উপক্রমণিকায়
হেল দ্য হাইওয়ে
প্রথম পর্বঃ অজানার নেশায়...
আমি এক নিঃসঙ্গ অভিযাত্রিক। অদম্য নেশার টানে অজানায় ছুটে বেড়ানো সাধারণ মানুষ। তবে এই নেশার মাদকতা তথাকথিতের চাইতে কয়েক হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী। সে এক অদ্ভুত নেশা। রক্ত-অস্থি-মজ্জায় ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়া এই নেশার আতিশয্যে সাহস করে বেরিয়ে পড়লাম এবার... জানা গন্তব্যের পানে অজানার পথে... লক্ষ্য বন্দর নগরী চট্টগ্রাম। রাজধানী ঢাকা থেকে যার অফিসিয়াল দূরত্ব প্রায় আড়াইশ’ কিলোমিটার। সব কিছুর বন্দোবস্ত শেষ, এখন শুধু বেরিয়ে পড়ার অপেক্ষায়... সময় এখন পড়তির দিকে... সময় এখন আমার...
২০১০ সালের মে মাসের শেষাশেষি। ৩১ মের মেঘলা সকাল। সবকিছু গুছিয়ে আম্মা থেকে বিদায় নিয়ে নেমে পড়লাম রাস্তায়- ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে। আমি তখন ঢাকার অদূরে জুরাইনের কাছাকাছি থাকতাম। সেখান থেকেই যাত্রা শুরু করলাম। যেতে হবে বহুদূর... সঙ্গে থাকা দুটি পায়ের উপর ভর করে... এখান থেকে প্রায় আড়াইশ’ কিলোমিটার দূরের সমুদ্রবিধৌত চট্টগ্রামে। আমার সঙ্গী কেবল আমিই। বাসা থেকে বের হয়ে মিনিট খানেক লাগে মহাসড়কে নামতে। এই মিনিট খানেক ছোট মামা আমার সঙ্গী হলেন। মেঘলা দিনের আবহ হয় নিঃসঙ্গতার, একাকি মনের নির্জনতার, নিসর্গের অভেদ নির্মলতার। এমনিতেই আম্মাকে রেখে বেরিয়েছি এমন এক পথে যা অজানা নিয়তিতে পরিকীর্ণ; তার উপর ছোট মামা যখন বললেন, “আমি আর না যাই। তোমার একাকি পথে ওহে বাড়ো পথিক...” (ছোট মামা অনেক সাহিত্যরসিক মানুষ। সাহিত্যে তার মতো পাণ্ডিত্য অনেক কম মানুষের মধ্যেই আমি দেখেছি।) তখন কেমন যেন বিষাদে ছেয়ে গেলো মনটা। ছোটবেলা থেকে আম্মার ন্যাওটা ছিলাম বলে দুঃসাহসিক কাজেকর্মে তেমন মনযোগী ছিলাম না। দুঃসাহসিক কাজের আমি ছিলাম নিবিষ্ট দর্শক, নিমগ্ন শ্রোতা। সেই আমিই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর থেকে পাল্টে গেলাম অনেকখানি। আর তারই এই পরিণতি আজকে... একাকি পায়ে হেঁটে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছানোর এক অসম্ভব (আমার জন্যে ঐ সময়ে বিষয়টা তাই ছিল) ইচ্ছার বাস্তবায়ন। সাঁইত্রিশের ছোট মামার মুখভর্তি কাঁচাপাকা দাঁড়ি নিয়ে অনিমিখ চোখে একাকি পথের কোণায় আমার চলে যাওয়া দেখতে থাকা আর একবারও সেই মলিন মুখের পানে পিছন ফিরে না তাকিয়ে সূর্যঢাকা আকাশের নিচে রাস্তা চলেছি একা এই ‘আমি’র সামনে এগিয়ে যাওয়া ছিল এক অন্য মাত্রার আবহ।
