মৃত্যুর ১৫ কি ২০ দিন আগে থেকেই কিভাবে যেন আম্মা আমাদের থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছিলেন... বিশেষ করে আমার থেকে। মা-ছেলের অচ্ছেদ্য বন্ধনে তৈরি হচ্ছিলো এক অনিবার্য বিচ্ছেদ। কি মুম্বাই আর কি মিরপুর... ডাক্তারদের বেঁধে দেওয়া আনুমানিক জীবনসীমার নির্মম সত্যের বিপরীতে আম্মার জন্যে ছিল তাঁর বেঁচে থাকা তিন সন্তানের প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। কিন্তু দিন যায় আর ফিকে হয়ে আসতে থাকে সেই প্রচেষ্টার ফসল। তাদের আম্মা ধীরে ধীরে চলে যেতে থাকেন সেই জীবনসীমার দ্বারপ্রান্তে। এক দুর্লভ টাইপের ক্যান্সারের অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় মাঝে তাঁকে প্রস্তুতি নিতে হয় ওপারে যাওয়ার জন্যে..
আম্মার শেষদিনগুলোতে আমি আর রাশেদ (আমার ছোট ভাই) রাতে পালা করে ডেল্টা হসপিটালের এক কোণার ক্যাবিনে থাকতাম। দিনের বেলা অনেকে থাকলেও রাতে আমি বা রাশেদের থাকা মাস্ট ছিল। কারণ, ঐ কোণার বেডের মানুষটা আমাদের মা। এক রাত আমি তো অন্য রাত রাশেদ। আমি রাতে ঘুমাতাম না। কারণ, হঠাৎ করে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেলে কিংবা বা কিডনির উপর চেপে বসা টিউমারের অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হলে এই আধার রাতের নিস্তব্ধতায় সেটা আম্মা কাউকে বলবেন না। অসহ্য যন্ত্রণায়ও আম্মার এই চুপ করে সয়ে যাবার স্বভাবটা অন্যরা কতটুকু জানতো তা আমি জানি না; কিন্তু তাঁর সন্তানদের এটা জানার ক্ষমতা আল্লাহ্ তায়ালা কিছুটা হলেও দিয়েছিলেন। এরকমই এক রাতে যেদিন আমার থাকার পালা... শুনতে পেলাম আম্মা বিড়বিড় করে কথা বলতেছেন। কাছে গিয়ে শুনতে পেলাম, আম্মা দেয়ালের দিকে মুখ করে ঘুমের মধ্যে বলতেছেন, "আর কোন আশা নাই। ঐ যে, আব্বা চলে আইছেন। আমার যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।" আমার নানা ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসে ইন্তেকাল করেন।
আম্মাকে আস্তে করে এদিক ফিরিয়ে দেখি তাঁর দুই চোখের কোণ অসহ্য ব্যথায় বেরিয়ে আসা পানিতে চিকচিক করতেছে। আবার ঘুম পাড়াতে যাবো এমন সময় আম্মা বললেন, "যা ঘুমাতে যা। অবশ্য তোরে কয়ে লাভ কি... তুই তো রাতে ঘুমাইস না।"... আম্মার একেক বারের ঘুম হতো আধা ঘণ্টা কি এক ঘণ্টার। সব মিলায় সারা দিনে দুই কি তিন ঘণ্টা। একটা বাচ্চার হাতের মুঠিতে যেটুকু ভাত আসে জাস্ট সেটুকু খেতে পারতো আম্মা।
আম্মাকে শেষবারের মতো রক্ত দিই আমি। সেই রক্ত রাতে আম্মাকে দেওয়া হয়। গভীর রাত... আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ কি মনে করে জেগে গেলাম। দূর থেকে দেখলাম আম্মা কি যেন একটা করার চেষ্টা করতেছেন। তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে দেখি... রক্ত যাওয়ার পাইপ খুলে গেছে। আম্মা নিজেই সেটা তাঁর অতি দুর্বল হয়ে যাওয়া অন্য হাত দিয়ে ঠিক করতে চাচ্ছেন। আমি আবার নলটা ঠিকমতো লাগাতে গিয়ে দেখি আমার রক্তে আম্মার হাত, মাথা লাল হয়ে গেছে। জীবনের এক অতিকঠিন অভিজ্ঞতা আমাকে অর্জন করতে হয়েছে ২০১১ সালের বর্ষা থেকে বসন্তে... না পেরেছি পালায় যেতে, না পেরেছি আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার টেন অন টেনের কষ্ট নিবারণ করতে... পারি নাই কিচ্ছুই...
মহান আল্লাহ্ তায়ালা আমাকে পায়ে হেঁটে সারা বাংলাদেশ ঘুরে বেড়ানোর অবিরাম সুযোগ দিয়েছেন। কিন্তু আমি এতোই অভাগা যে, আম্মাকে আমি ঘুরিয়ে দেখাতে পারিনি এই পৃথিবীর নিসর্গসকাশের অপার সৌন্দর্য। পুরাতন মুম্বাইয়ের ছায়াঘেরা সেউড়ি আর টাটা হসপিটালের জীবন-মৃত্যুর আখড়ায় কিছুদিন রাখতে পেরেছিলাম। তাও সেটা অশেষ যন্ত্রণার মূল্যে...আম্মা সুস্থ হলে আমি পণ করেছিলাম, তাঁকে নিয়ে তাঁর চিরআরাধ্য হজে যাবো... যাবোই। কিন্তু সেই পণও আমি পূরণ করতে পারিনি। কিছুই করতে পারিনি... অপদার্থের মতো আম্মার ছেড়ে যাওয়া এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকা ছাড়া...
অবিরাম আর অবিশ্রাম দিয়ে যান আমাদের মায়েরা। সৃষ্টির এক অপার বিস্ময় তাঁরা। অসহ্য যন্ত্রণায়ও তাঁরা হাসিমুখে থাকেন আবার অক্লান্ত পরিশ্রমেও হন না বিরক্ত... সামনে ঈদ আসছে... আমরা অনেকেই অনেক কিছু করার প্ল্যান করেছি... সব বাদ দিয়ে একটা প্ল্যান করেন... আপনার আম্মাকে নিয়ে কোথাও থেকে ঘুরে আসেন। আবর্তনসঙ্কুল অথচ বিবর্তনহীন জীবনধারার এই মানুষগুলোকে একবারের জন্য হলেও নিয়ে যান না রাতারগুলে... জোঁকের কামড় খাইয়ে আনুন... কিংবা লোনা পানি পেরিয়ে সর্বদক্ষিণের ক্ষণে জোড়া ক্ষণে বিচ্ছিন্নের ছেঁড়া দ্বীপে... রোদের তাপে গায়ের চামড়া পুড়িয়ে আনুন... অথবা মেঘালয় সীমান্তের পিয়াইন নদীর বিছানাকান্দি থেকে... পাথরে পা কেটে আনুন...
কথায় বলে, মানুষ নাকি দাঁত থাকতে দাঁতের গুরুত্ব বোঝে না। আসলে হবে, মানুষ মা থাকতে মায়ের গুরুত্ব (ঠিকমতো) বোঝে না। আমার এতো ভালো মাকে আমি সেভাবে দেখে রাখতে পারিনি। আল্লাহ্ মানুষকে অতি দামি জিনিস দেন তাঁকে পরীক্ষা করার জন্যে... সে সেইটাকে কিভাবে যত্নে রাখে এইটা দেখার জন্যে। আমি ফেইল করছি সেই পরীক্ষায়। আপনারা কইরেন না... যেই মানুষটার পায়ের নিচে পরম আরাধ্য বেহেশতের সন্ধান আছে... সে দামি না তো কে দামি???
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুলাই, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৫৮