ঝালমুড়ি আমার খুব প্রিয়। তবে শাকসবজি ছাড়া অন্য কোন খাবার যে আমার প্রিয় না, তা আমার বন্ধুরাই বলতে পারবে। যাইহোক, গুলিস্থান হতে বাসায় ফিরবো, বাসে করে। ব্যাগ এ পানি আছে, তাই সামনে থাকা ঝালমুড়ি খাবার লোভ সামলাতে পারলাম না। নিলাম ১০ টাকার, লবন বেশী দিয়ে। খেতে খেতে দেখালাম প্যাকেটের গায়ে লিখা- এই কুরবানীর ঈদে উৎকৃষ্ট মানের ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল কিনতে চলে আসুন......। কোথায় আসবো আর খুজে পেলাম না। আহারে, ছাগলটা বেশ সুন্দর ছিল। ঝালমুড়ি খাওয়ার পর পানি খেয়ে বরাবরের মতই সিটে হেলান দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতেই, বেজে উঠলো মুঠোফোন। ওপার হতে, “মামা, চলে গেছোস?”
-“এখনো বাসে। ক্যানরে মামা?”
-“আর কইস না। এইবারও চাকরিটা হইলো না।“
-“ক্যানরে? তুইতো পরীক্ষা ভালোই দিছিলি। টাকাওতো দিছিলি। তবে?”
-“তুই বুঝবি না। মালের উপরও মাল আছে। পরে ঢাকা আসলে বলমুনে”।
ওকে বলে দিলাম চোখ বন্ধ করে।
বাস চলতে চলতে কখন ঘুমিয়ে পরলাম, খেয়াল নেই। বাসের ঝাঁকুনিতে, ঘুমটা আধো আধো হয়ে রইলো। কি যেন কি মনে করতে করতে দেখছি আমি এক ছাগলের হাঁটে। সুন্দর সুন্দর, কিন্তু কালো কালো অনেকগুলো ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল। প্রত্যেক মালিক এক একটা করে দুধ দেয়া ছাগল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, বিক্রি করতে নয়, বর্গা দিতে, মানে কিছু দিনের জন্য পালতে। দেখলাম ছাগলের চেয়ে মানুষের সংখ্যা অনেক অনেক বেশী। সবাই চায়, কিছুদিনের জন্য হলেও একটি মাত্র ছাগল পেতে। কিন্তু মালিক কি এতোই বোকা যে যাকে তাকে নিজের ছাগল দেবে? তাই তারা ঠিক করলো যার যোগ্যতা বেশী থাকবে, মানে যার কাছে ছাগল দিলে তার ছাগলটা কিছু দিন খুব ভাল থাকবে, তাকেই দেয়া হবে ছাগলের বর্গা। মানুষ অনেক বেশী, তাই যাচাই বাছাই করা জায়েজ।
আমি কেনো জানি এই যাচাই বাছাই দেখতে আগ্রহী হলাম, অর্ধ ঘুমেই! সবচেয়ে সুন্দর কালো ছাগলের দিকে মনোনিবেশ করলাম। ছাগলের মালিক যথারীতি সবার যোগ্যতা জানতে চাইলো। অর্ধ ঘুমেও আমি কিছুই স্পষ্ট না বুঝলেও, স্বপ্ন দেখা চালিয়ে যেতে চাইলাম। আর দেখতে থাকলাম-
মালিকঃ ছাগলডা আমার বড্ড প্রিয়। খুব ভাল দুধ দেয়। আমার এই এহন এতো গুলা ছাগল লালন পালন করবার পারুম না। জায়গা বেশী নাই। তাই ভাল লালন পালন করবার পারে এমন মানুষের কাছে এডা দিবার চাই কিছু দিনের জন্যে।
আমি ভাবলাম বাকি গুলো লালন পালন করতে পারলে, এই দুধ দেয়াটাকে অন্যের কাছে দিবেন কেন? এই প্রশ্ন না করে ভাবলাম কি দরকার, চালিয়ে যাই স্বপ্ন দেখা। দেখি কে কি বলে, করে।
প্রথম ব্যক্তিঃ আমি ছাগল পালনে প্রশিক্ষিত। এই পরীক্ষায় শতকরা ৯৩ ভাগ নম্বর পেয়েছি। আমি জামানত দিবো। আপনার ছাগলের কিছু হলে, ওটা হতে কেটে রাখবেন।
মালিকঃ খুব ভালো, খুব ভালো। আপনে বাম পাশে আইসা দাঁড়ান। দেহি আর কার কি যইজ্ঞতা।
দ্বিতীয় ব্যক্তিঃ আমি ৬২ ভাগ নম্বর পাইছি। গ্রামের মোড়ল এর সই আছে। দেখেন। দেখেন।
মালিকঃ কন কি? আপনে বাম পাশে বহেনতো।
তৃতীয় ব্যক্তিঃ মালিক সাব, আমি ৩৯ ভাগ, তয় মোড়ল আমার চাচার মামা লাগে।
মালিকঃ ভাই, আপনে এতক্ষণ কোতায় আছিলেন। আপনে বহেন না বাম পাঁশে। এই কেডা আছিস, ভাইরে ঠাণ্ডা জল দে।
চতুর্থ ব্যক্তিঃ আরে মিয়া, নাম্বার টাম্বার দিয়া কি করবেন? হুনেন নাই এক্স ফেকটুর। আর এইডা ছাগলইতো। ঘাস খাইবো আর মোডা অইবো। এইডার লিগা আর কিছু জানা লাগে নি? আমি মোড়লের পোলা, ক্যামনে কি করতে হয়, সব কামের সব কিছুই জানি। কারুরতে হিগন লাগবোনা।
মালিকঃ আপনি মোড়লের পোলা? আগে কইবেন না? এতক্ষণ কই আছিলেন? আরে আপনেরা গেরামের মোড়ল। কোন কাম ক্যামনে হইবো, তা আপনাগো চাইয়া আর কেডায় ভালো জানবো। একটু বহেন ডান পাঁশের চেয়ারে। ওই পানির গেলাস রাইখ্যা ভাইরে বাতাস কর। আর ছাগল? নিয়া যান। দুধ খান। কয়েক মাস বাদে ফেরত দিলেই চলবো। তয়, চাচারে কয়েন আমার দিকে একটু নজর দিতে।
মোড়লের ছেলেঃ এইডা আবার কউন লাগবো নি? ছাগল দিছেন। কাইল বাড়িত আইয়েন। মাংস দিয়া দুপুরে ভাত খাওয়ামুনে আর বাপের লগে কতাও কয়ায় দিমু নে। আমরা কেমন বুইঝা যাইবেন।
মালিকঃ এতো আমার সইভাগ্য।
ঈশ! বেটা হেল্পার। চীৎকার করে আমার বাস হতে নামার জায়গার নাম বলল। স্বপ্ন নাকি কল্পনা, যেটাই হোক পুরোপুরি হয়ত দেখতে পারলাম না। বাস হতে নেমে, হাঁটতে হাঁটতে কেনো যেন ভাবতে লাগলাম, যে ছাগলের মালিক কে কি ছাগলের মাংস খাওয়াবে?
বাসার দরওয়াজায় শব্দ করতে করতে, আবার আমার সেই চাকরী প্রার্থী বন্ধু ফোন দিল। ফোনটা ধরতে ধরতেই আমি মনে মনে বললাম যে, আমি মনে হয় আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গিয়েছি।