somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শিরোনামহীন

২৫ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ২:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চোখ মুছে উঠে বসে তিন্নি। আর কান্না নয়, জীবনের শেষ চিঠি লিখে ইতি টানবে এ কষ্টের জীবনের। ভারী শরীরটাকে বয়ে বয়ে সে এখন ক্লান্ত। যেমন ক্লান্ত হয় সারাদিন দাঁড় বেয়ে মাঝি, প্যাডেল চালিয়ে বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা। ঘুমহীন চোখ, মুমূর্ষু ক্যান্সার রোগী তিন্নি। ফোন নয়, কী হবে আর এ কণ্ঠস্বর শুনিয়ে, তার চেয়ে এই ভালো লিখে রাখুক তার জীবনের শেষ কিছু কথা।

প্রিয় বাবুল,

এখন আর তোমাকে এ সম্বন্ধে ডাকা ঠিক হবে না।

আমি জানি, তবু শেষ বেলায় এ ভুলটুকু করে গেলাম। স্ট্যান্ডার্ড ফ্যামিলি বলে খ্যাত চৌধুরী বাড়ির মেয়ে আমি, ঐ স্ট্যাটাস বজায় রাখার জন্য বাবা তোমাকে খুঁজে খুঁজে বের করলেন, পাত্র হিসেবে তোমার মতো যোগ্য পাত্র নাকি তখন বিরল। প্রাইভেট ক্লিনিকের ডাক্তার, অসুবিধা নাই, এমবিবিএস ডাক্তার বলে কথা। মহা জাঁকজমকে বিয়ে হলো, তোমার বাড়িতে গিয়ে কিছুটা অবাক হই, তোমার বোন জজকোর্টের এডভোকেট, মা রেডক্রিসেন্টের সম্মানিত সদস্য, বাবা বড় নেতা। উনি অতিশয় আল্লাহ ভক্ত মানুষ, দলীয় মানমর্যাদা রক্ষার্থে তিনি আলাদা থাকেন ধানমণ্ডির বাসাতে। ভোর হলে কেবল আমাকে দেখি সারা বাড়ি। শাশুড়ি, ননদ আর তোমার সকাল হয় দুপুর বারোটায়। ডিসপেনসারিতে যাও বিকাল, মা বের হন, ননদ বের হন বারোটায়, আর দেখা পাই রাত বারোটাতে, সারাটা দিন এ বিশাল বাড়িতে আমি একা। এই তিন্নি সেই তিন্নি, যে ভার্সিটির উদ্যান মাতিয়ে রাখতো তার নিষ্কলুষ রিনিঝিনি মিষ্টি হাসিতে, চঞ্চল চাহনী, দুরন্ত ছুটে চলা, সব কিছু থেমে গেলো এই প্রাসাদের মাঝেই। সকাল কাটতো একাকী, বিকাল কাটতো একাকী আর ঘুমাতাম কেঁদে কেঁদে। কখন তুমি এসে ঘুমাতে বুঝতেও পারিনি, একটা সন্তানের তৃষ্ণা আমাকে অস্থির করে তোলে, তুমি তখনো বলছো তোমার সময় হয়নি। কিন্তু আমার সময় যে আর কাটে না, কোনো কিছুতেই আমার অভাব নেই, শুধু নেই তোমার অবসর, নেই আমাকে ভালোবাসার কোনো মানুষ, একাকীত্ব আমাকে দহন করেছে, আমাকে ভেতরে বাইরে নিঃস্ব করেছে, তবু তোমার সময় হয়নি, হঠাৎ করে আমার ভীষণ জ্বর হলো,

তোমাকে ফোন দিলাম, তুমি না এসে তোমার সহকর্মী এহসানকে পাঠালে। আমি তখন জ্বরে কাঁপছি, মাথার যন্ত্রণায় ছটফট করছি। বিয়ের পর যন্ত্রের সঙ্গে একটি হাত আমাকে স্পর্শ করলো, সে হাত এহসানের। আমাকে সারা দিন খাওয়ানো, আমার মাথায় জলপট্টি দেয়া সবই এহসান করলো। এরপর ওর কাজ হলো নিয়মিত আমাকে তদারকি করা, খোঁজ নেয়া, মাঝে মাঝে ওর গাড়িতে করে আমাকে ঘুরানো। প্রতিদিন বাইরে থেকে এলে আমার কান্নায় বুকটা ভেঙে যেতো, তোমাকে বলতাম, তুমি বলতে, এহসান ভালো ছেলে, মাঝে মাঝে ঘুরে এসো।

