আমাদের শিক্ষা উচ্চ শিক্ষা যে আমাদের কোন কাজেই আসছে না তা প্রথমে একটি ছক আকারে দেখা যেতে পারে । গাজী মাহবুবুল আলম, মির্জা মোহাম্মদ শাহজামাল শিক্ষার রেট অব রিটার্ন নিয়ে এই গবেষনা করেন ।
প্রাথমিক স্তরে যে শিক্ষা ব্যাবহার হয়, পরবর্তীতে তা বিভিন্ন কাজে অবদান রাখে ১২.১ ।
মাধ্যমিক স্তরে যে শিক্ষা ব্যাবহার হয়, পরবর্তীতে তা বিভিন্ন কাজে অবদান রাখে ০.৫ ।
উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে যে শিক্ষা ব্যাবহার হয়, পরবর্তীতে তা বিভিন্ন কাজে অবদান রাখে ২.৮
উচ্চ শিক্ষা ব্যাবহার হয়, পরবর্তীতে তা বিভিন্ন কাজে অবদান রাখে -১.৯ ।
কাজেই উচ্চ শিক্ষা আমাদের কোন কাজেই আসে না বরং বিভিন্ন ধরনের কর্মকান্ডের মাধ্যমে তারা সমাজের বোঝা হিসেবে প্রতিয়মান হয় ।
আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছদে ১৭ তে আছে,
ক. রাষ্ট্র একই পদ্ধতির গণমুখি ও সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সব বালক বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা দানের ব্যবস্থা গ্রহন করবে ।
খ. রাষ্ট্র সমাজের প্রয়োজনের সঙ্গে শিক্ষাকে সংগতিপূর্ণ করবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষন প্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির ব্যবস্থা করবে ।
গ. রাষ্ট্র আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষতা দূর করবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন করবে ।
বর্তমানে যে শিক্ষা ব্যবস্থা তা ব্যাক্তি ও সমাজ জীবনের কোন কাজে লাগে না বরং সমাজের ঘাড়ে বিশাল বিশাল বোঝা হয়ে অবস্থান করে । আর আমাদের রাষ্ট্র যখন এই সব শিক্ষার পিছনে অর্থের আয়োজন করে অর্থ অপচয় করে তখন এর জবাবদিহিও রাষ্ট্রের করা উচিত নয় কি……….?
আমাদের দেশের উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থায় ছাত্রদের হাতে যখন কলমের বদলে অস্ত্র দেখা যায় তখন কে বলবে, পেন ইজ মাইটার দেন সোর্ড ।
বিভিন্ন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে তাকালে দেখা যায় তারা, শিক্ষার জন্য বিনিয়োগ করা প্রতিটি পয়সা ও শিক্ষার্থীদের বিনিয়গকে বিবেচনায় আনা হয়, মূল্যায়ন করা হয় ।
অর্থনীতির ভাষায়. বিনিয়গের আগে চিন্তা করতে হবে, মূলধন থেকে কিছুটা লাভ পাওয়া যাবে কি না…. । লরা জিন ভদ্র তার RED and GREEN বইয়ে উল্লেখ করেন, উচ্চ শিক্ষায় সরকার প্রদত্ত বিপুলাঙ্কের ভর্তুকি মূলত অপচয় ।
আমাদের দেশে কখনো আমরা নলেজ রেভলিউশনের উদ্যোগ গ্রহন করিনি, যার ফলে বহিবিশ্বের সাথে দৌড়াতে গিয়ে আমাদের নলেজ এক্সেলারেশন হয় না । আমার পদার্থ বিঙ্গানের ভাইয়া আমাকে বলেছিলো, আমার ত্বরণ ঘটছে না, ঘটছে মন্দন । বিষয়টাও ঠিক এরকম । আমাদের উচ্চশিক্ষা শেষ হচ্ছে, যা আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে না দিচ্ছে সার্টিফিকেট ।
সনৎ কুমার সাহা তার EDUCATION AND SKILL BUILDING IN BANGLADESH বইয়ে “দক্ষতা বৃদ্ধিকে প্রতিযোগীতা মূলক বাজারে টিকে থাকার হাতিয়ার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন ।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকি তার, VISSIONS AND REVISIONS HIGHER EDUCATION IN BANGLADESH বইয়ে কিছু অসংগতি তুলে ধরেছে,
১. সময় ও অর্থের অপচয়
২. শিক্ষা কার্যক্রম চাকরির বাজারের সাথে সংগতি পূর্ন নয় ।
৩. সেসন জ্যাম ।
৪. অত্যান্ত দূর্বল অবকাঠামো ।
৫. রাজনৈতিক প্রভাবযুক্ত ।
৬. আসন সীমিত ।
এবার আসা যাক একটি সত্য ও মজার বিষয়ে । জেমস প্রেসকট মার্কিনি “অপ্রয়োজনীয় বোঝা” বলেছেন উচ্চ শিক্ষাকে । অর্থহীন একটি ডিগ্রির জন্য একজন ছাত্র প্রচুর অর্থ ব্যায় করে । তিনি আরো বলেন, তুমি যদি স্মার্ট বালক হও তাহলে এখনই নিজের প্রজেক্ট শুরু করে দাও । চার বছর শিক্ষাঙ্গনে বন্দি থাকার চেয়ে বাস্তব জগতে থাকা অনেক বেশী লাভজনক । এই উচ্চ শিক্ষা আমাদের ভাবের দিক থেকে অনেক উপরে নিয়ে যায়, কিন্তু কাজের দিক থেকে নয় ।
