
মাজদাক
সমাজজতন্ত্র নিয়ে আলোচনা বেশি হয়েছে ঊনিশ থেকে বিংশ শতাব্দির মধ্যে । আর মার্কসের মধ্য দিয়ে এই আলোচনা বেশি প্রগাঢ় হয়েছে নিঃসন্দেহে । শেষমেশ মার্ক্স ও এঙ্গেলসের মাধ্যমে “ সমাজতন্ত্র ” একটি রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে রূপ নেয় । তবে সমাজতন্ত্রের আলোচনায় পণ্ডিতবর্গের কাছে একটি বিষয় স্বীকৃত আছে যে ৫ম শতকের শেষ থেকে ৬ষ্ঠ শতকের প্রথমভাগে একজন ব্যক্তি সমাজতন্ত্রের প্রচার করেছিলেন । ইনি হলেন জরথ্রুষ্টবাদের অন্যতম মাবোদান-মোবাদ বা প্রধান যাজক , মাজদাক ! তার অনুসারিদের মতে তিনি ছিলেন আহুরা মাজদার নবী ! আর তাই পণ্ডিতবর্গ তাকে সমাজতান্ত্রিক নবী বলে অভিহিত করে থাকেন !
পারস্যের সাসানিড সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় স্বর্ণযুগ সময়ের সম্রাট প্রথম কোবাদের সময়ে আবির্ভাব ঘটে এই জরথ্রুষ্টিয় যাজকের (ফেরদৌসের শাহনাম ও অন্যান্য আরব লেখকের বর্ণণা থেকে জানা যায় । যদিও এর কোন দালিলিক প্রমাণ নেই )। তার ধর্মমত জরথ্রুষ্টিয় হলেও তার আচার জরথ্রুষ্টের বিখ্যাত যাজক ও ধর্মপ্রচারক মাগির প্রচলনকৃত ধর্মমত থেকে আলাদা ছিল । যদিও অনেকের মতে তার ধর্মমত মানির থেকে কিছুটা অনুপ্রাণিত বা উৎসাহিত ছিল । এখানে একটি কথা বলে রাখা দরকার যে দশম শতকের ইবনে আল নাদিম কর্তৃক রচিত আল ফিহরিস্ত-এর বর্ণনা অনুযায়ী আসলে দুজন মাজদাকের নাম জানা যায় যার মধ্যে প্রথম মাজদাক মাজদাকীয় জরথ্রুষ্টবাদ প্রচার করেছেন আর দ্বিতীয় মাজদাক কোবাদের সময় এক আন্দোলন গড়ে তোলেন। তবে ইতিহাসে এই দুই মাজদাককে এক করেই দেখা হয় ।
ফেরদৌসি কর্তৃক রচিত “শাহনাম”-য় মাজদাককে নিয়ে দুটি কবিতা বর্ণিত আছে । আর তা থেকে জানা যায় মাজদাক কোবাদের পরামর্শক ও খাদ্যভাণ্ডার ও অস্ত্রভাণ্ডারের তত্ত্বাবধায়কও ছিলেন । যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে তিনি ছিলেন একজন মাবোদান-মোবাদ , এর মানে হল তিনি ছিলেন একজন মহাযাজক কিংবা অন্যান্য যাজকদের গুরু । তবে তিনি যে কোবাদের সুদৃষ্টি লাভ করেছিলেন সে বিষয়ে সবাই একমত ।
তার সমাজতন্ত্র মতবাদ
মাজদাক মনে করতেন যে মানুষ সৃষ্টিগতভাবে স্বাধীন । সমাজের যত নিয়মকানুন যা শ্রেণী-বৈষম্য তৈরী করে তা স্রষ্টার নয় এসব মানুষের তৈরী । আর তাই মানুষ স্বাধীন হয়েও অন্য মানুষের অধীন । জানা যায় মাজদাক কোবাদকে প্ররোচিত করে এই আইন বহাল করিয়েছিল যে সম্পদ ও নারীর ওপর সবার কর্তৃত্ব থাকবে সমান । সবাই সমানভাবে নারী ও সম্পদ ভোগ করবে । এতে করে অনেকে চিত্রিত করেন যে মাজদাক আসলে নারীকে পণ্য এবং নারীর মতামত থাকুক বা না থাকুক সে সবার কাছে ভোগ্যবস্তু এই বলে উপস্থিত করেন । কিন্তু এখানে অনেকে ভিন্নমত পোষণ করে , কেননা এর প্রমাণ পাওয়া যায় না । এহসান ইয়ারশায়ের মতে মাজদাকের দীক্ষা অনুযায়ী মাজদাকের আন্দোলনে এই দাবী ছিল যে কেউ একের অধিক স্ত্রী রাখতে পারবে না এবং কোন প্রকার হারেম রাখতে পারবে না যাতে করে যাদের স্ত্রী নেই তারা যেন স্ত্রী পায় ।
