একুশ আসে। একুশ চলে যায়। ্আমাদের নেতা - নেত্রীরা, বুদ্ধিজীবিরা এবং নগরের নাগরিক মানুষেরা মহাসমারোহে দিনটি উদযাপন করে, নির্বিঘেœ, কোনধরনের বাঁধার মুখোমুখি না হয়েই। রাষ্ট্র, প্রশাসন যন্ত্র ও পুলিশ বাহিনী সবসময় ব্যস্ত থাকে যেন কোন অনাকাঙ্খখিত সমস্যা না হয় । একুশে ফেব্রুয়ারী পালন করা সম্ভব হবে কি হবেনা এই দোলাচলে, চিন্তায়ও তাই থাকবার প্রয়োজন হয়না তাদের।
কিন্তু এই চিত্র বাংলাদেশের সবজায়গার বাস্তবতা নয়। কোথাও কোথাও, কারো কারো জন্য (বিশেষত নারীদের জন্য) একুশের উদযাপন এখনো অধরাই রয়ে গেছে। জেলা পর্যায়ে হয়তো কিছুটা চোখে পড়ে কিন্তু শতকরা আশিভাগ মানুষের বসবাসের জায়গা গ্রামাঞ্চলে একুশে ফেব্রুয়ারী : প্রথমত, সেভাবে উদযাপিত হয়না বললেই চলে দ্বিতীয়ত, যত জায়গায় যতটুক উদযাপিত হয় তাও বন্দী পুরুষের হাতে, নারীদের নিজেদের সংগঠিত হয়ে উদযাপন চোখেই পড়েনা। নেত্রকোনার কলমাকান্দার চিত্রটাও ছিল এমনই, একজন বলছিলেন ”কবে কখন যে একবার আমি শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা ভরে ফুল দিয়েছিলাম সেটা প্রায় ভূলেই গিয়েছিলাম”, অন্য নারীদের অভিজ্ঞতাও এমনই। তবে সেটা ২০ ফেব্রুয়ারী ২০০৬ পর্যন্ত, কেননা এ বছরের ২১ ফেব্রুয়ারী কলমাকান্দার সাধারন নারীরা তাদের অসাধারন তৎপরতায় প্রমান করলেন নারীরা জোটবদ্ধ হলে পর্বত সমান বাধাও কত সহজেই বালির বাধের ন্যায় ধ্বসে পড়ে!!
কলমাকান্দার নারীরা সিদ্ধান্তে পৌছান, না এরকম আর চলতে দেয়া যায়না, নারীরা নিজেরাই ২১ ফেব্রুয়ারী উপলে কর্মসূচি হাতে নিবে। কিন্তু সেটা কিভাবে? নিজেদের উদ্যোগেই বন্ধু সংগঠনগুলোর সাথে তারা কথা বলেন এবং সকলে মিলে এমনভাবে একুশ পালনের সিদ্ধান্তে পৌছান যা ’নারীরা কিছু পারেনা’ এই ধ্যান ধারনাকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে।
শুরু হল পথচলা। বাড়ী বাড়ী যেয়ে ও বিভিন্ন গ্রামীন সম্পর্ক ব্যবহার করে একুশে ফেব্রুয়ারীর তাৎপর্য্য ও এবারের একুশে ফেব্রুয়ারী উদযাপন নিয়ে তাদের পরিকল্পনা জানানো শুরু হয়। ব্যপক সাড়া তৈরী হয় পুরো এলাকা জুড়ে, নারী পুরুষ নির্বিশেষে। তারা যেন এমন একটা কিছুরই অপো করছিলেন।
সেই সাথে ছিল প্রতিবন্ধকতা, লিপি বেগম কে যেসবের মুখোমুখি হতে হয়েছে সবসময় । অমুক বাড়ীর মেয়ে হইয়া তুমি এইসব কি কইরা বেড়াইতেছ? কতবার যে এই কথা লিপিকে শুনতে হয়েছে!! তবু লিপির মত নারীরা ভেঙ্গে পড়েনি, তারা তাদের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন।
নারীদের সংগঠিত হবার খবরে কোন কোন মহল আতংকিত হবে এটাই তো স্বাভাবিক, কলমাকান্দার েেত্রও তার ব্যতিক্রম হবে কেন, কিভাবে কিভাবে যেন ২০ ফেব্রুয়ারী রাতেই আয়োজন করা হয় ওয়াজ মাহফিলের। ২০ ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যা লাগবার সাথে সাথে একদিকে শুরু হয়ে যায় ওয়াজ মাহফিলের বয়ান অন্যদিকে নারীরা নিতে থাকেন পরের দিন সকালে যে প্রভাতফেরী অনুষ্ঠিত হবে তার জন্য প্রস্তুতি।
ফুল সংগ্রহ করাটাও কম ঝামেলা ছিলনা। প্রত্যন্ত কলমাকান্দায় ফুলের বাগান এমনিতেই কম তার উপর যেগুলো আছে সেগুলোতেও ২১ ফেব্রুয়ারীকে ঘিরে অতিরিক্ত পাহারা থাকায় কিভাবে যে এতগুলো মানষের জন্য ফুল সংগ্রহ করা হবে তা নিয়ে ছিল ঘুম হারামের দশা। এক বাড়ীতে ফুল আনতে যেয়ে সমাধানের চমৎকার বুদ্ধিটা আসে লিপির মাথা থেকেই : এক জন বাগানের মালিকের সাথে কথা বলে গপ্প জমাবে আর এই ফাকে অন্যরা ফুল নিয়ে চম্পট!! গপ্প জমানোর কাজটা লিপি এতই ভালভাবে করতে পেরেছিল যে একুশের প্রভাতে সবার হাতেই গোলাপ না হোক একটা করে গাঁদা অন্তত দেখা গিয়েছিল।