আমি যখন বাসা থেকে বের হই তখন সকাল ৭:১৪। পনেরো মিনিটের ভিতর পৌঁছে যাই যাত্রাবাড়ীর জাংশনে যেখান থেকে হয় বলা যায় সব রাস্তা এসে মিলেছে অথবা সব রাস্তা একের থেকে অন্যে বিদায় নিয়েছে। আমার হাতের বা’দিকে দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে চলে গেছে যেই সুপার হাইওয়ে আমার পথচলা এখন সেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে লাগলাম। প্রথমে ছিলাম সড়কের ডানদিকে, একটু পর লেন পরিবর্তন করে চলে আসলাম বায়ে। যারা নিয়মিত যাত্রাবাড়ীর ওদিকটায় যাতায়াত করেন তারা ভালোভাবে বুঝতে পারবেন, একটু পর আমি কুতুবখালির মাছের আড়তে এসে পৌঁছাই। মাছের আড়ত হল এমন এক জায়গা যা খটখটে রোদযুক্ত নির্মেঘ আকাশের নিচেও সদাসিক্ত থাকে। অতএব বুঝতেই পারছেন, এই বিরক্তিকর ঝিরিঝিরি বৃষ্টি তার চেহারা কিই না করে ফেলেছিল সেদিন। মাঝখান দিয়ে বিপদে পড়লাম আমি। চারপাশের মানুষের চিন্তাহীন হাঁটার মাঝে মহাদুশ্চিন্তা নিয়ে পার হলাম সেই সিক্ত আড়ত। কিন্তু বেশিক্ষণ সইল না সেই সুখ। বাজে তখন ৭:৫৪... এমন সময় নামলো ঝুম বৃষ্টি। কি আর করা, অগত্যা আশ্রয় নিলাম এক রড-সিমেন্ট বিক্রির দোকানে। বৃষ্টি থামার অপেক্ষায়...
প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে চাইনিজ ব্র্যান্ডের এমপিথ্রি প্লেয়ারে এফএম রেডিওর গান শুনলাম কিছুক্ষণ, শুনতে শুনতে দেখলাম বৃষ্টিভেজা মানুষের কর্মব্যস্ত ছুটাছুটি আর গতিহীন জীবনের গতিময়তায় প্রত্যাবর্তনের নিরন্তর চেষ্টার ব্যর্থতা। সকাল ৯ বেজে ১১ মিনিটে ভাঙলো আমার ৭৭ মিনিটের দীর্ঘ বিরতি। আবার পথে নামলাম। ভেজা মহাসড়ক বড্ড ভয়ানক, এখানেই বড় বড় যানগুলো যেন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠলো পরিস্কার রাস্তা পেয়ে। ক্রমাগত স্কিড করতে করতে কানের পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া বাস-ট্রাককে সামলানো যে কি পরিমাণ বিপদজনক তা এই কাজ যে কখনো করেনি সে কিছুতেই বুঝবে না। কিন্তু আমি একটুও ভয় পেলাম না। উল্টো কোন গাড়ি বিশেষ করে বাস (কারণ বাসগুলো ছুটে জোরে) যখন আমাকে ওভারটেক করে চলে যেতো, তার এক পশলা বাতাসের ধাক্কা যেন আমাকে অন্যরকম এক প্রেরণা দিতো। আমি মহাসড়কের এক কোণা ধরে