‘প্রেডিক্টেবল’ মানুষদের প্রতি আমরা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম গুরুত্ব দিয়ে থাকি। আমরা চাই, একজন মানুষের মধ্যে মিস্ট্রি থাকবে, সাসপেন্স থাকবে, থ্রিল থাকবে আর একটু অ্যাডভেঞ্চারাসও হবে। কারণ এই রহস্য এবং অপ্রত্যাশিত তথ্যের উত্তেজনা আমাদেরকে সেই বিশেষ ব্যক্তির প্রতি বেশি আকর্ষিত করায়। তাই আপনি যত বেশি আন-প্রেডিক্টেবল হবেন, মানুষ তত বেশি আপনাকে পছন্দ করবে।
যে মানুষ যত বেশি রহস্যে ভরা, সে মানুষ অন্যের কাছে তত বেশি আকর্ষণীয় এবং আগ্রহের কারণ। এখন আপনি যদি কারো সাথে এক দেখায় আপনার নাড়ী নক্ষত্র সব বলে দেন তবে হিতে বিপরীত তিনি পরবর্তীতে আপনার সাথে সাক্ষাৎ করতেও খুব বেশি আগ্রহ বোধ হয়তো করবেন না। আপনাকে তার সহজলভ্য বলে মনে হতে পারে।
দেখুন, সুন্দর মানুষ টা জানেন যে, তিনি কতটা সুন্দর। জ্ঞানী মানুষটা জানেন যে, তার দৌড় ঠিক কতদূর। সাধারণত এরাই বেশি বেশি বলেন, “আচ্ছা, আমি বোধহয় খুব একটা ভালো দেখতে না তাই আজ অবধি একজন লাইফ পার্টনার জুটলো না!” অথবা, “আমি অতি সাধারণ মানুষ, আমি কি আর অতসব জানি!” কিন্তু তিনি নিজেকে রোজ রোজ আয়নায় দেখছেন, তিনি কোথাও দাঁড়ালে নির্দিষ্ট কিছু মহলের মানুষ তাকে সম্মানও করছেন।
আপনি এখানে ভাববেন, বোধহয় তিনি নিজেকে নিয়ে সন্দিহান। তাই একটু এগিয়ে গিয়ে বলবেন, “না, না… আপনি দেখতে অতটাও খারাপ না! তাছাড়া আমার প্রেমিক/প্রেমিকা না থাকলে আপনাকেই বেছে নিতাম!” উত্তর এরকম বা এর কাছাকাছি কিছু একটি নিশ্চয় আসবে। কারণ তীর টা যিনি নিক্ষেপ করেছেন মনে রাখবেন, তিনি লক্ষ্যও স্থির করেছেন।
কোনো গল্পে বর্ণনাকারী যদি একটি ঘটনাকে এমনভাবে উপস্থাপন করেন যা মোটেই প্রত্যাশিত ছিলো না তখন নিজেকে আপনি অপ্রস্তুত অবস্থায় পাবেন। আপনার ‘ভূত এফএম’ এর রাসেল ভাইয়ের কথা মনে পড়ে যাবে। কারণ হঠাৎ করে এমনকিছু তথ্যের অবতারণা আপনার প্রত্যাশ্যাকে এলেমেলো করে দিতে সক্ষম।
আপনি হয়তো ভাবছেন, আজ আপনি চাকরি টা ছেড়ে দেবেন। হঠাৎ আপনার বস এসে আপনাকে জানালো যে, “আর মাত্র এক মাস এই কোম্পানিতে কাজ করুন, আপনার বেতন ২৫ হাজার টাকা থেকে ৩৫ হাজার টাকা করে দেবো!” কিন্তু আপনি গত তিন মাস ধরে ভাবছিলেন,
১. এই কোম্পানির ‘Work Environment’ স্বাস্থ্যকর নয়।
২. বেতনও কিছুটা কম
৩. কাজগুলো বেশ বোরিং!
স্টার্টিং জবগুলোর স্যালারির দিকে তাকিয়ে আপনি তো প্রায় ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। হয়তো সেদিনই জব টি ছেড়ে দিতেন। কিন্তু একসাথে ১০,০০০ হাজার টাকার প্রোমোশন! না, এখন আর জব ছাড়তে চাইছেন না। ভাবছেন, এই মূহুর্তে আর অন্য জব নিয়ে না ভাবি!
