somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফিরে দেখা, আহসান হাবীব

০৪ ঠা আগস্ট, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ কখনো আমার বই পড়েনি বলেই আমার ধারণা। কারণ, আমার লেখা নিয়ে তাকে কখনো কোনো মন্তব্য করতে শুনিনি। আমিও আমার কোনো বই তাকে কখনো পড়তে দিইনি, মেজো ভাই জাফর ইকবালকেও না। কারণ, আমার একটু লজ্জাই লাগত। ছোট ভাই বলে আমাকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশাও একটু বেশিই হতো। মেলায় বেশি বই বেরোলে বলত, ‘শাহীন তো দেখছি বইয়ের ফ্যাক্টরি হয়ে উঠছে...’ এই ধরনের (আমার বাসার নাম শাহীন)। তো সেই বড় ভাই হঠাৎ একদিন আমাকে ফোন করল।
—এই শাহীন?
—বল।
তোর লেখা সমরেশ মজুমদার খুব পছন্দ করেছে...আচ্ছা রাখি। বলে ফোন রেখে দিল।
তার তরফ থেকে লেখালেখি নিয়ে সেই একবার মাত্র প্রশংসাবাক্য। তা-ও আরেকজনের মন্তব্য তার মুখে। তবে যেবার আমি কিউবার হাভানা কনটেস্টে কার্টুনে পুরস্কার পেলাম, তখন সে আমার পল্লবীর বাসায় এসে নগদ কিছু টাকা দিল খুশি হয়ে। আমার লেখালেখি আর কার্টুনে ওই দুইবার তার প্রতিক্রিয়া...একবার ক্যাশ, একবার কাউন্ট! আমার সেই ভাইটা আর নেই।
তার ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার খবরটা যখন পেলাম...সে বেশ চাঁছাছোলাভাবেই সিঙ্গাপুর থেকে ফোনে বলল—শোন, লুকোছাপার কিছু নেই, ক্যানসার ধরা পড়েছে, দ্রুত ছড়াচ্ছে। আম্মাকে বল এখনি বল...আর ভাইবোনদের বল দোয়া করতে...আচ্ছা রাখি।
আমি মাকে বললাম। মা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে। তার মৃত্যুসংবাদটাও আমি মাকে দিলাম...এই কঠিন কাজটাও আমাকেই করতে হয়েছে।
১৯ জুলাই। উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম কার্টুনিস্ট কাজী আবুল কাসেমের (দোপেঁয়াজা) মৃত্যুবার্ষিকী ছিল, তাঁকে স্মরণ করে একটা লেখা লিখেছিলাম বণিক বার্তায়, রাতে বাড়ি ফিরে সেটাই পড়ছিলাম (কে জানত তারও মৃত্যু ওই ১৯ জুলাই হবে)। এ সময় আমেরিকা থেকে মেজো ভাবি (ইয়াসমিন হক) ফোন করলেন। তিনি খুবই শক্ত ধাতের মানুষ। তখন রাত এগারোটা বিশের মতো বাজে...তিনি ফোনে কাঁদতে কাঁদতে বললেন—শাহীন, আমরা দাদাভাইকে ধরে রাখতে পারছি না...তিনি চলে যাচ্ছেন...তাঁর সবকিছু একে একে ফেইল করছে...তাঁর প্রেশার এখন ৪০..., শাহীন, এখন ৩০..., শাহীন এখন ২০..., শাহীন এখন ১০... ... ... শাহীন, দাদাভাই নেই। ওপাশে তার আর্তনাদ শুনলাম। ফোন কেটে গেল। আমি তার পরও ফোন কানে ধরে রইলাম, নিঃশব্দ ফোন। বোনেরা ছুটে এসে ঘিরে ধরল।

