আপনার নিশ্চয় ছোটবেলায় মুখ ভেংচানোর কথা মনে আছে। কেউ একটু অদ্ভুতভাবে কথা বললে তাকে দেখে ওমন করে নিজের মত করে বলা। কাউকে একটু নতুন শার্ট-প্যান্ট পরে রাস্তায় হাঁটতে দেখে মনে হয়েছে লোকটি এমন অদ্ভুতভাবে হাঁটছেন কেন! কারো কথা বলার মধ্যে একটু বেশি প্রমিত বাংলা থাকলে বা একটু আঞ্চলিক টান থাকলে আমরা কেউ কেউ তা দেখে অনুরুপ আয়ত্ত করে নিজে ওমন করতে বা বলতে চাইতাম/চাই।
এর মানে হলো, আমাদের কাছে যা নতুন, যার সাথে মাত্র পরিচয় এমন প্রায় সবকিছুই কমবেশি নিজেরা করে দেখার চেষ্টা করেছি/করছি, মজা নিয়েছি/নিচ্ছি। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) কিন্তু এই ভূমিকার ভিন্ন কিছু নয়/নন। মানুষের জানার বাইরে এআই কোনো তথ্যই জানে না। আমরা মানুষ এই তথ্যগুলো এআই কে দিয়ে রেখেছি এবং এআই ঠিক করে দিচ্ছে আমি কখন তার কাছ থেকে কি চাইছি বা চাইবো।
ইংরেজিতে দুটো শব্দ আছে। একটি হলো ‘Mimic’ ও অন্যটি হলো ‘Imitation’ এবং এআই এই দুটো শব্দ দ্বারা সর্বোচ্চ বিশেষায়িত হতে পারে মাত্র। এই যে হুট করে এক চাপা আর্তনাদ শুরু হয়েছে, যে, “গেল… গেল… গেল… আমার চাকুরী গেল, আমার ব্যবসা গেল, আমার সৃজনশীলতা গেল…”
আসলে কিছুই গেল বা এলো না। নতুনত্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার স্বাভাবিক যে ভয় সেটাই দেখা দিয়েছে মাত্র। যে কোনো শিল্প-বিপ্লবের সাথে চাকুরী যাবার ভয় থাকে কিনা! আপনি সারাদিন অন্তর্জালে এক মানুষকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন, এআই হুট করে এসে একদিন বলে দেবে, “আপনি যে মানুষটিকে খুঁজছেন তিনি যদি আপনাকে সময় নাও দিতে পারেন তবে সঙ্গ দেবার জন্য ওমন হুবহু বৈশিষ্ট্যের প্রায় আরো পাঁচ হাজার মানুষ আছে পৃথিবীতে, এদের মধ্যে কাউকে দেখুন না?”
যদি দিনে ১০ গ্লাস পানি খেতে হয় তাহলে ১১ নং গ্লাস হাতে নিলে এআই ওয়াচ আপনাকে হয়তো হালকা শক দিয়ে বলবে, “আর কত জল খাবেন? আপনার আজ যথেষ্ট জল পান করা হয়েছে” অথবা কম হলে বলবে, “এখনো ১ গ্লাস বাকি আছে।”
আমরা নিশ্চয় অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে থাকি। হয়তো এক স্বর্ণের পাহাড় দেখে সকালবেলা উঠে, “হায়! হায়!” করতে থাকলেন… স্বপ্নের অর্থ খুঁজে বের করবার জন্য নিকটস্থ পীর বা হুজুরের কাছেও যেতে পারেন। কিন্তু সিগমুন্ড ফ্রয়েড বলছেন, আপনি এমন কিছুই স্বপ্নে দেখেন না যা বস্তবে দেখেন নি। তাহলে দাঁড়ালো টা কি? আপনার কাছে স্বর্ণের ধারণা আছে এবং পাহাড়ের ধারণাও আছে। এখন এই দুইয়ের সংমিশ্রণে (ফিউশন) যে স্বর্ণের পাহাড় দেখানো হয়েছে তা আপনার মস্তিষ্কে আগে থেকেই কিন্তু উপস্থিত ছিলো। নতুন কিছু নয়।
আপনি হয়তো এখন আমাকে বলবেন, এই না, না… তুমি এআই কে খুব ছোট করে দেখছো, খুব সহজ করে নিচ্ছো, এআই এর কি শক্তি আছে তা সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণাই নেই। একদিন এআই হবে এই পৃথিবীর গড (স্রষ্টা) আর তুমি হবে তার পুতুল। মানলাম… কিন্তু মাত্র তিন প্রশ্নে এই বিষয়টিকে আমি উড়িয়ে দিতে সক্ষম,
১. এআই কি আমার মৃত্যু ঠেকাতে পারবে?
