৷ সেটা খুলে আমরা স্লেটের মতো তেরটা টুকরো পাই। বিশেষভাবে পাঠ দিয়েই তৈরি। এবং সেই স্লেটে কিছু একটা লেখা৷ তুমি জানো, আমরা রিসেন্ট সময়ে সিন্ধু সভ্যতার রহস্য বের করতে সক্ষম হয়েছি৷ ভারতীয় লিপির পাঠোদ্ধার করায় অনেক কিছু জানা সম্ভব হয়েছে৷ আমাদের স্পেশালিস্টরা এই স্লেটের লিপির পাঠোদ্ধার করতে পেরেছে দ্রুতই৷ চারদিন লাগাতার পরিশ্রম করে আমরা সফল। এই তেরটি স্লেটে তিনশো পঁয়ষট্টিটি পঙক্তি আছে৷ অর্থাৎ, আমি বলতে চাচ্ছি নিওলিথিক যুগের মানুষ লিখতেও জানত এবং দিন গণনা করতেও জানত৷ আমাদের ধারণা এটা এক বছর সময় নিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে একটা ভবিষ্যৎবাণী করে গেছে।”

“কীসের ভবিষ্যৎবাণী?”

“পঙক্তি পাঠোদ্ধার করে আমরা বুঝতে পারছি বামিঙ্গিয়ান রাজা শাস্তি স্বরূপ দুরাচারী একদল মানুষকে রশদ বিহীন অবস্থায় বরফাচ্ছাদিত জঙ্গলে ফেলে আসে৷ রাজার ইচ্ছে ছিল তাদের হত্যা করার। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বা এমন কোনো নেতৃস্থানীয় লোক মৃত্যুর শাস্তি কমিয়ে এনে তাদের নির্বাসনে পাঠায়। এরপরই রাজা স্বপ্নে দেখেন, একদল মানুষের কারণে তার রাজ্য ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গেছে৷ তখন থেকেই রাজা তার সাম্রাজ্য বাঁচানোর জন্য উঠেপড়ে লাগেন৷ এটা দিয়ে কাহিনী শুরু হলেও শেষে কী হয়েছে জানা যায়নি৷ তিনি সাম্রাজ্য রক্ষার্থেই এই ভবিষ্যৎবাণীটা করেন। রাজা বামিঙ্গিয়ান মহাকাব্য শুরু করেন কেন তিনি এই প্রফেসি করলেন সেটার জবাব দিয়ে৷ মাঝে বর্ণনা করেন বামিঙ্গিয়ান সাম্রাজ্যে কীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হয়। এবং সর্বশেষে বলেন প্রতিশ্রুত ব্যক্তি যখন আসবে তখন বামিঙ্গিয়ানরা তাকে মেনে নেবে এবং সেই দুরাচারীদের সাথে অসম যুদ্ধে লিপ্ত হবে।”

“ওয়াও, জোস তো কাহিনী! বামিঙ্গিয়ান অঞ্চল কোনটা ছিল সেটা বের করা সম্ভব হয়েছে?”

“কাহিনী এখনও শেষ হয়নি। পাটের তৈরি বিশেষ জিনিস মানেই নিঃসন্দেহে সেটা এশিয়ার। এমনকি বাস্তবে বাংলার সাথে বামিঙ্গিয়ানের মিল পাওয়া যায়। অর্থাৎ বাংলায় ছিল বামিঙ্গিয়ান অঞ্চল৷ কিন্তু এটা ইতিহাসের পুরোটা সময় টিকে থাকতে পারেনি সে ব্যাপারে আমরা প্রায় নিশ্চিত। খুব সম্ভবত নদী কিংবা সাগরের তলদেশে বামিঙ্গিয়ান অঞ্চল হারিয়ে গেছে৷ তবে বামিঙ্গিয়ান লোকজন তাদের প্রতিশ্রুত ব্যক্তির জন্য কোনো না কোনোভাবে রাজার প্রফেসি ধরে রেখেছে। হতে পারে তারা হাজার হাজার বছরে যাবত এই প্রফেসির অধীনে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ আর এই প্রফেসি অনুযায়ী সমগ্র মানবজাতির মধ্যে যারা বামিঙ্গিয়ান সাম্রাজ্যের পতনের কাজ করেছে তাদের সাথেই সেই প্রতিশ্রুত ব্যক্তি অসম যুদ্ধে লিপ্ত হবেন। আরও ভালোভাবে বললে বলা যায়, দুনিয়ার নিওলিথিক যুগের সকল মানুষরাই মূলত বামিঙ্গিয়ান সাম্রাজ্যের শত্রু।”

“হলি শীট! তার মানে বর্তমান মানবজাতিই মূলত বামিঙ্গিয়ানদের শত্রু? ”

“হ্যাঁ।”

“আচ্ছা, বামিঙ্গিয়ানদের প্রতিশ্রুত ব্যক্তির আত্মপ্রকাশ কীভাবে ঘটবে এ ব্যাপারে কিছু লিখা আছে?” জ্যাক জিজ্ঞেস করল।।

