somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

মি. বিকেল
আমি মেহেদি হাসান, মি. বিকেল নামে পরিচিত। আমি একজন লেখক, অভিনেতা, সমাজকর্মী, রেডিও জকি, ওয়েব ও অ্যাপ ডেভেলপার, সম্পাদক, উপস্থাপক, রক্তদাতা, এবং নাট্য পরিচালক। মাইক্রোসফটে ডেভেলপার হিসেবে কর্মরত এবং গল্প বলা আমার প্রধান পরিচয়।

গাধার পিঠে চাঁদের খোঁজ: মোল্লার মজাদার গল্পে ফাঁদা জীবনের সমীকরণ

১১ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



মোল্লা নাসিরুদ্দিন—এই নামটি শুনলেই মনে ভেসে ওঠে এক অদ্ভুত, কৌতুকময় মানুষের ছবি। গল্পের জগতে তিনি এমন এক চরিত্র, যিনি হাসি আর জ্ঞানের এক অনন্য সমন্বয়ে আমাদের মুগ্ধ করেছেন। মধ্যযুগীয় তুর্কি, আরবি, পারসিক এবং দক্ষিণ এশিয়ার লোককাহিনীতে তিনি এক কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন। কেউ কেউ বলেন, তিনি ১৩শ শতাব্দীতে তুরস্কের আকশেহিরে বাস করতেন, এমনকি সেখানে তার সমাধিও রয়েছে।

তার ঐতিহাসিক অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও, তার গল্পগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। এই গল্পগুলো শুধু হাসির জন্য নয়, এর মধ্যে লুকিয়ে আছে জীবনের গভীর শিক্ষা, সমাজের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবং মানুষের মনের জটিলতার এক অপূর্ব বিশ্লেষণ।

আজ আমি মোল্লা নাসিরুদ্দিনের পাঁচটি জনপ্রিয় গল্পের মধ্য দিয়ে তার জগতে প্রবেশ করার চেষ্টা করবো। এই গল্পগুলোতে তার বুদ্ধি, হাস্যরস এবং জীবনদর্শন উজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠেছে। প্রতিটি গল্পে আমরা হয়তো হাসবো, ভাববো এবং জীবনের গভীর সত্যগুলো খুঁজে পাবো।

১. গাধা আর চাঁদের আলো

এক চাঁদনি রাতে, যখন চাঁদের নরম আলো পথের ধুলোকে রূপালি করে তুলেছিল, মোল্লা নাসিরুদ্দিন তার গাধার পিঠে চড়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। গাধাটা ধীরে ধীরে পা ফেলছিল, আর মোল্লা গুনগুন করে গান গাইছিলেন। চাঁদের আলোয় চারপাশের প্রকৃতি যেন এক জাদুকরী রূপ নিয়েছিল, আর মোল্লার মন ভরে উঠেছিল সেই সৌন্দর্যে।

হঠাৎ পথে কয়েকজন লোকের সঙ্গে দেখা। তারা মোল্লাকে দেখে হাসতে শুরু করল। একজন জিজ্ঞেস করল, “মোল্লা, তুমি গাধার পিঠে উল্টো করে বসে আছ কেন? তোমার মুখ তো পিছন দিকে!”

মোল্লা শান্ত চোখে তাকালেন। তার ঠোঁটে একটা দুষ্টু হাসি খেলে গেল। তিনি বললেন, “আমি উল্টো বসিনি। গাধাটাই ভুল দিকে যাচ্ছে।”

লোকেরা অবাক হয়ে গেল। একজন বলল, “কিন্তু গাধা তো সামনের দিকে যাচ্ছে, আর তুমি পিছন দিকে মুখ করে আছ!”

মোল্লা হেসে বললেন, “যখন আমি গাধায় চড়েছিলাম, তখন সামনের দিকে মুখ করেই বসেছিলাম। কিন্তু এই গাধা হঠাৎ ঘুরে গেল। আমি তো আর তার সঙ্গে ঘুরিনি। তাই এখন আমি পিছনে। দোষটা আসলে গাধারই।”

লোকেরা হাসতে হাসতে বলল, “মোল্লা, তোমার যুক্তি সত্যিই অদ্ভুত!” মোল্লা চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “জীবনেও আমরা অনেক সময় ভুল পথে চলি, কিন্তু মনে করি আমরাই ঠিক। গাধাটা তার পথে চলছে, আমি শুধু তার সঙ্গে আছি।”

এই গল্পে মোল্লা আমাদের হাসির মাধ্যমে একটি গভীর সত্য দেখান—আমরা প্রায়ই নিজেদের ভুল অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিই। গাধার দিক বদলানোর মতো জীবনে পরিস্থিতি বদলালেও আমরা নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে চাই না।

মনোবিজ্ঞানে এটি ‘Projection’ নামে পরিচিত, যেখানে আমরা নিজেদের দোষ অন্যের উপর চাপিয়ে দিই। দার্শনিকভাবে, এটি আমাদের জীবনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলে।

২. চাবি হারানো

গভীর রাতে, রাস্তার বাতির নিচে মোল্লা নাসিরুদ্দিন মাটিতে হামাগুড়ি দিচ্ছিলেন। তার চোখেমুখে উদ্বেগের ছাপ। এক পথচারী এসে জিজ্ঞেস করলেন, “মোল্লা, কী খুঁজছ?”