এটা সহজেই প্রমান করা যায় যে কলমাকান্দার নারীদের, বিশেষত লিপির একটা স্পষ্ট উপলদ্ধির জায়গা তৈরি হয়েছে যেখান থেকে সহজেই নিজের মনের সাথে, নিজের অন্তরের সাথে কথা বলে নারী হিসেবে, মানুষ হিসেবে কোন একটা সমস্যায় ’আমাকে কি করতে হবে’ এই সিদ্ধান্তে পৌছতে পারছে। ২০ ফেব্রুয়ারী রাতে যখন পরের দিন ২১ ফেব্রুয়ারী উদযাপনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ঘুমানোর জন্য গিয়েছে লিপি ততনে শুরু হয়ে গিয়েছে ওয়াজে নারীবিদ্ধেষী ও ধর্মনিরপেতা বিরোধী কথাবার্তা। রাত যত গভীর হয় নারীবিদ্ধেষী কথাবার্তাও তত বাড়তে থাকে। আর নির্ঘুম লিপি ভেতরে ভেতরে ছটফট করতে থাকে চুপ করে বসে থাকবে নাকি অন্যায় ভাষণের প্রতিবাদ করবে এই ভেবে ভেবে। গৎবাধা ’নিশ্চুপ নারী’র প্রচলিত ইমেজ ভেঙ্গে ’সক্রিয় নারী’ লিপি হঠাৎ করেই উঠে দাড়ান বিছানা ছেড়ে, জোর কদমে হেটে পৌছান ওয়াজের জমায়েতে এবং প্রথমেই পরিচিত ঈমামকে বলেন ’ চাচা আপনি এখনই নারীবিদ্ধেষী আপত্তিকর বক্তব্য থামাতে বলেন না হলে কিন্তু আমি মঞ্চে উঠে এগুলোর বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করবো। লিপির এই সক্রিয় বিরোধীতার হুমকির খবর মঞ্চ অবধি পৌছলে অবশেষে থেমে যায় নারীদের নিয়ে গৎবাধা প্রতিক্রিয়াশীল কথাবার্তা। যেভাবে সে ঘটনার সাথে সাথে তাৎনিক বিরোধীতার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটা নি:সন্দেহে চিন্তার েেত্র নির্দিষ্ট ধরনের অগ্রসর অবস্থানের ইঙ্গিত বহন করে। দি হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশের নারী নেতৃত্ব বিষয়ক প্রশিন সারা দেশে এক ঝাক নারী নেত্রী তৈরীর যে বৃহৎ কর্মসূচী নিয়ে সামনে এগিয়ে চলেছে এই লিপি তাদেরই একজন। নেতত্বের একটি বড় সূচক যদি হয় সময়, পরিস্থিতি ও প্রেেিতর সাপেে সিদ্ধান্ত গ্রহনের মতা, তবে সেটা যে নারীরা আজকে অর্জন করতে পারছে তার বড় প্রমান সময়ের প্রয়োজনে যেভাবে লিপি তার কর্তব্য নির্ধারন করেছে। শুধু নারীদেরই নয় সমাজের ও রাষ্ট্রের নানা অসংগতিতে চুপ করে থাকা ’বোবা’ বুদ্ধিজীবিদেরও ’সময়ের দাবী ও সে অনুযায়ী কর্তব্য নির্ধারন’ বিষয়ে শেখবার আছে লিপির মত এই প্রান্তিক নারীদের কাছ থেকে। ।
একটি পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে অভ্যস্থ সমাজে ঘুম ভেঙ্গে দাপটশালী পুরুষেরা যদি দেখেন শতশত নারীর জমায়েত কী প্রতিক্রিয়া হবে বা হতে পারে মনস্তত্বের সে নিরীায় যাচ্ছিনা । শুধু এই তথ্য দিয়ে উপসংহার টানতে চাই: ২১ ফেব্রুয়ারীর প্রভাতফেরীতে রীনা সাহা, লিপি আক্তার, শিপ্রা পাল, নওরোজ, চায়না রায়, সাবিহা আক্তার, সুভাষিনী দেবীরা পাচ শতাধিক মানুষের ( প্র্ায় সবাই নারী) জোটবদ্ধ পদচারনায় মুখর করে তুলেছিলেন কলমাকান্দার সব অলিগলি পেরিয়ে শহীদ মিনার পর্যন্ত। পর্দার বেড়াজাল বা মাঝরাত থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টির দূর্দমনীয় প্রবাহ কোনকিছুই ঠেকাতে পারেনি এতগুলো নারীর ্অন্তর থেকে আসা ঢেওয়ের সম্মিলিত শক্তিকে। এ ঘটনা নারীদের অর্জন, তারাও যে অনেক কিছু করতে পারে দেখিয়ে দিয়েছে নারীরা , এটি তাই তাদের জন্য সু:খস্মৃতি, সু:খস্মৃতি কখনো কখনো মানুষকে সু:খের কান্নায় ভাসায়, হয়তো সেকারনেই ময়মনসিংহে বসে ঘটনা বর্ননার সময় ডুকরে কেদে উঠেছিলেন, প্রথমে রীনা সাহা, পরে লিপি আক্তার।
Nadimul Haque Mandal
Social Anthropologist currently
working on Politics of Development Intervention
Email: [email protected]
Cell: 01716596634