—কী রে? কী হলো??
আমি ফিসফিস করে বললাম, ‘দাদাভাই মারা গেছে...’ কী অসম্ভব একটা বাক্য। মনে আছে, ঠিক ৪০ বছর আগে আমার মেজো ভাই জাফর ইকবাল আম্মাকে বলেছিল, ‘আম্মা, আব্বাকে মিলিটারিরা গুলি করে মেরে ফেলেছে...!’
ঠিক সেই রকম আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘আম্মা, দাদাভাই মারা গেছে...’
বহু বছর পর...প্রায় ৪০ বছর পরই বলব আমাদের পুরো পরিবার একসঙ্গে আর্তনাদ করে উঠল...আহ্, কী কষ্ট!
...তার পরের ঘটনা সবাই জানে। তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মানে ঢাকায় আনা হলো। আপামর জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে প্রথমে শহীদ মিনার, তারপর জাতীয় ঈদগাহে জানাজা...সবশেষে নুহাশপল্লীতে দাফন।
মাঝখানে তাকে আমরা পরিবারের সদস্যরা দেখতে গেলাম বারডেমের হিমঘরে। কী আশ্চর্য একটা জায়গা! ঝকঝকে পরিষ্কার। স্টেইনলেস স্টিলের একটা বিশাল ফ্রিজ। সশব্দে একটা ট্রে টেনে বের করা হলো। সাদা কাফনে জড়ানো হুমায়ূন আহমেদ। ঠান্ডার একটা ধোঁয়াটে ভাপ বেরোল...তার মুখের কাপড় সরানো হলো। নীল একটা মুখ...ক্লিন শেভড ক্লান্ত চোখ দুটো বোজা...ভেজা চুলগুলো এলোমেলো...চারদিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো, এ যেন তার সেই তোমাদের জন্য ভালোবাসা উপন্যাসের একটা দৃশ্যে আমরা দাঁড়িয়ে আছি...মহান ফিহা শুয়ে আছে ঝকঝকে স্টেইনলেস স্টিলের একটা ট্রেতে নিথর...আহ্! এত কষ্ট ছিল এক জীবনে? আমার মা মহান ফিহার গালে গাল ঠেকিয়ে কেঁদে উঠলেন হু হু করে...আমি স্পর্শ করলাম, তার চুল গাল মুখ...আমার প্রিয় বড় ভাইটা প্রতিবাদহীন শুয়ে রইল...ছোটবেলায় তার মাথায় বিলি কেটে দিলে গল্প শোনাত...আমি বিলি কাটার মতো তার ভেজা চুলে হাত রাখলাম...
নুহাশপল্লীতে তার কবরে আমি নেমেছি। আমার পাশে নুহাশ...আমরা অপেক্ষা করছি। তাকে আমাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে, এ যেন তার বিখ্যাত উপন্যাস নন্দিত নরকের মন্টুর জন্য অপেক্ষা করা। আমরা তাকেই শুইয়ে দেব মাটিতে, যেখানে সে সাষ্টাঙ্গে শুয়ে থাকবে একা। ওপরে তাকিয়ে দেখি পুলিশ, র‌্যাব আর বর্ডার গার্ডের একটা জটিল বেষ্টনী, তার ওপর শত শত ক্যামেরা...সবাই অপেক্ষায় তাকে আনা হবে...এখনই আনা হবে। আনা হলো। কফিন থেকে বের করা হলো...ডাক্তার এজাজ কাঁদতে কাঁদতে তার পায়ের দিকটা আমার দিকে তুলে দিয়ে বলল, ‘শাহীন ভাই, স্যারকে ধরেন...।’ আমরা তাকে ধরে নামালাম গহিন কবরে। হালকা নরম একটা শরীর। শুইয়ে দিলাম তাকে শেষশয্যায়। আমি তখন বসে পড়ে তার পা, হাত সব ধরে ধরে দেখছিলাম। সবই কাফনের কাপড়ে ঢাকা। তার পরও ধরছিলাম তার চেনা হাত-পাগুলো, এখন কত অচেনা! একটা বিষয় খেয়াল করলাম, তার ডান পা-টা হাঁটুর কাছে একটু ভাঁজ করা। মৃত্যুর পর ঠিক এ রকমটাই ছিল আমার বাবারও, ভাইয়ার মুখে শুনেছিলাম। কেন এই মিল?
সে অলৌকিক বিষয়গুলো খুব পছন্দ করত। আর তখনই যেন একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটল। হঠাৎ দেখি, আমার পেছনে কবরের কোনায় দুটো জিনিস পড়ে আছে। একটু আগেও এ দুটো ছিল না। আমি কিছু না ভেবেই জিনিস দুটো পকেটে ঢুকিয়ে ফেললাম।
ফেরার পথে গাড়িতে বসে জিনিস দুটো পকেট থেকে বের করলাম। একটা ছোট্ট কার্ড সুতো বাঁধা ট্যাগের মতো, তার ওপরে ইংরেজিতে লেখা আহমেদ হুমায়ূন, নিচে ডাক্তারের নাম, হাসপাতালের নাম, একটা সিরিয়াল নাম্বার আর তারও নিচে ছোট্ট করে লেখা ‘এটাচড টু টো’। তার মানে এই ট্যাগটা তার বুড়ো আঙুলে বাঁধা ছিল আর ছিল একটা প্লাস্টিকের ব্যান্ড।
সেটাও নিশ্চয়ই পায়ে রিংয়ের মতো পরানো ছিল। কিন্তু খুলে গেল কীভাবে? নিউইয়র্কে তাকে ধোয়ানোর সময় খুলে যেতে পারে। কিন্তু কাফনের ভেতরেই থাকার কথা, বাইরে এল কীভাবে? বাইরে এলই যদি, আমার হাতে কেন পড়ল? তবে কি তার শেষ চিহ্নটা আমাকেই দিয়ে গেল আমার প্রিয় বড় ভাইটা?
অনেক আগে থেকেই আমার মানিব্যাগে সব সময় একটু মাটি রাখতাম, শহীদ বাবার কবরের মাটি। আর এখন আছে বড় ভাইয়ের ট্যাগটা। দুটো জিনিস সঙ্গে নিয়েই ঘুরি...কেন, আমি নিজেই জানি না।
মহান চৈনিক দার্শনিক কনফুসিয়াস একবার তাঁর শিষ্যদের উদ্দেশে বললেন:
—আজ আমি তোমাদের একটা কৌতুক বলব। শিষ্যরা সবাই হতভম্ব। কারণ, চীনা দার্শনিকেরা তখন মনে করতেন হাস্য-কৌতুক এসব মূর্খদের কাজ, জ্ঞানীদের নয়। শিষ্যরা কিছু বলল না। কনফুসিয়াস কৌতুকটি বললেন, সবাই হাসল তাঁর কৌতুক শুনে। কনফুসিয়াস দ্বিতীয়বারও ওই একই কৌতুক বললেন...এবার কেউ হাসল না, তৃতীয়বারও তিনি ওই একই কৌতুক বললেন, এবারও কেউ হাসল না। তখন কনফুসিয়াস বললেন, ‘আমরা একটা হাসির ঘটনায় একবারই হাসি। কিন্তু একটা দুঃখের ঘটনায় কেন বারবার কাঁদব?’
হে মহান কনফুসিয়াস...ক্ষমা করবেন...আমাদের পুরো পরিবারকে বারবার কাঁদতে হচ্ছে...একটি দুঃখের ঘটনা আমাদের বারবার চোখের পানি ফেলতে বাধ্য করছে...কে জানে, হয়তো একদিন সময় বদলে দেবে সবকিছু...
যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের—মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা...