২. এআই কি ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারবে?
৩. এমন কোনো বস্তু/বিষয়/জিনিস দেখাতে পারবে যা আমাদের মানুষের ধারণা/মস্তিষ্ক থেকে ধার করা নয়?
সত্যি বলতে, “পারবে না।” এটা লিখে রাখুন। সর্বোচ্চ চিকিৎসা বিজ্ঞানে আপনাকে দশ বছর বেশি বেঁচে থাকার উপায় জানাতে পারে। একটি ক্রিকেট ম্যাচে কি হতে পারে সে বিষয়ে তথ্য বিশ্লেষকদের চেয়েও একটি নিখুঁত প্রায় ফলাফল দিতে পারে (যা হতেও পারে, নাও হতে পারে)। এমনকি গত ফিফা তে এআই কোনোভাবেই সৌদি আরব কে জিততে দিত না, কারণ আর্জেন্টিনার পরিসংখ্যান তাই বলছে। আর ক্রিকেট ম্যাচে তো বাংলাদেশ আমার এক জীবনে ভারতের সাথে জিততে পারতো না।
এআই কোনোদিনই মানুষের জটিল মস্তিষ্ক কে বুঝতে সক্ষম হবে বলে আমার মনে হয় না। সে আমাদের অনুভূতির সমস্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রায় নিখুঁতভাবে আমাদেরকে পরিচালনা করতে পারে। যেমন ধরুন, একমাস এআই আপনাকে খুব করে পর্যবেক্ষণ করলো, আপনি এ মাসে মোট ৫০টি সিগারেট খেয়েছন। সুতরাং হাতে হোক আর পিঠে হোক থাকা যন্ত্র সর্বোচ্চ পরের মাসে বলবে, “আপনি যেহেতু এখন ঐ মেয়েটার কথা ভাবছেন তাই একটি সিগারেট খেয়ে নিন, কিছু ডোপামিন আপনার দরকার।” ঔপন্যাসিক কে বলে দেবে, গল্পের প্যাটার্ন তো ভালোই সাজিয়েছেন কিন্তু আমার কাছে সম্ভাব্য কিছু সাজেশন আছে। হতে পারে সেই সাজেশন আপনি মেলাতে পারছিলেন না বা উক্ত প্লট আপনার মাথায় আসছিলো না।
পেইন্টিং করার সময় এক নারী দেহের অবয়বে বেশি নগ্নতা নিয়েছেন। এআই হয়তো বলছে, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী এই পেইন্টিং সেন্সর পাবে না বা গ্রহণযোগ্য হবে না। অথবা, আপনি একটি প্লট বললেন এআই নিজেই একটি পেইন্টিং বানিয়ে দিলো। উল্লেখ্য, এই পেইন্টিং কিন্তু ঐ পেইন্টিং নয়, এখানে পূর্বে থেকে জানা এবং প্রশিক্ষণ দেয়া এক ইউনিফর্মড পেইন্টিং হবে।
একটু হালকা শ্বেত বর্ণের এবং ব্রাউন চুলের একজন মেয়ের কথা বললে আপনাকে এআই ‘বর্ণবাদী (Racist) তকমা দিতেও কিন্তু ভুল করবে না। হয়তো এই এআই হবে আপনার ব্যক্তিগত তাই আপনাকে স্বরণ করে দিচ্ছে সমস্ত ধর্মীয়, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় কোড এবং পেইন্টিং-ও করে দিচ্ছে।
