আজ রাতে ভাবলাম বাইরে কে,এফ,সির নতুন
মেন্যু চেখে আসবো। বউ তো গেসে ইন্ডিয়া
ওর বাবা মায়ের সাথে। তাই একা একাই
যেতে হবে। ধানমন্ডি র কে,এফ,সির গেটের
পাশে একটা ১০/১১ বছর বয়েসের টোকাই মুখ
শুকনা করে দাড়িয়ে আছে। আমি শঙ্কিত।
ছেলে টা আমাকে দেখে করূণ সুরে কি
যেনো বল্লো। ইদানিং রাস্তা ঘাটে
ভিক্ষুক, টোকাই এদের উপদ্রব খুব বেড়েছে।
পাত্তা দিতে গেলেই বিপদ। আমার বউ
দেখা যায় ভিক্ষুক, টোকাই দের দেখলেই
ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দেয়। একবার
তার এই মহানুভাবতার কারনে পরপর তিন
টোকাই কে চার বার টাকা দিতে
হয়েছিলো। কারন একজন কে দুই বার দেয়া
হইসিলো। আরেকবার এক ভিক্ষুক কে দুই টাকা
দিয়েছিলাম বলে সে আমাকে তার থালা
থেকে পাচ টাকা দিয়ে বলেছিলো, "লন,
পাচ ট্যাকা রাখেন, এরপর কেউ ভিক্ষা
লইবার আইলে এই ট্যাহা ডা দিয়া দিয়েন।"
- আমি এরপর থেকে কানে ধরেছি এদের
ত্রিসীমানায় আমি নাই। যাক, টোকাই টা
কে ইগনোর করে ভেতরে ঢুকতে যাবো। হঠাৎ
ওই টোকাই এর পাশের পাচ/ছয় বছরের পিচ্চি
মেয়ে টার দিকে চোখ পড়লো। মেয়ে টা মন
খারাপ করিয়ে দেবার মতো ফুটফুটে। অবিকল
একটা ফুল। আমি ঘুরে তাকালাম,
মানিব্যাগে হাত দিলাম। সেই মহান
ফকিরের শিক্ষা অনুযায়ী মানিব্যাগে
পাচ, দশ টাকার নোট খুজছি। হঠাৎ বড়ো
ছেলে টা আমাকে বল্লো, "স্যার আমার
ট্যাকা লাগবো না, আমার কাসে ট্যাকা
আছে, আমাগোরে ভিতরে ঢুকায়া দেন,
হ্যায় আমাগো ঢুকতে দিবার চায় না, কইসি
ট্যাকা আসে, হের পর ও, আপনে স্যার
আমাগো একটু কইয়া ঢুকায়া দেন।"
কে,এফ,সি দোকান টা বেশ পরিপাটী।
ভেতরে বড়ো বড়ো পোষ্টারে দাড়ি
ওয়ালা সেই বৃদ্ধের ছবি, বৃদ্ধের পাপেট
টাইপের একটা মূর্তি। দোকানের একটা
আলাদা ইজ্জত আছে। এর উপর এখন কাস্টমার
আসার টাইম, সুন্দরী সুন্দরী মেয়ে রা
ইদানিং ফুড লাভারস সেলফি ও মারে।
মুখের এক্সপ্রেশন আবার কেমন কেমন যেনো
থাকে। একবার আমি খুব আগ্রহ নিয়ে আমার
বউ রে জিগাইসিলাম, ঠোট রে এমন কইরা
মেয়ে গুলা ছবি তুলে কেনো? আমার বউ
কইসিলো এই টাকে পউটিং ফেস এক্সপ্রেশন
বলে। ভিতরে বেশ কিছু সুন্দরী মেয়ে
দেখাও যাচ্ছে - সেই পউটিং মার্কা
মেয়ে। সাথে স্পাইক করা হেয়ার স্টাইলের
হ্যান্ডসাম পোলাপাইন। এই রকম একটা
পরিবেশে আমি ই এক ট্রাউজার আর নীল
টিশার্টে ঢুকতে বিশেষ কনফিডেন্স
পাচ্ছিনা, এর এই দুই কার্টুন রে তো ঢুকতে না
দেবার ই কথা। বড়ো টার পড়নে এক্স,এল
সাইজের একটা টি-শার্ট। মাঝে লেখা
কিক-অ্যাস। টি-শার্টে এতো বেশি ছিদ্র
যে ওইটা রে মশারী বলা ভালো আর প্যান্ট
পড়সে না লুঙ্গী পড়সে বুঝার সাধ্যি আমার
নাই। পিচ্চি মেয়ে টা পড়ে আছে শতচ্ছিন্ন
একটা ফ্রক। যার ঝালর ওর নিজের পায়ে
বাইধা নিজেই উষ্টা খেয়ে পড়বে। পুরা
শরীর জুড়ে ময়লা। পা খালি দুই জনের ই। এই দুই
চিড়িয়া রে আমি খুব আদর করে বল্লাম,
তোমাদের ভিতরে ঢুকার কি দরকার? টাকা
