গতকাল একটি বিয়েতে গিয়েছিলাম। আসা যাওয়া মিলে মোট প্রায় ৫০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম বিয়েতে। বিবাহ ছিল আমার মাস্টার্সের মেন্টর Assoc. Prof. Dr. Alaaddin F. Paksoy এর। কনে নিজেও একজন University শিক্ষক।
বিয়েতে যাওয়া আসলে কৃতজ্ঞতা থেকেই। কারন অনেক বিপত্তির পথে তার বাড়িয়ে দেয়া হাতের কারনেই আসলে কোন অতিরিক্ত সময় ছাড়াই যথা সময়ে আমার থিসিস শেষ হয়েছিল। জীবনে শিখেছি অনেক কিছু।
আসলে একজন মেন্টর তার ছাত্রকে জ্ঞানের থেকেও যা বেশী দিতে পারে তা হচ্ছে মোটিভেশন। তবে আমার প্রোফেসর আমাকে কখনও ৩০ সেকেন্ডের বেশী মোটিভেশন দেয় নাই। শুনতে খুব অবাক হলেও এটাই সত্য। আসলে উনি আমাকে কিছু বলার চেয়ে তার আচরন দিয়ে এটা বুঝাতে পরেছিলেন যে সে আমার সাথে আছে।
একটা ছোট উদাহরন দেই; যেহেতু আমার কাজটা ছিল বাংলাদেশ এবং তার্কিকে নিয়ে, তাই গভেষনার কাজে প্রায় ৭ মাস বাংলাদেশে ছিলাম। সেখানে অনেক মানুষের সাথে শহর শহর ঘুরে সাক্ষাতকার নিতে হয়েছিল। আর আমি আসলে যাদের সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম তারা আসলে সামাজিক ভাবে এলিট শ্রেনী আর কর্ম বিবেচনায় অনেক ব্যস্ত মানুষ। সেই সাথে আমার পরিচিতির অভাবে প্রথম ৩ মাস আমি আসলে লিংক তৈরির কাজে ব্যস্ত ছিলাম। কিন্তু ৩ মাসেও যখন কোন কিনারা করতে পারছিলাম না- একদিন সন্ধায় তাকে নক দিয়ে বললাম আপনার সাথে আমার জরুরী কথা আছে। তাকে সব বর্ননা করলাম। এটাও বললাম যে, আমি অনেক হতাশ। আমি বোধায় এখানের সাক্ষাতকারগুলো নিতে পারব না।
উনি আমাকে শুধু এটাই বললেন; "মশিউর, এটাই দুনিয়ার শেষ না। তুমি চেষ্টা করছ আরো একটু কর। যদি একান্তই না পার আমরা আমাদের প্রোপজাল কে নতুন ভাবে সাজাব। যা আমাদের চেষ্টার পরেও হবে না সেগুলো আমাদের হাতে না"। আমি আবার নেমে পরলাম। এবং সত্যি আমি সফল হয়েছিলাম।
এরপর তার্কিতে ফিরে এসে বাকি সাক্ষাৎকারগুলো নিতে এবং সেগুলো ডিকোড করতে করতে পারায় জুন মাস চলে এলো। আমাকে জুলাই মাসে ডিফেন্স করতে হবে সময় মত শেষ করতে হলে। উনি তখন আমাকে শুধু বলেছিলেন; "এই একমাসে এনালাইসিস সহ থিসিস লেখা অন্য কোন ছাত্রের জন্য সম্ভব না। তবে তুমি যদি এখনও অনার্সের মশিউর হয়ে থাক তুমি পারবে"। বলে রাখি যেহেতু আমি অনার্সও এখানেই করেছি তাই আগে থেকে চিনতেন। তবে অনার্সের ৪ বছরে আমি তার থেকে ১ টা কোর্স নিয়েছিলাম। তবে ফাস্ট হওয়ার কারনে চেনার বিষয়টা আরো পরিপক্ক হয়েছিল। আমি পেরেছিলাম। ২৩২ পৃষ্ঠার থিসিস আমি ১ মাসেই লিখে শেষ করেছিলাম।
