২৯ অক্টোবর, ২০০৯,
রাত সাড়ে বারটা।
১. বাড্ডায় ইকরা ইসলামিক পাঠাগারটাতে যাওয়া হয়না অনেকদিন। হঠাৎ মনে হল একটু ঘুরে আসি। ছাত্রের বাসা থেকে বের হয়ে এশার নামায পড়ে আমার পরিচিত, সদা উৎফুল্ল মাওলানা জাফর ভাইকে নিয়ে রাত ১১:০০টায় হাজির হলাম ইকরায়। পাঠাগারের পরিচালক তখন ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আমাদের ফোন পেয়ে বেচারার ঘুমটা আরও দেড়ঘন্টার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণতে লাগল। ইতোমধ্যে ঢাকার রাস্তাঘাটে বাস-টেম্পু চলাচল কমে এসেছে বেশ। শুধু কিছু মালবাহী ট্রাক সগর্জনে তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। আর আছে কিছু দুরপাল্লার বাস, সামান্য কয়টা সিএনজি আর রিকশা। বাড্ডা হোসেন মার্কেট থেকে গুলিস্তান আসতে 'বন্ধু পরিবহন' নামের ম্যাক্সিই তখন একমাত্র ভরসা। কিন্তু তারও উপস্থিতি কমে গেছে বেশ। ইতিমধ্যে 'তুরাগ' এল। আমি আর আমার সাথের ভাই ভাবলাম পথ যত আগানো যায় তত ভাল। তুরাগে উঠে নামলাম মালিবাগ রেলগেটে। অপেক্ষা করতে লাগলাম 'বন্ধু'র জন্য। এর মধ্যে এক রিকশাওয়ালা জিজ্ঞেস করলেন কোথায় যাব আমরা। বললাম 'শহীদুল্লাহ হল যাবেন'? জবাব এল ৫০ টাকা দিতে হবে। আমি সঙ্গীকে বললাম পঞ্চাশটা টাকা পকেটেই রেখে চলেন হাটা শুরু করি। কিছুদুর এগুতেই পিছন ফিরে দেখা পেলাম 'বন্ধু' বাবাজীর। চলতি ঘোড়ায় চড়ার মত করে লাফ দিয়ে উঠে পড়লাম দুইজনে। একদম পিছনের সারির সিটগুলো পুরো খালি। পিছনের সিটের আগের সিটে দেখলাম একটা দশ-বার বছরের ছেলে মুখটা সামান্য হা করে ঘুমাচ্ছে আর ম্যাক্সির চলার সাথে ছন্দ মিলিয়ে এদিক ওদিক দুলছে। চেহারা আর পোশাক সাক্ষী দিচ্ছিল এও মৌলিক অধিকারবঞ্চিত হাজারো শিশুদের একজন। ভাতৃসূলভ একটা মমতা অনুভব করলাম ছেলেটার প্রতি। জাফর ভাইকেও দেখালাম ছেলেটাকে। অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থেকে উপভোগ করলাম নিষ্পাপ এই কিশোরের অনিশ্চিত জীবনের নিশ্চিত ঘুম। আমরা আরামের বিছানা ছাড়া ঘুমাতেই পারিনা। আর এই ছেলেদের অবস্থা হচ্ছে, 'যেখানে রাত সেখানেই কাত'। ইচ্ছে হচ্ছিল ছেলেটাকে জাগিয়ে জিজ্ঞেস করি কোথায় থাকে ও, কি করে ইত্যাদি। কিন্তু ঘুম থেকে জাগাতে মন সায় না দেওয়ায় তা আর করা হলনা। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে চলে এলাম গুলিস্তান গোলাপ শাহ মাজার। ইতিমধ্যে জাফর ভাই পল্টন এলাকায় বিদায় নিয়েছেন আমার থেকে।
