
ইসলাম একটি গণতান্ত্রিক ধর্ম হিসেবে বিবেচিত হয়, যেখানে চিন্তা করা এবং প্রশ্ন করার স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের মতো করে ইসলামকে বোঝার, ব্যাখ্যা করার এবং ধর্মীয় বিষয়ে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করার অধিকার রাখেন। তবে, ইসলাম কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে ধর্মের রক্ষণাবেক্ষণের একচেটিয়া দায়িত্ব দেয়নি। স্বাভাবিকভাবেই, যারা ধর্মীয় জ্ঞানে পারদর্শী, সমাজে তাদের মূল্যায়ন বেশি হয়, কারণ তারা ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা ও প্রয়োগে সহায়তা করতে পারেন।
বাংলাদেশে ধর্মীয় আলোচনা ও সমালোচনা তীব্র আকার ধারণ করেছে। এখানে অনেক মানুষ ‘সংশয়বাদ’ (Skepticism) নিয়ে ভুগছেন, অর্থাৎ ধর্মীয় বিষয়ে তাদের মনে প্রশ্ন জাগছে। ইসলাম সংশয়বাদকে স্বাগত জানায়, কারণ এটি জ্ঞানার্জন ও গভীর চিন্তার পথ খুলে দেয়। তবে, এই সংশয়বাদকে ধর্মের মৌলিক অনুশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে চলতে হবে।
ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে আল্লাহর আদেশ পালন করা এবং নিষেধ বর্জন করা। অর্থাৎ, একজন মুসলিম ধর্মীয় বিষয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন বা সংশয়ে ভুগতে পারেন, কিন্তু একই সঙ্গে নামাজ, রোজা, যাকাতের মতো মৌলিক ইবাদতগুলো পালন করা তার জন্য অপরিহার্য।
ইসলামে জ্ঞানী ব্যক্তিরা সমাজের পথপ্রদর্শক হিসেবে বিবেচিত। তারা সত্য, ন্যায় ও আলোর পথ দেখান। এদেরকে ইসলামী পরিভাষায় ‘আলেম’ বলা হয়। ‘আলেম’ শব্দটি আরবি ‘عَالِم’ (আলিম) থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘জ্ঞানী’ বা ‘জ্ঞানের অধিকারী’। একজন আলেম সাধারণত পবিত্র আল-কোরআন, হাদিস, ফিকহ (ইসলামী আইন) এবং অন্যান্য ধর্মীয় বিষয়ে গভীর জ্ঞান রাখেন এবং এই জ্ঞান প্রচার ও শিক্ষাদানে সক্ষম হন।
তবে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, অনেক সময় আলেমদের দায়িত্ব অন্যরা পালন করার চেষ্টা করছেন—কখনো প্রত্যক্ষভাবে, কখনো পরোক্ষভাবে। এটি কখনো দায়বোধ থেকে করা হলেও, অনেক ক্ষেত্রে এর ফলে ধর্মের অপব্যাখ্যা ছড়িয়ে পড়ে। যারা তুলনামূলকভাবে কম জানেন, তারা যদি সঠিক ব্যাখ্যা না পান, তবে তাদের দায়িত্ব হবে এই ঘাটতি পূরণে এগিয়ে আসা।
আমার ব্যক্তিগত মত, ইসলামকে ‘রক্ষা’ করার প্রয়োজন নেই; বরং ‘অপব্যাখ্যা’ থেকে মুক্তি দেওয়াই এখন জরুরি।
বর্তমানে বাংলাদেশে নারীদের পোশাক-আশাক নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। মনে হচ্ছে, এটিই যেন দেশের একমাত্র সংকট। এর পাশাপাশি ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির মতো সামাজিক অবক্ষয়ও চলমান, যাকে কখনো কখনো রাজনৈতিক মোড়কে ঢাকার চেষ্টা করা হচ্ছে। এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার করা জরুরি: সমাজ ও রাষ্ট্র দুটি ভিন্ন সত্তা। সমাজ পরিচালিত হয় নীতি-নৈতিকতার ভিত্তিতে, আর রাষ্ট্র পরিচালিত হয় আইনের মাধ্যমে।
বাংলাদেশ কি একটি ইসলামিক রাষ্ট্র? এখানে কি শরিয়াহ আইন প্রচলিত? উত্তর যদি ‘না’ হয়, তাহলে ইসলাম কেন বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে গ্রহণ করবে?
