somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ন্যায্য হিস্যা প্রতিবন্ধীর অধিকার

২৯ শে ডিসেম্বর, ২০১১ ভোর ৪:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস

ন্যায্য হিস্যা প্রতিবন্ধীর অধিকার

নাদিমুল হক মণ্ডল |

আজ ৩ ডিসেম্বর, জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। প্রতিবন্ধিতা ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও মর্যাদা বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, গ ৎবাঁধা নেতিবাচক ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন ও অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ভবিষ্য ৎ কর্মপদ্ধতি ও পরিকল্পনা নির্ধারণের প্রত্যয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠন এবং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে দিবসটি পালন করা হচ্ছে নানাবিধ কর্মসূচির মাধ্যমে।
৩০ বছর আগে ‘পূর্ণ অংশগ্রহণ এবং সবার জন্য সমতা’র আহ্বান নিয়ে জাতিসংঘের উদ্যোগে পালিত হয়েছিল প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী বর্ষ। এই ৩০ বছরে বিশ্বজুড়ে প্রতিবন্ধীদের অধিকার বিষয়ে সচেতনতা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি তৈরি হয়েছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারের মর্যাদা, সম্মান, সুরক্ষা ও সংবর্ধনের যুগান্তকারী এক দলিল ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘ সনদ’। ইতিমধ্যেই বিশ্বের ১৫৩ দেশ এই সনদে স্বাক্ষর ও ১০৭ দেশ এই সনদে অনুস্বাক্ষর করেছে। আরও নতুন নতুন দেশ স্বাক্ষর ও অনুস্বাক্ষরের প্রক্রিয়ায় আছে। ইতিবাচক এক পরিবর্তনের যাত্রায় নিঃসন্দেহে অনেকদূর এগিয়েছি আমরা।
এ বছরের আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসের প্রতিপাদ্যে সবার জন্য আরও বেশি মঙ্গলময় এক বিশ্ব তৈরিতে ‘উন্নয়ন’-এ সম্মিলিত উদ্যোগ এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি তুলে ধরার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। একই সঙ্গে দিবসটি সামাজিক কাঠামো ও অনুশীলনের পরতে পরতে প্রতিবন্ধিতা ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধ্যান-ধারণার আমূল উচ্ছেদ এবং অন্যায্যতা ও বৈষম্যের যে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ঘটেছে রাষ্ট্রযন্ত্র ও ‘উন্নয়ন’ কাঠামো, ডিসকোর্স ও বিভিন্ন নীতিমালায় সেসবের ব্যবচ্ছেদ ও উ ৎপাটন—এ দুই ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমি মনে করি।
প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর অধিকার লঙ্ঘনের বাস্তবতা খুব নিষ্ঠুর ও নির্মম। প্রতিবন্ধীদের বড় অংশ সম্পত্তির অধিকারবঞ্চিত, দারিদ্র্যের হার তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি, স্বাস্থ্যসেবা দুর্লভ আর শিক্ষা ও চাকরির পথে পথে রয়েছে পর্বতসংকুল প্রতিবন্ধকতা। সেই সঙ্গে রয়েছে নেতিবাচক ধ্যান-ধারণা ও শোষণ, নিপীড়ন ও বৈষম্যের আধিপত্যবাদী ও ঔপনিবেশিক মনোবৃত্তি। এ প্রসঙ্গে একটি নির্মম ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। অতিদরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও মধুসূদন চক্রবর্তী নামের চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের এক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী পড়াশোনায় ছিলেন অসামান্য সফল। বাবা-মা জায়গা-জমি বিক্রি করে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন নিয়ে পড়াচ্ছিলেন মধুসূদনকে। উচ্চমাধ্যমিক পাস করে একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তিও হয়েছিলেন মেধাবী এই শিক্ষার্থী। কিন্তু শুরু থেকেই সহপাঠী ও শিক্ষকদের নেতিবাচক মনোভাব ও অসহযোগিতার মুখোমুখি হয়ে পড়াশোনা না করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে বাবার কাছে তিনি লম্বা এক চিঠি লেখেন। বাবা বিষয়টি নিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেন। শিক্ষকেরা আশ্বস্ত করেন, আর কোনো সমস্যা যেন না হয় সেদিকে তাঁরা খেয়াল রাখবেন। কিন্তু তাঁরা কথা তো রাখেনইনি, উল্টো প্রতিবন্ধিতা নিয়েও মেডিকেল কলেজে পড়ার দুঃসাহস নিয়ে তিরস্কার করেন। সেই সঙ্গে পরীক্ষায়ও বৈষম্যমূলকভাবে কম নম্বর দেওয়া হয়। ২০১০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আবার যখন পুরো ক্লাসের সামনে তাঁকে হেনস্তা করা হয়, আর সইতে পারেননি মধুসূদন। হোস্টেল ছেড়ে তিনি একটি হোটেলে রুম ভাড়া নেন এবং সেখানেই বিষপানে আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যার চিরকুটে এই নিপীড়নের বৃত্তান্ত তিনি ধরিত্রীকে জানিয়ে গিয়েছিলেন। অবজ্ঞা ও অবহেলা এখনো নিরন্তর সঙ্গী আরও অনেকের।