বলা যেতে পারে, যারা সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে পড়াশুনা করে তারা নিজেদের মেধার পাহাড় বলে দাবী করে । আর বেসরকারী বিশ্ব্বিদ্যালয়ে ছাত্রদের গবেট বলতে তারা বেশি সাছন্দ্য বোধ করে । বিষয়টি ভাবের ই বহিপ্রকাশ ।
একটি রাষ্ট্রের মাথামোটা নীতি প্রনেতাদের অবশ্যই জানতে হবে, দেশের জনসংখ্যা হিসেবে মাথাপিছু কতজন ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিক্ষক, ব্যাংকার লাগবে । ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার মানব সম্পদ সৃষ্টি হওয়া না হওয়া নিভর করছে, মানসম্মত উচ্চশিক্ষার উপর ।
দারিদ্র অভিভাবক অনেক কষ্টে সন্তানের পিছনে বিনিয়োগ করছে কিন্তু উচ্চ শিক্ষা শেষে মোটা অংকের টাকা ষুস দিতে না পারায় সন্তান বেকার থাকছে, বিনিয়োগ শেয়ার মার্কেটের মত লুট হয়ে যাচ্ছে ।
এবার উচ্চশিক্ষা সর্ম্পকিত চাকুরির বিষয়ে । রংপুরের এব ডাক্তারের সাইনবোডে দেখলাম, এমবিবিএস, এমবিএ জাপান । প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে চাকুরি না পেয়ে আবার ভর্তি হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর সান্ধ্যকালীন কোর্সে । আমার চাচাত ভাই মামুন অর রশিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজ এ এমএ করে চাকুরি না পেয়ে, আবার ভর্তি হলেন রংপুর ল’কলেজে । কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে চাকুরি করতে হচ্ছে । এক্ষেত্রে ৫ বছরের উচ্চশিক্ষা কোন কাজে আসে তা আমার বোধগম্য হয়না । চাকুরিতে ঢোকার আগে প্রশিক্ষন করে বিপরীত সেক্টরের জন্য প্রস্তুত করতে হয় ।
আর নারী উচ্চ শিক্ষা, শেষ করার পর চলে যায় প্রাইমারী স্কুলে । বাসার পাশের প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক হলে মন্দ হয় না । কিন্তু প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকতা করার যোগত্য এসএসসি পাশ । অনেকেই আবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গৃহীনি । তবে কি তাদের পিছনে ব্যায় করা অর্থ শুধুই অপচয় নয় ….?
অনেক ঙ্গানীগুনি লোক, সুশীল সমাজের লোক, সচেতন নাগরিক , আমরা যাদের বলে থাকি তাদের ভাষ্যমতে, গুনগত মান না বাড়িয়ে উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারনের পক্ষে । তাদের মত সাধারন মানের মেধাবীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেয়া ঠিক নয় । উচ্চশিক্ষা শুধুই মেধাবীদের জন্য হওয়া উচিত । যুক্তি দেখিয়ে তারা বলেন, সাধারন মানের মেধাবীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দিলে সামাজিক ও কর্মক্ষেত্রে পরিবেশ নষ্ট হয় । জনশক্তিতে এরা বাড়তি বোঝা । তাহলে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তন করবেন না, যারা উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করবে না বা আপনাদের কথামত উচ্চশিক্ষা গ্রহন করতে পারবেনা, তারা কি করবে ? পযাপ্ত কর্মসংস্থান এর ব্যবস্থা কি করা হবে তাদের জন্য ..? যদি তাই না হয় তবে সাধারন মেধাবীদের মেরে ফেলাই কি শ্রেয় নয়…?
বহিঃবিশ্বে যেমনটি আছে, তাদের পড়াশুনার একটি স্তর আছে, বেশির ভাগ শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষায় যায় না । তারা আন্ডার গ্রাজুয়েট বা গ্রাজুয়েট লেভেল শিক্ষা নিয়ে কর্ম ক্ষেত্রে যোগ দিতে পারে । পোষ্ট গ্রাজুয়েটের দরকার হয়না । আর যারা উচ্চশিক্ষা চালিয়ে যেতে চায় তারা চালিয়ে যেতে পারে । বিশ্বের কোন দেশেই ১০ ভাগ এর বেশী শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষায় যায় না । তবে কি সে সমস্ত দেশ গুলো উন্নত নয় ।
এখন আমরা শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে যে পথে হাটছি এটাই কি শ্রেয়, না এর পরিবর্তন দরকার । একটি নিদিষ্ট স্তর পর্যন্ত সকলেই পড়াশুনা করার সুযোগ পাবে যার পর তারা কর্মক্ষেত্রে যোগদান করতে পারবে । আর যারা কাজে যোগ না দিয়ে পড়াশুনা চালাতে চায় তাদের উচ্চশিক্ষা ও গবেষনায় স্থান দিতে হবে ।