যা আসে অন্য কোনো খানে যাইয়া খাও।
আমি ও কিছু টাকা দেই।" আমি দিল দরিয়া
কিছু না, জাষ্ট পিচ্চি টা কে দেখে মন টা
খুব খারাপ হইসিলো। হয়তো ফুটপাথের
টোকাই না হয়ে বড়লোকের ঘরে জন্মালে
পিচ্চি ভিতরে বসে চিকেন উইংস
চাবাইতো আর বড়ো ভাই সেল্ফি মেরে
ফেসবুকে আপডেট মারতো। এরপর বড়ো ছেলে
টা আমাকে যা বল্লো আমার আসলে এরপর
আর কিছু বলার ছিলো না, বুঝানোর ও
ছিলো না।
সে সাত মসজিদ রোডে সিগারেট বিক্রি
করে। ওর পিচ্চি বোন টা ছাড়া ওর কেউ
নাই। ওদের মা মারা গেছে। আর বাবা কে
ওরা দেখেনি। ওর পিচ্চি বোন টা সারা
দিন ভাই এর পিছেপিছে থাকে। একমাত্র
অবলম্বনকে কেউ চোখের আড়াল করতে চায়
না। ছয় বছরের পিচ্চিও সেটা বোঝে।
একদিন সন্ধ্যায় ভাই কে কে,এফ,সির ঝলমলে
দোকান টা দেখিয়ে বলে, "এই টা কিসের
দোকান? মানুষ জন কতো অনন্দ কইরা ঢুকে,
বাইর হয় আর ভিতর থিকা কি সুন্দর গন্ধ আসে!"
এর পর পিচ্চি কে তখন ভাই বলে, "ওই টা
বড়লোক দের দোকান, হ্যারা ওইখানে খায়
আর মজা করে, আমাগো লিগা ওই দোকান
না।"
রাস্তার শত শত হাজার হাজার এই রকম দশ/
বারো বছরের, নিজের শরীরের চেয়ে বড়ো
আর ছেড়া জামা ওয়ালা ছেলে মেয়ে
আছে, যাদের আমরা ছ্যামড়া, টোকাই,
ফকির, বস্তি এই সব নামে ডাকি - তারা এই
সব চকচকে দোকানের দিকে তাকায় না।
তারা জেনে গেছে এই সব তাদের জন্য না
বরং তারা অপেক্ষা করে সেই আইসক্রিম এর
টুকরা, কোকক্যান বা উচ্ছিষ্ট একটু খাবারের
জন্য যা আমরা খেতে না পেরে ছুড়ে
ফেলে দেই। আর ওরাও কম যায় না, ছুড়ে
ফেলে দেয়া উচ্ছিষ্ট গুলা
অ্যাক্রোব্যাটিক স্টাইলে ক্যাচ করে।
আশ্চর্য, তাই না! একবার আমি নিজের চোখে
দেখেছিলাম এক দৃশ্য - এক পিচ্চি মেয়ে এক
ফাষ্টফুডের দোকান থেকে বের হয়ে হাতের
আইসক্রিম পুরা টা না খেয়ে ফেলে দেয়।
এক অ্যাক্রোব্যাট "টোকাই" অথবা "বস্তি"
মহা উদ্দীপনায় আইসক্রিম টা উঠিয়ে দৌড়
লাগায়। মেয়ে টা খুব ই অবাক হয়ে বাবা
কে বলে, "ড্যাডি, ওই বয় টা এভাবে
লেফটওভার টা নিয়ে চলে গেলো
ক্যানো!!" তার স্মার্ট ড্যাডির অ্যান্সার
ছিলো, "ওরা আমাদের মতো না মা, ওরা
অ্যানিমেল টাইপ, ওদের দিকে তাকিও
না"। পিচ্চি টা খুব সরল বিশ্বাসে বাবা কে
বল্লো, "আর দে লাইক ডগস ড্যাডি?" বাবা
টার সেই কি হাসি!!! ঠিক ই, ওরা তো ডগ ই।
আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয় কাক,
কুকুরের পাশাপাশি এই "অ্যানিমেল" গুলা
পরিবেশ রক্ষার্থে সাহায্য করছে। আজ কাল
আমরা বাইরে বেড়িয়ে যেই পরিমান ফুড
ওয়েস্ট করি! ওরা ব্যালেন্স করে।
সেই দশ এগারো বছরের বড়ো অ্যানিমেল টা
ঠিক বুঝেছিল কে,এফ,সি র আলো দেখার
অধিকার ওদের নাই কিন্তু তার পিচ্চি বোন
"অ্যানিমেল" টা তখন ও বুঝে উঠতে
পারেনি। তাই গোল ফুটফুটে মুখ টা উজ্জ্বল
করে ভাই কে বলেছিলো "ভাইজান, তুমি
যখন হ্যাগোর মতো বড়লোক হইবা আমারে
একবার ওই দোকানের ভিতরে লইয়া যাইবা?