তিনি এও চেয়েছিলেন যে বিয়ের খরচ যেন কমে যায় মানে কাবিন যেন কম হয় এতে করে যারা বিবাহিত নন বা যাদের কাবিন দেবার মত সম্পদ নেই তারা যেন বিয়ে করতে পারে । মা্জদাকের মৃত্যুর পর তার অন্যান্য অনুসারিরা যারা ইসলামের প্রারম্ভের সময় ছিলেন তাঁদের মধ্যে অভিযুক্ত কোন অনাচার দৃষ্ট হয়নি বলে অনেকেই এই অভিযোগ বাতিল করেছেন ।
মাজদাক চেয়েছিলেন সম্পদের ব্যবহারে যাতে শ্রেণীভিত্তিক না হয় । সবাই সমানভাবে সমান পরিমাণে যেন সম্পদ ভোগ করতে পারে । তার এমন মতবাদের পেছনে শাহনামায় বর্ণিত আছে যে এক দূর্ভিক্ষের সময় যখন সারা সাসানিদ সাম্রাজ্যে দূর্ভিক্ষ দেখা দিল তখন মাজদাক কোবাদকে যুক্তির মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে উপনীত করেন যে , দূর্ভিক্ষে যদি এরা মারা যায় তবে অভিজাতরা এদের খুনি বলে অভিহিত হবেন । কোবাদ তাকে সমর্থন দিলে তিনি জনসাধারণকে বলেন যে যেখানেই গম পাবে তা সংগ্রহ করে নাও । এর বিপরীতে যদি গম সংরক্ষণকারী বিনিময় চায় তবে তা প্রদান করো । ( বাংলা অনুবাদে যানা যায় যে তারা যেন বিনিময় চাইলে মানে দাম চাইলে দিয়ে দেয় । কিন্তু পল লুটিনজারের মতে শাহনামায় বলা আছে যে বিনিময় চাইলে গ্রামগুলো যেন ধ্বংস করে দেয় )
জনসাধারণ তার কথামত সারা পারস্যে লুটপাট শুরু করে দেয় ।
পেত্রিসিয়া কর্নের মতে তার উদ্দেশ্য ছিল গরীব কৃষকদের ঘিরে । সব সময়ের মত তারাই অভিজাত লোকদের বিলাসিতার কলুর বলদ হচ্ছিল । মাজদাক চেয়েছিল এখানে যেন এই গরীব কৃষক ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় । তারা সম্পদ ভোগে যে সবার পিছিয়ে ছিল তারা যেন ঠিক অভিজাতদের সমান ভোগ করার অধিকার পায় এই ছিল তার চাওয়া । আর এই চাওয়ার মধ্যে দিয়ে সে চেয়েছিল এরাও যেন নারীদের ক্ষেত্রে সমান অধিকার পায় ।
মাজদাক নিয়ে বিতর্ক
অনেকের মতে মাজদাক বলে কেউ ছিলেন না । এইচ গবের মতে মাজদাক বলে কেউ ছিলেন না আর থাকলেও তিনি মোটেও এমনটা ছিলেন না আর তিনি কোন আন্দোলন করেননি , যা করার করেছেন কোবাদ । তিনিই সম্পদধারীদের বিরুদ্ধে জনসমাধারণের জন্য সাম্যবাদের বাণী প্রচার করেছেন । এর পেছনে কারণও আছে । সমসাময়িক যতগুলো বর্ণনা পাওয়া যায় সেগুলোর কোনটাতেই মাজদাকের নাম পাওয়া যায় না আর এতে করে অনেকেই এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন । তবে ক্লিমার মতে কোবাদের ছেলে খসরু মাজদাকের কোন চিহ্ন রাখেননি আর তাই মাজদাককে পাওয়া যায় না কোন সমসাময়িক বর্ণনায় পাওয়া যায় আরবদের লিখাতে । তবে পেট্রিসিয়া কর্ন গবের মতের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করেন । একজন রাজা অভিজাত শ্রেণীদের রাগিয়ে দিয়ে কীভাবে তার রাজ্যকে টিকিয়ে রাখবে ? তার বক্তব্য অমূলক নয় ।
আরবদের মধ্যে তাবারি ও আল বিরুনীর লিখাতেও মাজদাকের স্থান হয়েছে । আল বিরুনীর মতে মাজদাক ছিলেন কোবাদের প্রধান কাজী । মাজদাক সম্পর্কে দার বইতে সামান্যটুকুই পাওয়া যায় অদ্ভুতভাবে মাজদাক সম্পর্কে তার লিখা খুঁজে পাওয়া যায়নি ।
মৃত্যু