মোল্লা বললেন, “আমার চাবি হারিয়ে গেছে।”

পথচারী সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় হারিয়েছ?”

মোল্লা শান্ত গলায় বললেন, “বাড়ির ভেতরে।”

পথচারী হতভম্ব। “তাহলে এখানে রাস্তায় কেন খুঁজছ?”

মোল্লা হেসে বললেন, “এখানে আলো বেশি। বাড়ির ভেতরে তো অন্ধকার।”

পথচারী কী বলবে ভেবে পেল না। মোল্লা আবার বললেন, “খুঁজতে হলে যেখানে দেখা যায়, সেখানেই খুঁজতে হয়, তাই না?”

এই গল্পে মোল্লা হাসির ছলে একটি গভীর সত্য তুলে ধরেছেন। আমরা অনেক সময় সমস্যার সমাধান ভুল জায়গায় খুঁজি, শুধু সেটা সহজ বলে। চাবি বাড়িতে হারালেও মোল্লা রাস্তায় খুঁজছেন, কারণ সেখানে আলো আছে। দার্শনিকভাবে, এটি ‘Epistemology’ বা জ্ঞানের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তোলে—আমরা কীভাবে জানবো যে, আমরা সঠিক জায়গায় খুঁজছি?

মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে, এটি আমাদের ‘Avoidance Behavior’ বা সমস্যা এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতার কথা বলে।

৩. আংটি হারানো

একদিন মোল্লা নাসিরুদ্দিনের আংটি হারিয়ে গেল। তিনি ঘরের কোণে কোণে, উঠানে, এমনকি রাস্তায় খুঁজতে বেরিয়ে পড়লেন। এক প্রতিবেশী জিজ্ঞেস করলেন, “মোল্লা, কী খুঁজছ?”

মোল্লা বললেন, “আমার আংটি হারিয়ে গেছে।”

প্রতিবেশী জিজ্ঞেস করলেন, “শেষবার কখন দেখেছ?”

মোল্লা বললেন, “বাজারে যাওয়ার সময় আঙুলে ছিল। ফিরে এসে দেখি নেই।”

প্রতিবেশী বললেন, “চলো, বাজারে খুঁজি।” তারা পথে পথে খুঁজলেন, কিন্তু আংটি পাওয়া গেল না। হতাশ হয়ে মোল্লা বাড়ি ফিরলেন। হাতে তাকিয়ে দেখলেন, আংটি তো তার আঙুলেই আছে! তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে আংটিটা অন্য আঙুলে পরেছিলেন।

মোল্লা হেসে বললেন, “সারা দুনিয়া খুঁজলাম, অথচ আংটি আমার হাতেই ছিল।”

এই গল্পে মোল্লা আমাদের দেখান, আমরা যা খুঁজি, তা প্রায়ই আমাদের কাছেই থাকে। সুখ বা শান্তি বাইরে খুঁজতে গিয়ে আমরা ভুলে যাই যে এগুলো আমাদের ভেতরে লুকিয়ে আছে। মনোবিজ্ঞানে এটি ‘Self-Discovery’ বা আত্ম-উপলব্ধির ধারণার সঙ্গে মিলে যায়। দার্শনিকভাবে, এটি আমাদের জীবনের অভ্যন্তরীণ সম্পদের গুরুত্ব মনে করিয়ে দেয়।

৪. মোল্লার চাঁদের খোঁজ

এক রাতে মোল্লা রাস্তায় হাঁটছিলেন। একজন এসে জিজ্ঞেস করল, “মোল্লা, চাঁদ এখন কোথায়?”

মোল্লা ভ্রু কুঁচকে বললেন, “আমি কি চাঁদের রক্ষক? আমি কীভাবে জানবো?”

লোকটি বলল, “আমি আকাশের চাঁদের কথা বলছি!”

মোল্লা আকাশে তাকিয়ে বললেন, “ওহ, এটা বলছ! আমি ভেবেছিলাম চাঁদ হারিয়ে গেছে। দেখো, ওই তো আকাশে ঝুলছে।”

এই গল্পে মোল্লার সরলতা ও হাস্যরস ফুটে উঠেছে। তিনি একটি সহজ প্রশ্নকে জটিল করে হাসির সৃষ্টি করেছেন। এটি আমাদের শেখায়, জীবনে সবকিছু নিয়ে বেশি গম্ভীর না হয়ে হালকা মনে থাকলে জীবন মধুর হয়।