যদিও এখানে অন্তত দুই ধরণের ফাঁদ আছে। একটি বড়সড় ফাঁদ হচ্ছে, বস আপনাকে টুইস্ট করেছে। কারণ হাজারহোক আপনি ঐ কোম্পানির একজন কর্মী, আপনার সম্পর্কে তিনি (কোম্পানির বস) জ্ঞাত। তাই তিনি টাইমিং বুঝে তীর টা ছুঁড়েছেন। গত তিন মাসে আপনার দ্বারা অন্তত ৩০,০০০ টাকা অতিরিক্ত আয় করেছেন এবং আরো ১০,০০০ টাকা আয় করবেন তাও আপনার সামনে দিয়ে।
‘Gone Girl’ বই অথবা মুভি নিশ্চয় পড়েছেন বা দেখেছেন। এখানে কি দেখানো হচ্ছে বা বলা হচ্ছে? বক্তা/অভিনেত্রী অমি (Amy Dunne) তার স্বামী কে এমনভাবে ফ্রেম করেছেন যে, FBI পর্যন্ত মানতে রাজী হয়েছে এই তথ্যে, অমি কে হত্যা করা হয়েছে এবং সেজন্য তার স্বামী দ্বায়ী। এমনকি হত্যার সময় তিনি প্রেগন্যান্ট ছিলেন! অথচ, অমি বেঁচে থেকেও নিজেকে মেরে ফেলেছেন।
পুনরায়, ‘Fight Club’ মুভির দিকে চোখ বুলালে দেখবেন টেইলর (Tyler Durden) নামক কোনো ব্যক্তিই ছিলো না। গল্পের বক্তা খোদ নিজেই টেইলর হয়ে সেজে বসে আছেন। আবারও ‘Shutter Island’ মুভিতে এডওয়ার্ড (Edward Teddy Daniels ) নিজেই হারিয়ে গিয়ে নিখোঁজ কয়েদি এডওয়ার্ড কে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
এই সমস্ত টুইস্ট ব্যক্তিজীবনে মানুষ জেনে বা না জেনে প্রচুর ব্যবহার করে চলেছেন। ফলে আপনি প্রত্যাশা করছেন ‘Predictable’ কিছু, কিন্তু ঐ ব্যক্তি বেশ ধূর্ত এবং আপনাকে হঠাৎ ভিন্ন তথ্য দেবে। যে তথ্যের উপস্থিতি পূর্বে তো ছিলোই না কিন্তু উপস্থিত হয়ে প্রধান অবজেক্ট কে-ই হটিয়ে দিয়েছে যেন। সুতরাং ‘Unpredictable’ মানুষ মানেই ভয়ংকর মানুষ আমি অন্তত এই কনক্লুশনে সরাসরি যেতে চাইছি না। আমি বলবো, একটু সাবধানে!
সর্বপ্রথম সিগমুন্ড ফ্রয়েড আধুনিক মনোবিজ্ঞানে ‘Defense Mechanism’ এ ‘Projection’ নিয়ে আসেন। এরপর তার মেয়ে ‘Anna Freud’ এই নিয়ে আরো কাজ করেছেন। এখানে একজন ব্যর্থ ব্যক্তি বা ব্যক্তিজীবনে যার খারাপ সময় চলছে সাধারণত তিনি অন্যের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য, ম্যানিপুলেশন করার জন্য, অন্যের অনুভূতি বা চিন্তা কে নিজের অনুভূতি বা চিন্তার দ্বারা প্রতিস্থাপন করার জন্য এক ধরণের প্রজেকশন তৈয়ার করেন। এছাড়াও নিজের আত্ম-সম্মান প্রটেক্ট করার জন্যও কেউ কেউ প্রজেকশনের সাহায্য নিয়ে থাকেন।
ভিজ্যুয়ালি আমরা প্রজেক্টর সম্পর্কে ধারণা রাখি। সাধারণত আপনি যে ছবিটি দেখাতে চাইছেন লোকে তাই দেখছে। এখন এই দৃশ্যটি যত বেশি কনভিন্সিং হবে লোকে সেটা তত বেশি বিশ্বাস করবে এবং আস্তে আস্তে তার ‘Perception’ -ও পরিবর্তন হতে শুরু করবে। সাধারণত যারা প্রজেকশন করেন তারা তাদের লেন্সে পৃথিবী কীভাবে দেখেছেন সেটা অন্যদের দেখাতে চেষ্টা করেন ফলে আপনি যদি তার বিশ্বাসে বিশ্বাসী হয়ে যান তাহলে আপনি আপনার স্ব পৃথিবী আর খুঁজে পাবেন না। যে লেন্সে আপনি পৃথিবী দেখছেন সে লেন্স আপনার নয়।
এই সমস্তই করা হয় নিজ নিয়ন্ত্রণ অন্যের উপর বজায় রাখা, অন্যকে ম্যানিপুলেট করা, অন্যের আত্মবিশ্বাসে হানা দেওয়া, অন্যকে ভুল রাস্তা দেখানো, এবং তাকে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করা।
সুতরাং আপনাকে কেউ টুইস্ট করছে না তো? কেউ আপনার জীবনে তার প্রজেকশন চালাচ্ছেন না তো? অথবা, কোনো বক্তা এমন কোনো বক্তব্য দিচ্ছেন কি? - যা দিয়ে আপনার অনুভূতি কে ম্যানিপুলেট করা যায়, আপনার বিহেভিয়ার প্যাটার্ন নিজের আয়ত্ত্বে নেওয়া যায়?
ছবি: Gone Girl (Movie), সোর্চ: The Monochromes