আমি আর কিচ্ছু চাইনা। ওর দোকানে বইয়া
খামু একবার।"
ভাই টা "কুকুর" শ্রেনীর উচ্ছিষ্ট ভোগী এক
টোকাই, কিন্তু এই বোন টা ওর পৃথিবী।
বোনের কথায় দিনের পর দিন আধ পেটা
খেয়ে তিনশ টাকা জমিয়েছে। কে যেনো
বলেছিলো ওখানে একপিস মুরগীর রান এর
দাম তিন শ টাকা। ঠিক করলো সে খাবে
না, বোন টা কে খাওয়াবে। পৃথিবী তে
জন্মে ও তো কিছু ই পেলো না। বোন টা
অল্প একটু পেলে ক্ষতি কি?
আমি ওর হাতে দেখলাম একটা প্লাস্টিকের
ব্যাগ। ভেতরে পাচ টাকা, দশ টাকা করে
বেশ কিছু নোট। ছেলে টা খুব করূণ কন্ঠে
বল্লো, স্যার আমাদের দুই জন রে একটু ঢুকাইয়া
দেন। আমাদের ট্যাকা লাগবো না। ছেলে
টা মরিয়া হয়ে আমার পায়ে ধরে
পারেতো।
আমি ওদের দুই জনের হাত ধরে ভিতরে ঢুকতে
গেলাম, গার্ড কেমন চোখে তাকাচ্ছে।
আমি পূর্ণ দৃষ্টি তে তাকালাম। আমার দৃষ্টি
তে কিছু হয়তো ছিলো, কোন কথা না
বাড়িয়ে সালাম দিয়ে দড়জা খুলে দিলো।
ওরা দুই জন মনে হলো পৃথিবীর বাইরে
কোথাও ঘুরতে এসেছে। সাধারন দোকান
টার সব কিছুই পিচ্চি মেয়ে টা হা করে
গিলছে। চোখে শুধুই আনন্দ। ভাই টার মুখে অন্য
রকম এক আভা। আমি কিউ এ দাড়ালাম।
পিচ্চি মেয়ে টা কে জিজ্জাসা করি,
"কিরে, কি খাবি?" মেয়ে টা ভাই এর
দিকে তাকায়। ভাই টা ইতস্তত করে টাকার
ব্যাগ টা দিয়ে বলে, "স্যার এই ট্যাকা
দিয়াই কিনেন আমার বইনের জন্য। আমি খামু
না। এর পর খুব পাকা পাকা কন্ঠে বল্লো
"আমার এই ডি ভালা লাগে না"
আমি দিলাম ঝাড়ি, "কয় বার খাইসস
এইখানে!" সে চুপ। আমি ওর টাকা ও নিলাম।
ঠিক ওই টাকা গুলাই ক্যাশে দিলাম।
রেষ্টুরেন্ট এর মেয়ে টা খুব অবাক, প্রথমত
এতো গুলা ময়লা ভাংতি টাকা, দ্বিতীয়ত
এই সভ্য ভব্য সমাজে আমি ইন্ট্রুডারের মতো দুই
টা "জঙ্গলি" ধরে এনেছি।
আমি মেয়ে টা কে বলি এই খানে তিন শ
আছে। আর বাকি টা এই যে। ভাংতি টাকা
তো ভালো জিনিস, আপনারে হেল্পাইবো"
আমরা খাবার নিয়ে দুই তলায় বসলাম।
পিচ্চি খাবে আর কি! চারদিক দেখতে
দেখতে ই অস্থির। খুশিতে ওর চোখ ঝলমল
করছে। আশেপাশের মানুষ গুলো কেমন
চোখে তাকাচ্ছে। কয়েক টা মেয়ে গ্রুপ
সেলফি তুলছিলো, ভিউয়িং উইন্ডো তে
টোকাই দুটো চলে এলো, যারপরনাই বিরক্ত
হয়ে ওরা আরেক দিকে ফিরে গেলো।
বড্ডো বেমানান এই ছেলে মেয়ে দুটো।
মনে হচ্ছে চমৎকার একটা পেইন্টিং এ এক
খাবলা কাদা। রাস্তার ধারে ওদের যতটা