২. মাজারে 'বন্ধু' ল্যান্ড করল যখন তখন রাত পৌনে একটা। কর্মব্যাস্ত মানুষের আনাগোনার উপর তখন যেন কারফিউ জারি করা হয়েছে। কিন্তু ভীষণ ব্যাস্ত এলাকা তখন গোলাপ শাহ মাজার প্রাঙ্গন। 'বাবা'র ভক্তরা সেখানে কেউ বা জিকিরে লিপ্ত, কেউবা বাবাকে অবনত মস্তকে জানাচ্ছেন সালাম, আবার একজনকে দেখলাম কয়েকজনকে একত্রে নিয়ে বেশ জোশের সাথে মোনাজাত করছেন। মোনাজাতে প্রার্থনা কি আল্লাহর কাছে করছেন নাকি বাবার কাছে ঠিক বোঝা গেলনা। এই একবিংশ শতাব্দীতেও এসব কুসংস্কার মানুষের মাঝে আসন গেড়ে আছে ভাবতেই আবাক হই। যাদেরকে দেখলাম তাদের অধিকাংশকেই অশিক্ষিত মনে হল। কিন্তু অনেক শিক্ষিত ব্যাক্তিকেও দেখেছি যারা 'বাবা'র মাজারের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মাথাটা আলতোভাবে নুয়ে আর ডান হাতটা কপালে ঠেকিয়ে সালাম জানিয়ে যান আর কয়েকটা টাকা ফেলে যান।
০৩. মাজার থেকে হাটা শুরু করলাম আবার হলের দিকে। নগর ভবনের গেটে চোখে পড়ল ওয়ারলেসওয়ালা দুইজন গোয়েন্দাপ্রবর আর দুইজন দ্বাররক্ষী। বঙ্গবাজারের পাশে ফুটপাতে দেখলাম শ্রমিক গোছের কিছু মানুষ কেউ বসে আছে আর কেউ দাড়িয়ে। পকেটে তখন মোবাইল আর আজই পাওয়া টিউশনির বেতন। নাহ! বাজে চিন্তাটা মাথা থেকে সরিয়ে ডানে মোড় নিলাম। এদিককার ফুটপাতে চোখে পড়ল কিছু ছিন্নমুল ফুটপাতসংলগ্ন দেয়ালের সাপোর্ট নিয়ে টানানো মশারির ভেতর নিদ্রারত। তার পাশে জাতির অর্থনীতির স্বরুপপ্রকাশকারী এক অভাগা মহিলাকে দেখলাম নোংরা একটা পাত্রে করে কি যেন খেতে। একটু আগেই ইকরা পাঠাগারে খেয়ে এসেছি আমি মজাদার চানাচুর আর বিস্কিট। তারও আগে ছাত্রের বাসায় সুস্বাদু ড্রাই কেক আর চা। আরেকটু সামনে অগ্রসর হয়ে চোখে পড়ল জমীনকে বিছানা আর গোল আকাশটাকে মশারী বানিয়ে, লুঙ্গিটাকে কাঁথা হিসেবে মুড়ি দিয়ে মুখ ঢেকে আর হাঁটু খুলে ঘুমানো আরেক মানব সন্তান। অল্প দুরে আরও একজন। রাস্তার ওপাশে আরও ৫-৭জন। পকেটে আমার পঁয়ত্রিশশত টাকা। কিন্তু আজই ভর্তি হতে হবে আমাকে মাস্টার্সে। লাগবে ৩২০০ টাকা। বন্ধু-বান্ধবদের কাছে ঋণী আছি আরও ৪২০০টাকা। বাড়ি থেকে টাকা আনাটা এই বয়সে যথেষ্ট লজ্জাজনক মনে হয়(যদিও কোন সমস্যা নেই)।
তাই প্রতিদিন আশেপাশে বাসে অঘোরে ঘুমিয়ে থাকা নাম না জানা ওই ছেলেটার মত অগণিত শিশু-কিশোরকে দেখি । দেখতে পাই ভুখানাঙ্গা, অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে বেঁচে থাকা অজস্র মহিলা-পুরুষ আর ফুটপাতকে বাড়িঘর বানিয়ে পড়ে থাকা হাজারো মানুষকে কিন্তু কিছুই করতে পারিনা তাদের জন্য। শুধু মনে মনে বলি হে আমার দেশ, আর কিছুদিন সময় দাও আমাকে। জানিনা সেটাও একধরনের আত্নপ্রতারণা কিনা।