দার্শনিকভাবে, এটি ‘Absurdism’ ধারণার সঙ্গে মিলে যায়, যেখানে জীবনের অসঙ্গতিকে হাসির মাধ্যমে গ্রহণ করা হয়। মনোবিজ্ঞানে, এটি আমাদের ‘Cognitive Flexibility’ বা মানসিক নমনীয়তার গুরুত্ব বোঝায়।

৫. মোল্লার দানশীলতা

একদিন বাজারে এক ভিক্ষুক মোল্লার কাছে এসে বলল, “মোল্লা, আমাকে কিছু দাও, দু’দিন খাইনি।”

মোল্লা পকেটে হাত দিয়ে দেখলেন, কিছুই নেই। তিনি বললেন, “আমার কাছে কিছু নেই। তবে আমি তোমাকে আমার ক্ষুধাটা দিচ্ছি। এটা নিয়ে দেখো, কেউ খাবার দেয় কি না।”

ভিক্ষুক হতভম্ব হয়ে বলল, “ক্ষুধা দিয়ে কী করব?”

মোল্লা হেসে বললেন, “আমার যা আছে, তাই দিলাম।”

এই গল্পে মোল্লা হাসির মাধ্যমে বলেন, দানশীলতা শুধু টাকায় নয়, মনের উদারতায়। এটি সমাজে দারিদ্র্য ও অসমতার প্রতি একটি কৌতুকপূর্ণ সমালোচনাও।

মনোবিজ্ঞানে এটি ‘Empathy’ বা সহানুভূতির ধারণার সঙ্গে মিলে যায়, যেখানে আমরা অন্যের দুঃখ বুঝে তাদের সাহায্য করতে চাই। দার্শনিকভাবে, এটি আমাদের শেখায় যে সত্যিকারের দান মানুষের মনের গভীরতা থেকে আসে।

মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্পগুলো আমাদের জন্য হাসি ও জ্ঞানের এক অমূল্য উপহার। এগুলো আমাদের শেখায় জীবনকে সহজভাবে দেখতে, নিজের ভুল চিনতে এবং হাসির মাধ্যমে সমস্যার মোকাবিলা করতে। তার গল্পে মজা, দর্শন ও মনোবিজ্ঞানের এমন এক মিশ্রণ রয়েছে, যা আজও প্রাসঙ্গিক।

মোল্লা আমাদের মনে করিয়ে দেন—জীবন একটু হাসি, একটু বুদ্ধি আর অনেকটা মানবিকতা দিয়ে আরো সুন্দর হয়ে ওঠে।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১:২৯
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দেশে এমপি হওয়ার মতো ১ জন মানুষও নেই

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪৪



দলগুলোতে মানুষই নেই, আছে হনুমান।

আমেরিকায় যদি ট্রাম্প ক্ষমতায় না'আসতো, বাংলাদেশে হ্যাঁ/না ভোট দিয়ে ইউনুসকে দেশের প্রেসিডেন্ট করে, দেশ চালাতো প্রাক্তন মিলিটারী অফিসারেরা ও বর্তমান জামাতী অফিসারা মিলে। দুতাবাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

মজনু নামাজ পড়ার পর মোনাজাত ধরল তো ধরলই, আর ছাড়তে চাইল না | পাক আর্মির বর্বরতা!!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৫৭



১৯৭১ সালে পাকিস্তানী আর্মি পুরো বাঙালী জাতির উপর যে নৃশংস হত্যাংজ্ঞ, বর্বরতা চালিয়েছে যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। সত্যি বলতে ১৯৭১ সালে বাঙালী জাতির উপর পাকিস্তানী আর্মি কর্তৃক... ...বাকিটুকু পড়ুন

সব দোষ শেখ হাসিনার !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৫৬


অনেকদিন পর zahid takes এর ডা. জাহেদুর রহমানের এনালাইসিস ভিডিও দেখলাম। জুলাই আন্দোলনের পূর্বে বিশেষত যখন র‍্যাব স্যাংশন খায় তখন থেকেই উনার ভিডিও দেখা আরম্ভ করি। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার মাঈনউদ্দিন মইনুলকে ১৩ বছর পুর্তি উপলক্ষে অভিনন্দন।

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১১ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৭



সামুর সুসময়ের আদর্শ ব্লগারদের মাঝে মাঈনউদ্দিন মইনুল হচ্ছেন একজন খুবই আধুনিক মনের ব্লগার; তিনি এখনো ব্লগে আছেন, পড়েন, কমেন্ট করেন, কম লেখেন। গত সপ্তাহে উনার ব্লগিং;এর ১৩ বছর পুর্ণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিয়তির খেলায়: ইউনুস ও এনসিপিনামা

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১১ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৫৪



২০১৪ সালে মুক্তি পাওয়া আমেরিকান চলচ্চিত্র 'আনব্রোকেন' একটি সত্যি ঘটনার ওপর নির্মিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে, আমেরিকান বোমারু বিমানের কিছু ক্রু একটি মিশন পরিচালনা করার সময় জাপানিজ যুদ্ধ বিমানের আঘাতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×