“অবশ্যই। তিনি হবে মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে ঘুরে আসা ব্যক্তি৷ বামিঙ্গিয়ানরা তাকে জীবন দিয়ে বাঁচাবে। দুনিয়া জোড়া বিস্ফোরণ হবে। কিছু মানুষ তাকে রাজা হিসেবে মেনে নেবে আর আর কিছু মানুষ তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। বামিঙ্গিয়ান প্রফেসি তাকে নিজেই খুঁজে বের করবে। এমনটা লেখা আছে সেখানে৷ ভয়ের ব্যাপার হলো তার আত্মপ্রকাশ হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। ”

“বলো কী?! তুমি এসবে বিশ্বাস করা শুরু করলে কবে থেকে?”

“আজ থেকেই শুরু করেছি৷ প্রফেসির প্রত্যেকটা বিষয় আমার বন্ধুর সাথে মিলে যাচ্ছে। দেখ, ক্যান্সার মানে মৃত্যুর দোরগোড়ায় থেকে ফিরে এসেছ তুমি। তারপর বামিঙ্গিয়ানরা জীবন দিয়ে বাঁচাবে৷ তুমি যমুনায় কীভাবে বেঁচে গেছ সেটা এখনও জানো না। আবার তোমার ব্যাগপ্যাক আর ডলারও ঠিকঠাক ফিরে পেয়েছ৷ একবার ভাবো তো তৃতীয় বিশ্বের দিনমজুর লোকেরা তোমাকে এত পরিমাণ ডলার কীভাবে দেবে? এরপর দুনিয়া জোড়া বিস্ফোরণ হবে। ইতোমধ্যে বিস্ফোরণ হয়ে গেছে বলা যায়৷ ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দিতে যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য আমাদের কাছে আছে। কিন্তু এর ভিত্তি নেই৷ এটা নিয়ে তর্ক হয়ে দুইভাগ হয়ে যাচ্ছে এবং অবশেষে যুদ্ধ অনিবার্য৷ সর্বশেষ বামিঙ্গিয়ান প্রফেসি নিজেই প্রতিশ্রুত ব্যক্তিকে খুঁজে বের করবে৷ আমাকে এখন বল পুরো ঘটনা কীভাবে কাকতালীয় হয়?

জ্যাক অলিভারের প্রশ্নের জবাব খুঁজতে যাবে তখনই অদৃশ্য থেকে আবার আওয়াজ উঠল, অসম যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হে মহারাজ....
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২০
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শোকের উচ্চারণ।

লিখেছেন মনিরা সুলতানা, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সকাল ১০:১৬

নিত্যদিনের জেগে উঠা ঢাকা - সমস্তরাত ভারী যানবাহন টানা কিছুটা ক্লান্ত রাজপথ, ফজরের আজান, বসবাস অযোগ্য শহরের তকমা পাওয়া প্রতিদিনের ভোর। এই শ্রাবণেও ময়লা ভেপে উঠা দুর্গন্ধ নিয়ে জেগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

যা হচ্ছে বা হলো তা কি উপকারে লাগলো?

লিখেছেন রানার ব্লগ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ দুপুর ১:২৮

৫ হাজার মৃত্যু গুজব ছড়াচ্ছে কারা?

মানুষ মারা গিয়েছে বলা ভুল হবে হত্যা করা হয়েছে। করলো কারা? দেশে এখন দুই পক্ষ! একে অপর কে দোষ দিচ্ছে! কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

আন্দোলনের নামে উগ্রতা কাম্য নয় | সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যবাদকে না বলুন

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



প্রথমেই বলে নেয়া প্রয়োজন "বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার সমস্ত অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে" ধীরে ধীরে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে। ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের উপর ভর করে বা ছাত্রদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোন প্রশ্নের কি উত্তর? আপনাদের মতামত।

লিখেছেন নয়া পাঠক, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৬

এখানে মাত্র ৫টি প্রশ্ন রয়েছে আপনাদের নিকট। আপনারা মানে যত মুক্তিযোদ্ধা বা অতিজ্ঞানী, অতিবুদ্ধিমান ব্লগার রয়েছেন এই ব্লগে প্রশ্নটা তাদের নিকট-ই, যদি তারা এর উত্তর না দিতে পারেন, তবে সাধারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকুরী সৃষ্টির ব্যাপারে আমাদের সরকার-প্রধানরা শুরু থেকেই অজ্ঞ ছিলেন

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ রাত ৯:০৭



আমার বাবা চাষী ছিলেন; তখন(১৯৫৭-১৯৬৪ সাল ) চাষ করা খুবই কষ্টকর পেশা ছিলো; আমাদের এলাকাটি চট্টগ্রাম অন্চলের মাঝে মোটামুটি একটু নীচু এলাকা, বর্ষায় পানি জমে থাকতো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×