somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এক ছটাক ঈদ আনন্দ

১১ ই জুন, ২০১৮ দুপুর ১:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পর্ব- ১

আমাদের উৎসব উদযাপন গুলো কেমন যেন শুধু খাওয়া খাদ্যতেই সীমাবদ্ধ। ঈদ উদযাপন মানে, নিজ বাসায় ভাল-মন্দ খেলাম, আত্মীয়-স্বজনের বাসায় খেলাম, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেলাম। এইতো।

ইদানীংকালে এর সাথে যোগ হয়েছে খাওয়া খাদ্যের সাথে নিজেদের সেল্ফি তুললাম সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করলাম।
এমনকি বাঙালি মুসলিম বিয়েবাড়ির মেইন উৎসব মানেও ওই এক খাওয়া খাদ্যই। বরপক্ষ মেয়ের বাড়িতে গিয়ে খাবে, মেয়েপক্ষ ছেলের বাড়িতে এসে খাবে। ছেলের বাড়িতে খাওয়া খাদ্য উৎসবের নাম 'বৌ ভাত!' । মেয়ে বাড়িতে খাওয়া খাদ্য উৎসবের ফিক্সড কোনো নাম নেই, বিয়ে পড়ানো বা আক্দ নামে এ উৎসব পাড়ি দেয়া হয়।

পশ্চিমা বিশ্বে প্রতিটি উৎসবের যেমন নির্দিষ্ট কিছু উপাদান থাকে আমাদের এদিকে সেরকম কিছু নেই। আসলে নেই বলাও যুক্তি সঙ্গত না, বলা যায় এখন নেই।

বাঙালি মুসলিম সমাজের অতীত ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় আমাদের এদিকে অনেক কায়দায় উৎসব পালন করা হতো। ইভেন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগেও ঈদ উৎসব উদযাপনের বিভিন্ন উপাদান ছিল; যেমন: সজ্জিত হাতি-ঘোড়া-পালকি সমেত আনন্দ মিছিল, সন্ধ্যায় নবাব বাড়িতে নৃত্য, গীত, গ্রামে যাত্রা-পালা বা পুঁথি পাঠ উৎসব ইত্যাদি।

বিয়ের উৎসব গুলোও শুধু পোলাও-রোস্টে সীমাবদ্ধ ছিল না। বিয়ে উপলক্ষে ঘটা করে পুকুরে জাল ফেলা হত। সাত দিন আগ থেকে নায়রীরা বিয়ে বাড়িতে আসা শুরু করত।

কাঁচা হলুদ, আদা মুখে নিয়ে গীত গাইতে গাইতে বর বা কনের কানে ভাপ দিত। পান, সুপারি, দূর্বা ঘাস দিয়ে মুখ বরণ করত। নতুন বউকে কেন্দ্র করে বাড়ির উঠানে ছোটরা পালা আয়োজন করত। এলাকার বউ-বেটি সবাই ভিড় জমায়ে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি করত। কনের মুখে আলতা আর ঝিনুক চূর্ণ পেস্ট করে ফোটা-ফুটি দেয়া ছিল সবচেয়ে কমন। এই ফোটা-ফুটি দেয়া মুখই বলে দিত কনে কে। এ সব কিছুই ছিল উৎসবের উপাদান।

হিন্দুয়ানা বলে, কিংবা আধুনিকতার ছলে বাঙালি মুসলিম উৎসব গুলো আজ বড় পানসে, বড় একঘেয়েমি। পানসে ভাব দূর করার জন্য বাঙালি খায় আর সেল্ফি দেয়।

বছর কয়েক আগের কথা। এক কমিউনিটি সেন্টারে বৌ-ভাত খেতে গিয়েছি। চমৎকার ব্যবস্থা। অতিথির সংখ্যা কম। প্রচুর আয়োজন। থালা-বাসনগুলো পরিচ্ছন্ন। যারা পোলাও খাবেন না তাঁদের জন্য সরু চালের ভাতের ব্যবস্থা, যারা গরু খাবেন না তাঁদের জন্য খাসির রেজালা। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে দেখলাম বেশ কিছু বিদেশি মানুষও আছেন। তাঁরা বিয়ের অনুষ্ঠান দেখতে আগ্রহী। দেখাবার মত কোনও অনুষ্ঠান নেই বলে কন্যার বাবা খানিকটা বিব্রত। এটা যে শুধু ‘খাওয়ার’ অনুষ্ঠান তা বলতে বোধহয় কন্যার বাবার খারাপ লাগছে। বিদেশিরা যতবারই জানতে চাচ্ছে, মূল অনুষ্ঠান কখন শুরু হবে? তত বারই তাঁদের বলা হচ্ছে, হবে হবে।

সত্যি কথা বলতে কী আমদের উৎসব গুলোই এমন। আমরা কম বেশি সবাই চাই ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনায় উৎসব উদযাপন করবো। ভাবি অনেক অনেক মজা করবো। কিন্তু উৎসবের নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানমালা না থাকায় উৎসবের দিনগুলোতে বেশিরভাগ সময় নিরাশ হতে হয়।