ইসলামে শুধু নারীদের জন্যই নয়, পুরুষদের জন্যও কঠোর অনুশাসন রয়েছে, যা বাংলাদেশে আলোচনায় প্রায়ই উপেক্ষিত থাকে। সামাজিক অবক্ষয়ে পুরুষদের ভূমিকা অনস্বীকার্য, কিন্তু এটি স্বীকার করার প্রবণতা কম। ইসলাম কি তবে পুরুষদের অতিরিক্ত স্বাধীনতা দিয়েছে? না, বরং ইসলাম পুরুষদেরও নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্বের আওতায় এনেছে। পুরুষেরা কি নারীদের ভাগ্য নির্ধারণ করবে? ইসলামের দৃষ্টিকোণে এটি অগ্রহণযোগ্য।
নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন রয়েছে। নারীদের প্রতি আমার অনুরোধ, যখন আপনাদের উপর ধর্মীয় অনুশাসন চাপানো হয়, তখন পুরুষদের জন্য ইসলাম কী বলে, তা তুলে ধরুন। এই আলোচনা কাউকে ক্ষতি না করে বরং সচেতনতা বাড়াবে। যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মের অপব্যাখ্যা করে, তবে তা ইসলাম-বিদ্বেষ ছাড়া আর কিছু নয়।
নিচে পুরুষদের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক অনুশাসন তুলে ধরা হলো, রেফারেন্সসহ:
১. বিনয়ী আচরণ: অহংকার বা দাম্ভিকতা ছাড়া চলাফেরা করা (কুরআন ১৭:৩৭, ৩১:১৮)।
২. দৃষ্টি সংযত করা: নারীদের প্রতি অবৈধ দৃষ্টি থেকে বিরত থাকা (কুরআন ২৪:৩০)।
৩. ভরণপোষণের দায়িত্ব: স্ত্রী, সন্তান ও নির্ভরশীলদের ভরণপোষণ দেওয়া ফরজ (কুরআন ২:২৩৩, ৪:৩৪)।
৪. শরীর ঢাকার সীমা: নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা ফরজ, বাকি অংশ ঢাকা মুস্তাহাব (হাদিস: আবু দাউদ)।
৫. পোশাকের নিষেধাজ্ঞা: রেশমি কাপড় ও সোনার গহনা পরা হারাম (হাদিস: বুখারী, মুসলিম)।
৬. নারীদের অনুকরণ নিষিদ্ধ: পোশাক বা চালচলনে নারীদের অনুকরণ করা হারাম (হাদিস: আবু দাউদ)।
৭. নারীর অধিকার রক্ষা
(ক) সম্মান, শিক্ষা, সম্পদ ও উত্তরাধিকারের অধিকার নিশ্চিত করা (কুরআন ৪:১, ৪:৭)।
(খ) বৈবাহিক জীবনে সম্মতি ও মাহর প্রদান (কুরআন ৪:৪, ৪:১৯)।
(৮) দায়িত্ব
(ক) স্ত্রী ও কন্যাদের সঙ্গে সদয় আচরণ (হাদিস: “তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সেই, যে তার স্ত্রীর প্রতি সর্বোত্তম” - বুখারী)।
(খ) নারীর নিরাপত্তা ও সম্মান রক্ষা (কুরআন ৪:৩৪)।
(গ) যৌক্তিক কারণ ছাড়া তালাক দেওয়া নিষিদ্ধ (কুরআন ২:২৩১)।
ইসলামে ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানিকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শরিয়াহ আইনে এর জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে:
ধর্ষণের শাস্তি
১. যিনা হিসেবে: বিবাহিত ধর্ষকের জন্য প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ড (রজম)। অবিবাহিত ধর্ষকের জন্য ১০০ বেত্রাঘাত ও এক বছর নির্বাসন (কুরআন ২৪:২)। শর্ত: চারজন সাক্ষী বা অপরাধীর স্বীকারোক্তি।
২. হিরাবাহ হিসেবে: সামাজিক অশান্তি সৃষ্টিকারী অপরাধ হিসেবে মৃত্যুদণ্ড, ক্রুশবিদ্ধকরণ বা হাত-পা কেটে ফেলা (কুরআন ৫:৩৩)।
৩. তাজির: প্রমাণ (যেমন মেডিকেল রিপোর্ট) থাকলে বিচারকের বিবেচনায় কারাদণ্ড বা জরিমানা। অশালীন আচরণের জন্য বেত্রাঘাত বা কারাদণ্ড (তাজিরের আওতায়)।
ধর্ষণ প্রমাণে চারজন পুরুষ সাক্ষী লাগে, তবে আধুনিক প্রেক্ষাপটে ডিএনএ বা চিকিৎসা প্রতিবেদন গ্রহণযোগ্য। ধর্ষিতা প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হলে তার কোনো শাস্তি নেই।
সহজ কথায়, ইসলামে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। এমনকি নারীর দিকে খারাপ দৃষ্টিতে তাকানোও নিন্দনীয়। পবিত্র আল-কোরআনে বলা হয়েছে, পুরুষ ও নারী উভয়েই দৃষ্টি নত রাখবে (২৪:৩০-৩১)।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কোনো পরিস্থিতিতেই—এমনকি নারী উন্মুক্ত পোশাকে থাকলেও—ইসলাম ধর্ষণকে ন্যায্যতা দেয় না।
ছবি: Grok-3
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ১১:১০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