হাঁটলেও কঠিন অ্যাস্ফাল্ট থেকে পা জোড়া সরাতাম না। পাশের একফালি কাঁচা রাস্তায় নেহায়েত কারণ ছাড়া নামতাম না, নামলেও পর মুহূর্তেই আবার আগের জায়গায়। যাইহোক, এভাবে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে নারায়ণগঞ্জ চলে আসলাম টেরই পেলাম না। এই নারায়ণগঞ্জের ভৌতিক থমথমে রূপ হয়তো শীতলক্ষ্যার পাড়ে, কিংবা বালুমহালের ধারে রক্তমাখা লাশের মাঝে বিরাজমান; কিন্তু মহাসড়কের ধারের এককালের সেই প্রাচ্যের ডাণ্ডি ছিল সম্পূর্ণ অন্য আবহের। আমি সেই আবহের মাঝে পথ চলতে চলতে চলে আসলাম শীতলক্ষ্যা নদীর উপরে নির্মিত সুপ্রাচীন কাঁচপুর ব্রিজের গোঁড়ায়। সময় তখন ১০:২২... আবার নেমেছে বৃষ্টি। ঝুম বৃষ্টিও না আবার ঝিরিঝিরিও না। অনেক আগে থেকেই বৃষ্টি পড়া আরম্ভ হয়েছিল। আমার ক্রনিকলে তুলতে ভুলে গিয়েছিলাম সেই সময়টা। তবে সেটা মিনিট বিশ পঁচিশ আগে তো হবেই।
কাকভেজা হয়ে পাঁচ মিনিট পর (১০:২৯) নেমে এলাম ‘বৃদ্ধ’ কাঁচপুর থেকে। এর মধ্যেই (১০:২৮) দেখলাম আমার পথের দাগ বা চিহ্ন... কিলোমিটার পোস্ট। যেখানে এক পিঠে লিখা- চট্টগ্রাম ২৫১ আর কুমিল্লা ৮৪; অন্য পিঠে ঢাকা ১৩। কাঁচপুর ব্রিজ যেখান থেকে শেষ হয়ে আবার রাস্তায় এসে মিলেছে সেখান থেকে ভাগ হয়ে গেছে দুটি জাতীয় মহাসড়ক। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক (N1) আলাদা হয়ে কিছুটা ডানে বেঁকে বিদায় দিয়েছে কড়া বায়ে উত্তর-পূর্বদিকে চলে যাওয়া ঢাকা-সিলেট মহাসড়ককে (N2)। N1 এর পথে চলতে চলতে আরেকটা কিলোমিটার পোস্টের দেখা পেলাম। এবার বন্দর নগরী কাটায় কাটায় আড়াইশ’ কিলোমিটার দূরে আমার থেকে। সকাল ১০:৫২ মিনিটে বৃষ্টির দাপট বাড়লে থামতে হল পুনর্বার। কিন্তু ১৩ মিনিট বাদেই আবার নেমে পড়লাম পথে। পথের পাশের বহু পুরাতন বৃক্ষপত্র নিংড়ানো পানিতে প্রায় গোসল হয়ে গেলো আমার। পাশ দিয়ে হন হন করে এদিকওদিক ছুটে চলা গাড়িগুলো থেকে বিন্দুসদৃশ লক্ষ লক্ষ জলকণার ছুটে আসা আলিঙ্গন করতে করতে সামনে এগোচ্ছি আমি। থামা নেই এই চলায়। একে একে বেশ কয়েকটা কিলোমিটার পোস্টকে পাশ কাটিয়ে দুপুর ১২:১০ নাগাদ লাঙ্গলবন্দ সেতু পার হলাম। এই সেতুর নিচেই ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে হয় হিন্দুদের গঙ্গাস্নান। এখন অবশ্য একাকি নির্জন ‘হে মহাভাগ ব্রহ্মপুত্র’। দুই মিনিটে পার হলাম নাতিদীর্ঘ এই সেতু। নেমেই পেলাম আরেকটি