(জীবনানন্দের এই লাইনটা বড় ভাই সব সময় ব্যবহার করত...এবার আমি করলাম তার জন্য...)

আহসান হাবীব: লেখক ও কার্টুনিস্ট।


View this link
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গাজার যুদ্ধ কতদিন চলবে?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৮ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের হামলার আগে মহাবিপদে ছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু৷ এক বছর ধরে ইসরায়েলিরা তার পদত্যাগের দাবিতে তীব্র বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন৷ আন্দোলনে তার সরকারের অবস্থা টালমাটাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্যামুয়েল ব্যাকেট এর ‘এন্ডগেম’ | Endgame By Samuel Beckett নিয়ে বাংলা ভাষায় আলোচনা

লিখেছেন জাহিদ অনিক, ২৮ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৮



এন্ডগেম/ইন্ডগেইম/এন্ডগেইম- যে নামেই ডাকা হোক না কেনও, মূলত একটাই নাটক স্যামুয়েল ব্যাকেটের Endgame. একদম আক্ষরিক অনুবাদ করলে বাংলা অর্থ হয়- শেষ খেলা। এটি একটা এক অঙ্কের নাটক; অর্থাৎ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রায় ১০ বছর পর হাতে নিলাম কলম

লিখেছেন হিমচরি, ২৮ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১

জুলাই ২০১৪ সালে লাস্ট ব্লগ লিখেছিলাম!
প্রায় ১০ বছর পর আজ আপনাদের মাঝে আবার যোগ দিলাম। খুব মিস করেছি, এই সামুকে!! ইতিমধ্যে অনেক চড়াই উৎরায় পার হয়েছে! আশা করি, সামুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

পজ থেকে প্লে : কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

লিখেছেন বন্ধু শুভ, ২৮ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:১৫


.
একটা বালক সর্বদা স্বপ্ন দেখতো সুন্দর একটা পৃথিবীর। একজন মানুষের জন্য একটা পৃথিবী কতটুকু? উত্তর হচ্ছে পুরো পৃথিবী; কিন্তু যতটা জুড়ে তার সরব উপস্থিতি ততটা- নির্দিষ্ট করে বললে। তো, বালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিরোনামে ভুল থাকলে মেজাজ ঠিক থাকে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৮ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৫


বেইলি রোডে এক রেস্তোরাঁয় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে একজন একটা পোস্ট দিয়েছিলেন; পোস্টের শিরোনামঃ চুরান্ত অব্যবস্থাপনার কারনে সৃষ্ট অগ্নিকান্ডকে দূর্ঘটনা বলা যায় না। ভালোভাবে দেখুন চারটা বানান ভুল। যিনি পোস্ট দিয়েছেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×