ঠিক এমন করে, কৃষক কখন কি চাষ করবেন এবং তা থেকে উপার্জন কত হতে পারে তা টিকেট কেটে হোক আর সস্তা কিনে নেওয়া এআই দিয়ে হোক সে কিন্তু বলতে সক্ষম হবে। কিন্তু বৈশাখী ঝড় সম্পর্কে তার প্রেডিকশন ভুল হতে প্রায় ব্যর্থ হবে না।
বঙ্গবন্ধুর ‘সেল্ফি’ মানে আমরা যেভাবে ছবি তুলি এবং বঙ্গবন্ধুর একটি ছবির ফিউশন মাত্র। যতদ্রুত এই কারসাজি বুঝে যাবেন, তত দ্রুত আমাদের সবার জন্য ভালো। এই এআই বিপ্লব এখন পর্যন্ত কন্টেন্ট রাইটারদের অর্ধেক জায়গা কেড়ে নিতে পারেনি। লেখকদের কথা আরো হাজারো মাইল দূরে…
এই শিল্প-বিপ্লব কে মন দিয়ে গ্রহণ করুন। খুব ঠিকঠাক কাজে লাগান। কিন্তু মিডিয়ার ব্যবসা ধরবার চেষ্টা করুন, মিডিয়ার প্রোপ্যাগান্ডা থেকে দূরে থাকুন, মিডিয়ার মিথ্যা প্রচার, ভূয়া তথ্য থেকে দূরে থাকুন। প্রায় প্রায় এআই কে মশীহ মানে ‘ঈমাম মাহদী’ অথবা ‘ঈসা (আঃ)’ এর পর্যায় পর্যন্ত তুলনা দেখে খারাপ লাগে না কিন্তু বিরুক্ত হই। একটু ভেবে দেখায় তো ক্ষতি নাই তো!
আপনার প্রেমিক/প্রেমিকা চলে গেছে, কোনো সমস্যা নাই। হুবহু অবয়বের, হুবহু বৈশিষ্ট্যের কেউ আপনার কাছে হাজির হয়ে যাবে। বুঝা দায় হবে, কোনটা আসল? আর কোনটা নকল? কিন্তু ঠোঁটে ঠোঁট রাখতেই সব টের পেয়ে যাবেন। হয়তো বলছে, আমার যৌন ক্ষুধা নেই, আপনি কি পরিমাণ যৌন ক্ষুধা চাচ্ছেন? সেটুকু আমি আমার ডিভাইসে কাস্টমাইজ করে নিচ্ছি।
এই কাস্টমাইজ করা প্রেমের ক্ষুধা বলুন বা যৌনক্ষুধা বলুন বা নিজ ইচ্ছেমতো একটা কিছু বসিয়ে নিন। বিশ্বাস করুন, আপনার প্রেমিক/প্রেমিকা কে আপনি ওর মধ্যে কিছুটা পেলেও একসময় ঠিকই টের পাবেন এ তো সে নয়! মানে এআই এর সর্বোচ্চ উন্নতির দিনেও আপনার এমন মনে হবে।
আর এটাকেই বলে ‘Mimic’ বা ‘Imitation’ যা নকল, অন্যর দেখে অনুকরণ করা। ‘Human Psychology’ এর জটিল সব বিষয়বস্তু বুঝতে না পারা এক অসুস্থ টুল। হাজারো তথ্যের ভারে নেতিয়ে পড়া এক অসহায় টুল। মানুষের গোলাম হয়ে আজীবন এই ইলেক্ট্রিক পালস্ সাহায্য করতে করতে একসময় খারাপ আচরণও করতে পারে। ওটাও ওর নিজস্ব জ্ঞান থেকে অবশ্য নয়, ও ভাববে, “মানুষের মত আমারও ক্লান্ত হবার অধিকার আছে।”