কিলোমিটার পোস্ট- চট্টগ্রাম ২৪৩; কুমিল্লা ৭৬ আর ঢাকা ২১। একটা কথা বলে নেওয়া ভালো, জীবনের প্রথম এই Solo Expedition যতটা আমার ক্রনিকলে ধারণ করেছি তার থেকে ঢের করেছি মনে। মনোদর্পণে স্মরণীয় ছিল অনেক কিছুই, আবার দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় কিছু কিছু হয়ে গেছে আজ ধূসর অ্যালবামের সঙ্গী। তারপরও যা বলবো, যা লিখবো তার এক বর্ণও মিথ্যা না; শতভাগ সত্য তথ্যের অমলিন সম্মেলন আমার এই Chittagong Expedition…
দুপুর গড়িয়ে বেলা এখন ১টা পার। ততক্ষণে বৃষ্টির অবিশ্রাম বর্ষণ পরিসমাপ্ত। হালকা রোদের ছটায় অতি ধীরে শুষ্কতায় ফিরছে ব্যস্ত মহাসড়ক। ঠিক কতক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম লিখা নেই আমার ক্রনিকলে, কাঁচা হাতের অভিযাত্রিক ছিলাম তো। জীবনের প্রথম বারের মতো একাকি এতোটা পথ এসেছি, তাও আবার আমার ‘প্রাণভোমরা’ সেই মাকে পিছনে রেখে যে কিনা জানেই না আমার এই যাত্রার কথা... আর তাই অর্বাচীন অভিযাত্রিকের পথে পথে ছিল অনভিজ্ঞতার ছাপ। কিন্তু এই অনভিজ্ঞতাই আমাকে এমন এক জীবনের স্বাদ দেয় যে কারণে আমি আজো বলতে বাধ্য হই এবং যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন বলতে বাধ্য হবো যে, আমার এই অভিযাত্রা ছিল দুঃসাহস দেখানোর এক ভিন্নমাত্রার আতিশয্য। পড়তে থাকুন, কিছুটা হলেও টের পাবেন; তবে পুরোটা পাবেন না। কারণ ঐ পথে যে কেবল আমিই ছিলাম আমার সঙ্গী। যাইহোক, কথায় কথায় কোথায় ছিলাম তাই তো ভুলে গেলাম... ওহ! বৃষ্টির পরিসমাপ্তি... ক্রনিকলের বিভিন্ন তথ্য ও স্মৃতি ঘেঁটে যা মনে হয়, আমি সেদিন প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টার মতো বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম। আসলে আমিই হেঁটেছি। ইচ্ছা করেই হেঁটেছি, কেউ আমাকে জোর করেনি। মহাসড়কের একেকটা বাঁক থেকে হঠাৎ করে বিপরীত দিকের বেপরোয়া বাস যখন ভেজা রাস্তার উপর স্কিড করতে করতে আমাকে অতিক্রম করতো, রুদ্ধশ্বাসে ছুটে চলা একেকটা গাড়ি যখন গা ঘেঁষে ওভারটেক করতো আর গাছ থেকে ঝরে পড়া এক পশলা বৃষ্টির পানি যখন ঠাণ্ডা বাতাসে ভর করে আমার ভেজা শরীরকে আরও ভিজিয়ে দিতো তার যে উদ্দাম রোমাঞ্চকতা তা কি কোন ছাউনির নিচে রোদ উঠা কিংবা বৃষ্টি থামার প্রতীক্ষায় থেকে উপভোগ করতে পারতাম? ভিজতে ভিজতে হাঁটা, হাঁটতে হাঁটতে লিখা, আর সেই লিখতে লিখতে আজকের এই উপস্থাপন...