মাজদাককে নিয়ে একেকজনের একেক মত পাওয়া যায় । তবে এটুকুতে সবাই একমত যে তিনি সাম্যবাদী ছিলেন আর যা কোবাদের পুত্র খসরুর পছন্দ ছিল না তাই সে মাজদাক ও তার অনুসারিদের হত্যা করে তাদের সমস্ত চিহ্ন মুছে দেন । বিশেষজ্ঞদের মতে ৫২৪ থেকে ৫২৮ সালের মধ্যে তাকে হত্যা করা হয় । তার মৃত্যু নিয়ে শাহনামায় বর্ণিত আছে যে মাজদাক বুঝে গিয়েছিল খসরু তার ধর্মমত মানে না । তাই এই বিষয়ে তিনি কোবাদকে অবগত করলে কোবাদ খসরুকে এই নিয়ে প্রশ্ন করে , খসরু বলে যে সে মনে করে মাজদাকের এই ধর্মমত একেবারেই মিথ্যা ও পথভ্রষ্টকারি এক ধর্মমত এবং সে কোবাদ থেকে ৬ মাস সময় চেয়ে নেয় তার মত প্রমাণের জন্য ।
এই ৬ মাসের মধ্যে কোবাদ বিভিন্ন স্থান থেকে জ্ঞানীদের এনে জমায়েত করে মাজদাক যে মিথ্যা ধর্মমত প্রচার করছে তা প্রমাণের জন্য চেষ্টা করে । ৬ মাস পর এক জ্ঞানী কোবাদের দরবারে গিয়ে এই বলেন যে যদি মাজদাকের বাদ মানে নারী ও সম্পদকে সর্বসাধারণের জন্য সমান ভোগ্য করে দেয়া হয় তবে পুত্র কী করে পিতাকে চিনবে আর পিতা কী করে পুত্রকে ? এবং সবাই যদি সমান হয় তবে কে কাকে শাসন করবে আর কে শাসিত হবে ?
কোবাদ সেই জ্ঞানীর কথা শুনে বুঝে নেয় যে মাজদাক ভুল পখে সবাইকে ধাবিত করেছে । সবাই মিলে মত দেয় যে মাজদাককে যেন বের করে দেয়া হয় রাজসভা থেকে । কোবাদ মাজদাকের ওপর এতটাই রুষ্ট হয় যে খসরুর হাতে তাকে ন্যস্ত করে এই বলেন যে “তুমি তাকে নিয়ে যা ইচ্ছা করতে পারো । আর তার ব্যাপারে যেন আমি আর কিছু না শুনি।”
খসরু মাজদাকের তিন হাজার অনুসারীদের তার এক উপবনে নিয়ে গিয়ে এমন ভাবে মাটিতে পুঁতে দেবার নির্দেশ দেন যাতে করে তাদের শরীরের উর্ধ্বাংশ থাকে মাটির নিচে আর নিম্নাঙ্গ থাকে মাটির ওপরে । সবাইকে এভাবে পুঁতে দেয়া হয় । এরপর মাজদাককে সেই উপবনে নিয়ে আসা হয় আর তার অনুসারিদের এমন অবস্থা দেখে তিনি মূর্ছা যান । জ্ঞান ফিরবার পর তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তির মেরে হত্যা করা হয় । শাহনামায় ফেরদৌস মাজদাকের পরিণতি ব্যক্ত করবার পর এই উপদেশ দেন যে কেউ যেন মাজদাকের এই মতবাদ অনুসরণ না করেন !!

শাহনামায় বর্ণিত ও চিত্রিত মাজহাকের মৃত্যদণ্ড ও তার অনুসারিদের জীবিত কবর দেবার ঘটনা
পরিশিষ্ট
মাজদাক ইতিহাসে আজও স্মরণীয় হয়ে আছে তার কর্মের জন্য । তিনি সমাজতন্ত্র প্রচার করলেও ধর্মের বাইরে গিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে চায়নি । আবার তার এমন সমাজতন্ত্র অভিজাতরা মেনে নিতে পারেনি । পারেনি বলে মাজদাককে মরতে হয়েছিল । মাজদাক মারা গেলেও তার অন্যান্য অনুসারিদের কারণে তিনি ইতিহাসে জায়গা করে নেন । সমসাময়িক বর্ণনায় তাকে পাওয়া না গেলেও তার অনুসারিদের প্রচারিত কিংবদন্তির কারণে আরবদের লেখায় জায়গা পায় মাজদাক আর পুরো পৃথিবী জানতে পারে এক সমাজতান্ত্রিক নেতার কাহিনী , যিনি শ্রেণী বৈষম্য দূর করতে চেয়েছিল , আর চেয়েছিল দুর্বলরাও যেন প্রতিষ্ঠা পায় তেমনই যেমন সবলরা প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে ।
রচনাকারী: নিবর্হন নির্ঘোষ ।
#মাজদাক
তথ্য সহায়ক
*Mazdak – Paul Luttinger.
* The Cambridge History Of Iran , Vol 2- Ehsan Yarshater,
* Iranian Reception Of Islam – Patricia Corne .
*Ancient Nations – Al Biruni .
*শাহনামা – বাংলা অনুবাদ
* Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২২ রাত ১২:২৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