যেমন, ঈদুল ফিতরের দিন। এ দিন যাবতীয় মজা ঈদ নামাজ কে কেন্দ্র করে ঈদগাহ পর্যন্তই। ঈদগাহ থেকে বাসায় এসে ঈদ সেলামী তোলার পর ঈদ ঈদ ভাবটা কেমন জানি কমতে থাকে। বাসার মুরুব্বিরা হয়ত প্রতি দিনের মতই আড্ডা দিচ্ছে। পার্থক্য শুধু ঈদের দিন পায়জামা আর স্যান্ডো গেঞ্জি (গরমে পাঞ্জাবী গায়ে রাখা দুষ্কর, তাই মনে হয়) পরে বাড়ির সামনে যেখানে সাধারণত কখনো বসা হয় না সেখানে চেয়ার পেতে গোল হয়ে বসে টুকটাক কথা-বার্তা চালানো হচ্ছে। খানিক বাদে বাদে একটু সেমাই বা চা চাখা হচ্ছে। সিগারেট জ্বালানো হচ্ছে। একজন আরেকজন কে প্যাকেট খুলে সিগারেট সাধছেন, কিন্তু অন্যান্য দিনের মত কেউ প্যাকেটে হাত দিচ্ছেন না, সবার পকেটে সিগারেটের ইনটেক প্যাকেট। 'চাঁনরাত' এ গ্যাস ভরানো লাইটার।

বাসার গৃহিনীসমাজ হয়ত মাত্রই রান্না-বান্না মোটামুটি শেষ করে গোসলে ঢুকেছেন কিংবা নতুন শাড়ি পড়ে অতিথিদের জন্য অপেক্ষা করছেন। কিন্তু কেউ আসছে না দেখে ফোনে মায়ের বাড়ির আত্মীয়-স্বজনদের সাথে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন। কী কী রান্না করেছেন এবং কোনটা এবারের ঈদে তাঁর রান্না করা ‘হিট আইটেম’ হবে তা জানাচ্ছেন।

বাসার পিচ্চি-পাচ্চির ঈদ নামাজের পরে একটাই আনন্দ, একটাই লক্ষ্য 'ঈদি কালেকশান'। বাচ্চাসমাজে ঈদের দিনের মান-সম্মান, যশ-খ্যাতি নির্ভর করে নতুন নোটের সংখ্যার উপর মোট টাকার পরিমাণের উপরে না।

যহুরের নামাজের আগ পর্যন্ত ঈদি আদায় 'অধিকার' পর্যায়ে থাকে তারপর ধীরে ধীরে তা মুরুব্বিদের মুডের উপর নির্ভর করা শুরু করে। তাই বাচ্চা সমাজে ঈদের দিনের মান সম্মান রক্ষার্থে পিচ্চি-পাচ্চির টার্গেট থাকে যহুর নামযের আগেই কার্য সমাধা করা।

একটি প্রচলিত কথা আছে, ঈদে ছোটরা সব থেকে বেশি আনন্দ করে। বাস্তবে এমনটা না, বস্তুত ঈদে সবাই ছুটি কাটালেও পিচ্চি-পাচ্চিরা এদিন কঠোর সংগ্রাম করে, এ সংগ্রাম মান-সম্মান বাঁচানোর সংগ্রাম, এ সংগ্রাম ঈদি কালেকশানের।

আরেকটু 'নেদা' বয়সের বাচ্চাদের সব আনন্দ ঠিকরে পড়ে মোড়ের আইসক্রিমের দোকানটায়। যেখানে কখনো একলা যাওয়া হয়নি এর আগে। দোকানে গিয়ে দোকানদার আংকেলকে যে কয়টি আইসক্রিম পছন্দ তা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ায় হলো তাঁদের ঈদ আনন্দ যেখানে কিঞ্চিৎ মিশে থাকে প্রথম স্বাধীনতা লাভের সুখানন্দ।

অবশ্য আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে গিয়ে একটু লজ্জা লজ্জাও লাগে। মনে হয়, লাস্ট টাইম আব্বু বা আম্মুর সাথে যখন এসেছিলাম তখন একটু খেয়াল করে আইসক্রিমের নামগুলো মনে রাখা উচিত ছিল। এখন হয়ত আইসক্রিম আঙ্কেল ভাববে আমি এই প্রথম আইসক্রিম খাচ্ছি তাই নাম বলতে পারছি না। ধুর আগে আইসক্রিম খাই,, গলে যাচ্ছে। আহা ঈদ!

ঈদের দিন তরুণ সমাজ খুবই কনফিউজড থাকে। তাঁরা চায় ঈদের দিনের প্রতিটি মুহূর্ত থেকে তাঁরা কড়ায় গণ্ডায় মজা উসুল করবে। কিন্তু কিভাবে করবে তা বুঝতে পারে না। শেষ পর্যন্ত মোড়ের চায়ের দোকানটার কাছে ডেক সেট (বড় স্পিকার যুক্ত মিউজিক প্লেয়ার) বের করে ইমরান হাশমীর 'কাহো না কাহো' শোনে আর ভাবে ঈদ টা শেষ হয়ে যাচ্ছে আরও দু'একদিন থাকলে জমতো।

এই ভাবা ভাবির মধ্যেই হয়ত মহল্লার কোনও এক সুন্দরী তরুণী বান্ধবীদের নিয়ে হেঁটে যায়। ঈদের দিন দুপুরে প্রায় ঘুমিয়ে পড়া তরুণ সমাজের মনে হঠাৎ ঈদের অনাবিল আনন্দ উকি দেয়। তরুণদের কেও হয়ত স্টাইল করে বাইক নিয়ে তরুণীদের পথ আটকায়।
বন্ধুদের চাপে পড়ে বলে দেয় বহুদিনের জমানো কথাটি।

ঈদের দিনের নখ, দন্তহীন কিঞ্চিৎ ইভ টিজিং আবার জানান দেয় আজ ঈদ।
সকলের ঈদ অনেক মজার এবং আনন্দময় হোক। ঈদ মোবারক।

লেখকঃ সাইদুর হোসেন নভেল
মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুন, ২০১৮ সকাল ১১:৫৫
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×