এখনো দেশের ভবঘুরে আশ্রয়কেন্দ্রে শতাধিক মানসিক অসুস্থ এবং বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি ঔপনিবেশিক আমলে তৈরি এক নিকষ কালো আইনের জালে ‘ভবঘুরে’ আখ্যায়িত হয়ে বছরের পর বছর ধরে বন্দী জীবনে বাধ্য হচ্ছেন, বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদাগুলোর যেখানে নেই ন্যূনতম সংস্থান। ঢাকায় যখন গণতন্ত্র, মানবাধিকার কিংবা মুক্তিযুদ্ধের আবেগঘন উদ্যাপন চলে তখন রাজধানীর অদূরের এই ভবঘুরে আশ্রয়কেন্দ্রের চার দেয়ালে ‘মুক্তি’র আকুতি ডুকরে কাঁদে।
বিগত চার দশকে বিশ্বজুড়ে তথাকথিত ‘পরজনপ্রীতি’ বা ‘চ্যারিটি’ থেকে ‘অধিকার’ ও ‘ক্ষমতায়ন’-এ ‘উন্নয়ন’-এর এক মৌলিক রূপান্তর ঘটেছে। তবে বাস্তবতা হলো প্রতিবন্ধিতা এবং প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র, ‘উন্নয়ন’ সংস্থা ও ‘উন্নয়ন’ সহযোগীরা রূপান্তরের তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ ঘটিয়েছেন খুব কমই।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘ সনদের ৩ নম্বর ধারায় সমাজে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পূর্ণ অংশগ্রহণ ও কার্যকর একীভূতকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ধারাটি একই সঙ্গে ‘উন্নয়ন’ কৌশল ও কর্মসূচির প্রতিটি স্তরে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিতের তাগিদ দেয়। দেশে দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যোগ্য নেতৃত্ব ‘উন্নয়ন’ বয়ান ও অনুশীলনের এই এক্সক্লুশনারি প্রবণতাকে জোরালো চ্যালেঞ্জ করেছেন ও করছেন প্রতিনিয়ত।
‘পুনর্বাসন’ কর্মসূচির নিষ্ক্রিয় গ্রাহক হিসেবে প্রতিবন্ধীদের দেখার যে লেন্স ‘উন্নয়ন’-কর্তারা চোখে দিয়ে বসেছেন, তার বিপরীতে প্রতিবন্ধীরা দাবি তুলেছেন ‘উন্নয়ন’ কার্যক্রমে পূর্ণ, ন্যায্য ও সমান অংশীদারির। সিভিল সোসাইটি, ‘উন্নয়ন’ সংস্থা, ‘উন্নয়ন’ সহযোগী, গণমাধ্যম ও সরকারের কাছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠনগুলো সুস্পষ্ট দাবি তুলছে উন্নয়নের প্রতিটি স্তরে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করার। আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসে তাঁরা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, সবার অংশগ্রহণ, প্রবেশগম্যতা ও ন্যায্য হিস্যা ব্যতিরেকে ‘টেকসই উন্নয়ন’ অসম্ভব। ‘উন্নয়ন’-এর মূল স্রোতধারায় প্রতিবন্ধিতার কার্যকর একীভূতকরণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠনগুলোর একটি অন্যতম প্রধান দাবি। আর প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও তাদের সংগঠনগুলোকে অবশ্যই সুযোগ দিতে হবে অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ‘উন্নয়ন’-এর সব কর্মসূচির নেতৃত্ব দেওয়ার। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের এই সমানাধিকারের দাবি শুধু প্রতিবন্ধীর নয়, একই সঙ্গে এটি অপরাপর অসাম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে একটি বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণেরও ন্যায্য দাবি।
নাদিমুল হক মণ্ডল: নৃবিজ্ঞানী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য।
[email protected]

প্রথম আলো, তারিখ: ০৩-১২-২০১১, link: Click This Link
)
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আইনের ফাঁকফোকর-০৩

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪২

যেকোনো চাকরির নিয়োগের পরীক্ষা চলছে। সেটা পাবলিক সার্ভিস কমিশন, বিভিন্ন সংস্থা, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক বা উপজেলা পর্যায়ের কোনো কার্যালয়ে হতে পারে। এই নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে পারে। একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সিকান্দার রাজার চেয়ে একজন পতিতাও ভালো।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৭

সিকান্দার রাজা কোকের বোতল সামনে থেকে সরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গেছেন! কিন্তু তাকে যারা হিরো বানিয়েছেন, তারা কেউ দেখছেন না তিনি কত বড় নেমকহারামি করেছেন। তারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×