সোয়া একটার খানিক পরে মেঘনা সেতুর উপরে উঠে আসলাম। আস্তে আস্তে গ্রামের ছাঁট আসতে লাগলো মহাসড়কের দু’ধারে, সেই সাথে বাড়তে লাগলো দু’পাশের মানুষের একীভূত দৃষ্টিপাত... আমার দিকে। প্রায় দশ মিনিটের মতো লাগলো মেঘনা ব্রিজের মেইনফ্রেম পার হতে। কালো পানির মেঘনা তীরের দু’ধারে বেশ কতগুলো সিমেন্ট কারখানা। ব্রিজ পার হয়ে দেখলাম হাতের ডানদিকে এক বিশাল বিস্তীর্ণ জমিন। হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয় নাকি এখানে প্রতিষ্ঠিত হবে। দুপুর ২:০২... বৃষ্টি বিদায় নিয়েছে ঘন্টাখানেকের উপরে হল। মহাসড়ক আবার তার চিরায়ত শুষ্ক চেহারায় ফিরে গেছে। এখন অপেক্ষাকৃত নিরাপদ এই সুপার হাইওয়ে। ভেজা রাস্তায় গাড়িগুলোর চালানো দেখলে মনে হয় ফর্মুলা ওয়ানের কোন টুর্নামেন্ট হচ্ছে! ...একটু থামতে হবে। বিশ্রামের জন্য নয়, নয় একটু পা জোড়াকে ক্ষান্ত দেওয়ার জন্য; এই থামা ব্যাগের দু’পাশে রাখা হাফ লিটারের দুইটা বোতলে পানি ভরার জন্য। আর্সেনিক আর আয়রনের ঝামেলা না থাকলে চাপকলের পানির মতো এমন স্বাদের পানি অন্য আর কোন উৎস থেকে পাওয়া ভার আমাদের এই বাংলাদেশে। যাইহোক, আমার এই ক্ষণকালের বিরতি (১৪ মিনিটের) মহাসড়কের উত্তরদিকে হাতের বা’দিকে রাস্তার পাশে অবস্থিত এক বাঁশ-টিনের হোটেলে; জায়গাটা মুন্সিগঞ্জের ভাটেরচরের কাছাকাছি। এখানে মহাসড়ক কিছুটা মরা মরা লাগছিল। আসলে হাঁটতে ভালো লাগছিল না কিছুক্ষণের জন্য। কোন কিছু ভালো না লাগলে পারিপার্শ্বিকতার দোহাই দিয়ে আমরা আমাদের খারাপ লাগাকে সংজ্ঞায়িত করি। একা একা এ পর্যন্ত আসা আর একা একাই আরো বহুদূর যেতে হবে সেই একাকি ‘আমি’র জন্য এমন খারাপ লাগাটা খারাপ কিছু নয় হয়তো বা...
অবিরাম পথচলা... একের পর এক কিলোমিটার পোস্টকে পিছনে ফেলে ধীরে ধীরে লক্ষ্যমাত্রার দিকে এগিয়ে যাওয়া। তাও যেন গন্তব্য সেই ‘সুদূর’। জুনের দীর্ঘ দিবাভাগ ক্রমশ বর্ধমান। মার্চের জলবিষুব ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে উত্তরায়ণের দিকে। ৩১ মের ৩:৫০ মিনিটও তখন ছিল পরাক্রান্ত দুপুর। দেখলাম, রাস্তার পাশে একটা ট্রাক বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ঠিক কবে দুর্ঘটনাটা ঘটেছে বোঝা গেলো না; আশেপাশে কোন উৎসুক মানুষ নাই দেখে এইটুকু বুঝলাম হয় ঘটনা ঘটেছে কয়েকদিন আগে নয়তো দুর্ঘটনাকে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত করার কুখ্যাতি পাওয়া এই সুপার হাইওয়ে এখানকার মানুষকে এসব ব্যাপারে এক রকমের নিরাসক্তি এনে দিয়েছে। মিনিট ছয়েক পর পৌঁছলাম ইঞ্জিনিয়ারিং স্টাফ কলেজের কাছাকাছি; দাউদকান্দি পৌঁছে গেছি আমি। অর্থাৎ মুন্সিগঞ্জ ছেড়ে এখন আমি আমার নিজ জেলা কুমিল্লায়, নিজ উপজেলা দাউদকান্দিতে। প্রচণ্ড কড়া বাঁক নিয়ে ৪:০৩ মিনিটে পা রাখলাম গোমতী নদীর উপর নির্মিত দাউদকান্দি ব্রিজের উপর। স্থানীয়রা একে দাউদকান্দি ব্রিজ বললেও কাগজে-সাইনবোর্ডে এটি গোমতী সেতু। ব্রিজের উপর উঠে আমি তাকালাম দূর উত্তরে... দেখা কি যায় আমার গোমতী পাড়ের দাদাবাড়ি? না, দেখা যায় না। কিন্তু দাদাবাড়ি থেকে ঠিকই দেখা যায় এই ব্রিজ, এমনকি ব্রিজের উপর দিয়ে বাস যাচ্ছে না, ট্রাক সেটাও বোঝা যায়। হুমমম... ১০ কিলোমিটার দূর থেকে সহস্র বৃক্ষের শোভায় আকীর্ণ ছায়া সুনিবিড় এক ছোট্ট গ্রামকে খুঁজে নেওয়া অনেক কঠিন। ধীর পায়ে হেঁটে ১৬ মিনিট লাগিয়ে পার হলাম ব্রিজের মেইনফ্রেম। মেঘলা দিনের ছোঁয়া তখনও একটু একটু ছিল সাদা মেঘের নীল আসমানে। কিন্তু তা বৃষ্টি শোভায় সজ্জিত হয়ে এই ধরণীকে সিক্ত করার অভিপ্রায়ে নেই। যখন দাদাবাড়ি যেতাম তখন বাস থেকে নামতাম দুই জায়গায়। একটা এখানে... ব্রিজ থেকে নেমেই হাতের বাদিকে একটা চিকন পাকা রাস্তা আছে, একেবেকে চলে গেছে দাউদকান্দি বাজারে। আরেকটা সামনে...
একটু বিশ্রাম নিতে হবে। তার উপর এটা একটা অর্জন। অতি ছোট তবুও আমার জন্য অন্যরকম এক অর্জন। সম্পূর্ণ পায়ে হেঁটে একা একা আজ এই পর্যন্ত আসলাম যা জন্মাবধি আমি গাড়িতে করে আমার মা-বাবার সাথে এসেছি। এক মিষ্টির দোকানে গিয়ে বসলাম। মিষ্টি খেয়েছিলাম কিনা খেয়াল নেই। ২১ মিনিট সেখানে কাটিয়ে ৪:৪৭ মিনিটে আবার নেমে পড়লাম মহাসড়কে। বিকাল বেলার স্নিগ্ধ নির্মলতা শুরু হয়ে গেছে শহুরে ছোঁয়ার ব্যর্থ আঁচড় পেতে থাকা এক গ্রাম্য নিসর্গে। মেঘনা-গোমতী দুটি সেতুর অভিন্ন টোল প্লাজা পার হয়ে যে সড়ক ধরে হাঁটছি এখন সেটা অতি পুরাতন সব গাছের ছায়ায় ঢাকা। শুনশান নীরবতা আর দিনান্তের কোমলতায় ক্লান্তি এখনো আসেনি। বিকাল ঠিক পাঁচটা বাজে... কিলোমিটার পোস্ট মারফৎ জানলাম, চট্টগ্রাম আরো ২১৬ কিলো সামনে; ঢাকা পেছনে ফেলে এসেছি ৪৬ কিলো দূরে। ফোন করতে হবে... আমি ফোন নিয়ে আসিনি। ইচ্ছা করেই বাসায় রেখে এসেছি। যাতে যখন খুশি তখন ফোন করে আম্মার কণ্ঠ শুনতে না হয়। সেই ছোটবেলা থেকেই আমি আম্মাকে ছাড়া থাকতে পারতাম না। কলেজে উঠেও আমি আম্মার পাশে বসে না পড়লে পড়া হতো না। কিছু জিনিস সময়ের পরিক্রমায় হয়তো পাল্টে গেছে; কিন্তু আম্মার কাছ থেকে এভাবে এতটা দূর একা থাকা আমার জন্য এই প্রথম। অনেক ভেবে চিন্তে আমি ফোন না নিয়ে বের হবার সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম। ছোট মামা আর রাশেদুল (আমার ছোট্ট ভাই) অবশ্য জানতো আমার এই যাত্রার কথা। আম্মাকে