যাইহোক টিচারের, আমার উপর ভরসা দেখে আমি আসল অনেক দায়ভার ফিল করছিলাম। তাকে সেদিন বলেছিলাম, "প্রোফেসর, আমি শেষ করবই"।
আমি শুরু করলাম আমার কাজ। দৈনিক প্রায় ১৬-১৭ ঘন্টা একটানা কাজ করেছি। আর উনি প্রতি ৪ দিনে আমার সাথে ১ বার অনলাইনে জয়েন হতেন। কাজ দেখতেন এবং নির্দেশনা দিতেন।
সব ঠিক মতই চলছিল। তবে এর মধ্যেই আবার আমাদের সন্তান নির্ধারিত সময়ের ঠিক ১ মাস আগে সিজারে জন্মদান করাতে হল। যার অর্থ হচ্ছে পরের কাজ আগে চলে এলো। এই সময়ে আমি হাসপাতালের বারান্দায় বসেও থিসিস লিখেছি। কারন আমার স্ত্রী হয়তো এতে আমি তাদের থেকে থিসিসকে বেশী গুরুত্ব দিচ্ছি এটা মনে করতে পারে কিন্তু আমি সাময়িকের পেছনে আমার স্থায়ীত্ব নষ্ট করতে চাই নাই। কারন আমি জানতাম এখন আমি এটা না করলে আমাকে ১ বছর প্রায় লস হবে। তাই আনন্দ পরেই করি। যা আমি এখন করি।
যাইহোক, শিক্ষকের মোটিভেশানে আমি সময়মতই শেষ করলাম। আমি লিখে লিখে তাকে নিত্য পাঠাতাম আর সে পড়ার সাথে সাথে ভাষাগত ত্রুটিও ঠিক করে দিতেন। একদিন বলছিলেন, " রাত ২ টায় আমি তোমার থিসিস পড়ছি দেখে আমার মা সব বাসার সবাই বেশ অবাকই হচ্ছিল। সেই সাথে বিবাহের আয়োজন কেন্দ্রিক আমার ব্যস্ততা তো আছেই"।
আমি তার প্রমানও পেলাম। কাল বিয়েতে তার মায়ের কাছে যেতেই আমাকে বলল, "তুমি বাংলাদেশী সেই ছেলেটা না? কিছুদিন আগে পাশ করেছ?" আমি হা বলার আগেই বলল, " আমি তোমাকে চিনি, আলাদ্দিন আমাদের তোমার ছবি দেখিয়েছে। তোমাকে জুব্বা পরিয়ে দিচ্ছিল"। তার ভাই যে নিজেও কিনা একজন প্রফেসর। সেও এসে বললেন, তোমার ছবি আমি আগে দেখেছি। আলাদ্দিন দেখিয়েছিল। বেশী অবাক হলাম যখন তার নতুন শশুর আমাকে এসে মশিউর বলে ডাক দিলেন- আর বললেন সেও আমাকে চিনে। আমার প্রোফেসার আমার গল্প করেছে।
বিষয়টা আসলে এমন না যে আমি তার প্রথম ছাত্র যার সে মেন্টর ছিল। এর আগে অসংখ্য PhD, মাস্টার্স ছাত্রদের থিসিসে সে মেন্টর ছিলেন এবং সফল হয়েছিলেন। হয়তো তাদের নিয়েও তার এই আবেগ ছিল।
এতবড় গল্প বলার পেছনে আসলে কারন এটাই যে, একজন প্রোফেসার কিভাবে তার ছাত্রদের মূল্যায়ন করেন, কিভাবে সহযোগিতা করেন এবং কিভাবে পাশে দাড়ান- এটা বুঝানোর জন্য। আমি কৃতজ্ঞ।।