আমার প্রতি তোমার এই উদাসীনতা আমাকে ধীরে ধীরে এগিয়ে দিলো এহসানের দিকে। একদিন ধানমণ্ডির লেকের কাছে শ্বশুর আমাকে এহসানের সঙ্গে হাত ধরা অবস্থায় দেখলেন, তোমাকে জানালেন, তুমি একটুখানি নড়ে উঠলে, বললে, এহসানের সঙ্গে বাইরে যাওয়ার দরকার নেই। বাবার চোখ ভালো নয়, তোমাকে শুধু সন্দেহ করবে, সে আমি চাই না। আমি আকুল হয়ে বললাম, বাবুল বাবাকে দোষ দিচ্ছো কেন, তোমার চোখ কেন কিছু বলছে না? তুমি কেন আমাকে এহসানের সঙ্গে বাইরে যেতে দিচ্ছো? তুমি হাসলে, বললে বিশ্বাস না থাকলে ভালোবাসা থাকে না।

হায়রে বিশ্বাস। এহসানের আকুলতা, তার সঙ্গ তার ভালোবাসা আমাকে পাগল করে তুললো, তোমার নির্লিপ্ততা আমাকে কষ্ট দিতে লাগলো, এক সময় এহসান ছাড়া আমার সব কিছু শূন্য মনে হতে লাগলো। তোমার বাড়িতে থাকা অবস্থায় তোমাকে আমি ডিভোর্স নোটিশ পাঠালাম, নোটিশটা আমার হাতেই এলো, তুলে রাখলাম তোমার তিন নম্বর ফাইলে। তারপর এক কাপড়ে একদিন তোমার বাড়ি ত্যাগ করলাম। ডিভোর্সের তিনমাস পরে আমরা বিয়ে করলাম। এহসানের সকাল হতো ভোর পাঁচটায়, নামাজ পড়ে আমরা দুজন হাঁটতে বেরুতাম, সুন্দর জীবন-যাপন করছিলাম। হঠাৎ তোমার অসুস্থতার খবর পেলাম এহসানের কাছে, ও বিলাপ করছিল ওর ভুলেই নাকি তুমি মরতে বসেছো। আমি চলে আসার পর থেকে তুমি চেম্বারে যাওনি একদিনও, কারো সঙ্গে কথা বলতে না, কিছুই বলতে না, হাসতে ভুলে গেছো, সব নাকি এহসানের প্রতি তোমার অপরিসীম বিশ্বাসের পরিণতি। আমার মনে সন্দেহ জমলো তাহলে কি তুমি আমাকে নয়, এহসানকেই বেশি ভালোবাসতে। আমার জন্য নয়, এহসানের বিশ্বাসঘাতকতায় তুমি এমন নির্বাক হয়ে গেছো, তাহলে কি আমি তোমার জীবনে একটা পুতুল ছিলাম? এহসানই কি জীবন্ত? আমার চলে আসাটা তোমার কাছে এহসানের প্রলোভন মনে করলে? আমি কি এভাবে আসতে পারতাম না? কেন থাকতাম তোমার সঙ্গহীন সঙ্গী হয়ে? এসব প্রশ্নের উত্তর আমি সেদিন পেলাম, যেদিন হাসপাতালে, তুমি তোমার ক্লান্ত আঁখি দুটো তুলে বললে, কেন গেলে তুমি আমাকে ছেড়ে? আমি কি তোমার কাছে এতোই অপাঙক্তেয় ছিলাম? যে সুখের আশায় তুমি এহসানের ঘর আলোকিত করলে? আমার জীবনটাকে করলে অর্থহীন? বাবুল আমি ঐদিন বুঝে গেলাম, আমার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। ঘরে এহসানের ব্যাকুল ক্রন্দন, তোমার অভিযোগ, সব কিছু আমার জন্য। তুমি যখন এ চিঠি পাবে, তখন হয়তো আমার লাশ, লাশকাটা ঘরে, পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও।

ইতি

তিন্নি

অসুস্থ বাবুল দৌড়াচ্ছে, এহসান চেম্বার থেকে ছুটে চলেছে বাসার দিকে, ওদের একটাই লক্ষ্য তিন্নিকে বাঁচাতে হবে! কিন্তু তিন্নির লাশ এখন ডোমেরা ব্যবচ্ছেদ করবে। বাবুল ক্ষীণ স্বরে বলছে, তিন্নি একা যেও না, আমাকেও সঙ্গে নিয়ে যাও।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ২:৩৫
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×