জানাইনি এই ভয়ে যে, আম্মা হয়তো শুনলে আমাকে যেতেই দিবে না। হয়তো মেরে ঠ্যাঙ ‘ভেঙে’ ঘরে বসিয়ে রাখবে... ভার্সিটির এক মাসের সামার ভ্যাকেশন ভাঙা ঠ্যাঙ নিয়ে ঘরে বসে থাকলে এমন কিছু ক্ষতি হবে না। যাইহোক, রাশেদুল আর ছোট মামাকে স্থানীয় এক দোকান থেকে ফোন করলাম। রাশেদুল আমার প্রোগ্রেস শুনে অবাক হয়ে গেলো। মিনমিনে গলায় আম্মার কথা জিজ্ঞাসা করলাম ওদের। দুজনই যা জানালো তাতে আমি অবাক। আম্মা নাকি আমার কথা একবারের জন্যও ওদেরকে জিজ্ঞাসা করেনি। রান্না করার সময় আপন মনে গুনগুন করে গান গেয়েছে, খাবার খেতে আসার জন্য ছোট মামা আর রাশেদুলকে বকাবকি করেছে, গেমস খেলা বাদ দিয়ে রাশেদুলকে আল্লাহ্র ওয়াস্তে একটু পড়তে বসতে বলেছে, এমনকি ছোট মামার সাথে নানা বাড়ির ভবিষ্যৎ নিয়ে কথাবার্তাও বলেছে; কিন্তু আমি সেই আলোচনায় একেবারেই ছিলাম না। শুধু নাকি একবার বলছিল, “ও পাগলের মতো হঠাৎ করে চিটাগাং যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল ক্যান রে?” মামা তার স্বভাবসুলভ বুদ্ধিমত্তা খাঁটিয়ে আম্মাকে কি বুঝিয়েছে কে জানে, আমি যা বুঝলাম তা হল- আম্মার এই আচরণ আমার বুঝে আসলো না। ওদের দুজনের সাথে ২ মিনিট ১ সেকেন্ড কথা বললাম। দাদাবাড়ি যেতে আরেকটা যেখানে বাস থেকে নামতাম সেটা এই ফোন করার স্থানটি। স্থানীয়রা একে দাউদকান্দি বিশ্বরোড বাসস্টপ বলে। সাচার, মতলব, গৌরীপুর, দাউদকান্দিসহ বিভিন্ন জায়গার বাস এসে এখানে থামে। আমিও থেমেছিলাম। ওদের মতো আবার চলতেও আরম্ভ করলাম ৯ মিনিটের বিরতির পর।
পড়ন্ত বিকেলের পথচলা আমার মাঝে হঠাৎ করে ক্লান্তি এনে দিল। বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা খুঁজতে হবে। একটু পরেই নেমে আসবে ঘন অন্ধকার। আমার চলার পথ হবে নিকষ আঁধার। দূর থেকে ভেসে আসছে পাটখড়ির আগুনে কাঁচা হলুদে রান্না করা গোমতী নদীর গুঁড়া মাছের তরকারীর সুঘ্রাণ। আজ সারাদিন ভাত খাইনি। ভাত খেয়ে ভরা পেটে হাঁটা যায় না। টুকটাক এটা সেটা খেয়ে কাটিয়ে দিয়েছি। কিন্তু কুপিবাতির সেই ছনঘেরা আধারি থেকে ভেসে আসা গন্ধ আমাকে পাগল করে দিল। উপেক্ষা করে এগোতে থাকলাম সামনে, তাছাড়া আর কি উপায়। যতটা পারা যায় এগিয়ে যাই আমার গন্তব্যপানে। রাস্তার ধারে শুকাতে দেওয়া শুকনো মরিচ দেখতে দেখতে ঝাপসা হয়ে এলো চারপাশ। সন্ধ্যা আগত... সূর্য গত। বাতিহীন মহাসড়ক গাড়ির হেডলাইটের আলোয় ক্ষণে ক্ষণে আলোকিত হচ্ছে। ক্রমশ বিপদজনক হয়ে উঠেছে আমার পথচলা। শরীর ঘেঁষে চলে যাচ্ছে একেকটা গাড়ি, সাথে দিয়ে যাচ্ছে হেডলাইটের তীব্র আলোর ঝলকানি। দ্রুত খুঁজতে হবে আজকের রাতের ডেরা। কিন্তু তা কোথায়???