বেমানান লাগে, তার কয়েকশ গুন বেশী
বেমানান লাগে এই রকম চকচকে পরিচ্ছন্ন
পরিবেশে।
পিচ্চি মেয়ে টা খাওয়া শুরু করলো।
এভাবে খাচ্ছে মনে হচ্ছে অমৃত কিছু খাচ্ছে।
আর ভাই টা??? ও খাচ্ছে না। খাবার স্পর্শই
করছে না। শুধু তাকিয়ে আছে। একদৃষ্টি তে
তাকিয়ে আছে তার বোনের দিকে। তার
বোকা চোখ গুলো চকচক করছে। ওরা তো কুকুর,
বিড়াল! তাহলে ভালোবাসায় কাদতে
পারে কিভাবে? আমি ও তাকিয়ে আছি।
খাবো আর কি!!! জীবনের শ্রেষ্ঠ দৃশ্য টা
বোধহয় আজ দেখে ফেল্লাম। ছোট্ট বোন টা
পরম তৃপ্তি তে চিকেন ফ্রাই খাচ্ছে আর ভাই
টা ভালোবাসার পূর্ণ দৃষ্টি তে বোন টার
দিকে তাকিয়ে আছে। ও হাসছে, পিচ্চি
বোনের দিকে চেয়ে, মৃদু বকা দিয়ে বল্লো,
"সবডি খাইবি, দেহি আইজ তুই কতো খাইবার
পারস।" বোন টা ফোকলা দাত বের করে
বলে, "ভাইজান তুমি অনেক ভালা!"
আজ ওর ভাইজান সফল হয়েছে। একটা হত দরিদ্র
বড়ো ভাই আজ বোনের কাছে সেরা মানুষ
হয়েছে। আজ পুরা কে,এফ,সির একটা
টেবিলেও এই মমতার চেয়ে বেশী মমতা
জমা হয়নি। মানুষ ওরা হতে পারেনি, পশুর
কাছাকাছি হয়েও ওরা আজ ভালোবাসা
শিখিয়ে দিলো।
আমরা নিচে নামলাম। পিচ্চি হইহই করে কি
সব বলছে। কি যে খুশি! আজ ওরা উচ্ছিষ্ট
টোকাবে না, তৃপ্তি নিয়ে বের হয়েছে
রেষ্টুরেন্ট থেকে। হয়তো ভাই টা জানে
না কাল কি আছে ওর জীবনে, খারাপ কিছু
থাকলেও ও যুদ্ধ করতে পারবে। বোন কে
আগলে রাখতে পারবে। মানুষ না হয়েও ও
মানুষ কে মানুষ জন্মের শিক্ষা দিতে
পারবে।
আমি সিগারেট ধরাবো, ও দৌড়ে একটা
বেনসন নিয়ে এলো, আমি ওকে একশ টাকা
দিতে গেলাম। ও নিলো না, শুধু বল্লো,
"স্যার, আইজ আপনে না থাকলে আমি আমার
বইনের শখ টা পুরন করতে পারতাম না। ও
ছাড়া তো আমার কিচ্ছু নাই। আপনে দোয়া
কইরেন আমার কইলজা কাইট্টা হইলেও ওরে
যেনো মানুষ করবার পারি। আপনাগো মতো
শিক্ষিত করবার পারি"
ও চলে যাচ্ছে ওর বোনের হাত ধরে। ওর বয়েস
এগারো আমার বয়েস ওর তিন গুনের বেশী।
আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতাম ওর
তিন ভাগের একভাগ মানুষ হতে পারলে।
যান্ত্রিক ঢাকা শহরের বুকে পিচ্চি মেয়ে
টাকে নিয়ে ওর ভাই এগিয়ে যাচ্ছে - যুদ্ধ
করতে, কুকুর হয়ে বেচে না থাকার যুদ্ধ,
আমাদের মতো পরিপাটী মানুষ হবার যুদ্ধ।
Collected from: Sabbir Ahmed Emon
Source: বুয়েটে আড়িপেতে শোনা