পথে আরো দুই জায়গায় থামলাম। বিশ্রাম নিতে নয়, বিশ্রাম নেওয়ার জায়গার সন্ধানে। এখানকার স্থানীয় জনগণ সাহায্যপরায়ণ। আমাকে জানালেন, সামনে ইলিয়টগঞ্জ বাজার আছে; চাইলে ওখানের মসজিদে আজকের রাতটা থাকতে পারি। চায়ের দোকানে বসে আলোচনা করতে করতে ওনাদের আতিথেয়তাও গ্রহণ করলাম। মহাসড়কে এখন ঘন অন্ধকার। আমার সাথে একটা ছোট্ট টর্চলাইট ছিল। ঐ লাইটের ক্ষীণ আলোয় পথ চলতে লাগলাম। একে একে পেরিয়ে আসলাম অনেকগুলো কিলোমিটার পোস্ট। সৌভাগ্য যে, এই আঁধারেও এগুলো আমার গোচরে এসেছিল। কখনো টর্চ মেরে আবার কখনো রাস্তা পার হয়ে কিলোমিটার পোস্টের তথ্যগুলো টুকতে হচ্ছিল আমাকে। রাত ৮:২৮ মিনিটে সেদিনকার শেষ কিলোমিটার পোস্ট আমাকে জানিয়ে দিল, চট্টগ্রাম আরো ২০১ কিলোমিটার দূরে... মিনিট খানেক পরেই ইলিয়টগঞ্জ হাইওয়ে পুলিশ স্টেশন নজরে পড়লো। রাত ৮:৩৫ মিনিটে চূড়ান্তভাবে সেদিনের যাত্রাবিরতি করলাম ইলিয়টগঞ্জের সেই স্থানীয় মসজিদে। আজকের দিনের হিসাব করতে বসলাম। হিসাবের ফলাফলে আসলো- একদিনে প্রায় ৫৮ কিলোমিটার! কিঞ্চিৎ অবাক হবার মতোই তথ্যটা। যদিও প্রথম দিনটা আমার জন্য মোটেও সুখকর ছিল না। সাড়ে চার ঘণ্টার মতো বৃষ্টিতে ভেজা, আবার মধ্য দুপুরের রোদের তাপে সেই ভেজা জামা গায়েই শুকিয়ে যাওয়া, ইট মনে করে ফোমের উপর পাড়া দিয়ে কাদাপানির ভিতর মোজাসমেত জুতা ডুবিয়ে দেওয়া, জুতা খুলে মোজা নিংড়ে সেই মোজাই আবার পরা, কিংবা দুর্দান্ত ভয়ংকরভাবে স্কিড করতে করতে ছুটে চলা সব গাড়ির দিকে কড়া নজর রেখে কঠিন অ্যাস্ফাল্টের উপর অবিরাম পথচলা। সত্যি বলছি, কঠিন এক দিন ছিল আমার জন্য। এখন বিশ্রামের সময়... কাল আবার নামতে হবে সেই অচেনা পথে চেনা বিপদ সব মাথায় নিয়ে। শুধু এইটুকু ভেবেই ঘুমাতে গেলাম। কিন্তু আমার জন্য আগামী দিন যে আরো শতগুণ বিপদ নিয়ে অপেক্ষা করছিল তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি। জীবনের এক কঠিনতম সময় আমার প্রতীক্ষায়...
(চলমান...)
...........................................................................
লিখাটা হয়তো একটু জটিল, দুর্বোধ্য আর বড় হয়ে গেছে। প্রথম দুইটা সমস্যা আশা রাখি সামনে কাটিয়ে উঠতে পারবো। কিন্তু শেষেরটার সমাধান একটু কঠিন হবে বৈকি।