--------
আজ তোমরা যেসব গল্প বললে তা মূলত দুই
শ্রেণিতে বিভক্ত।এই দুই
শ্রেণির একদিকে রয়েছে আমাদের পারিপার্শ্বিক
বাস্তবিক জগত আর অন্যদিকে
রয়েছে ভৌতিক মৃত্যু সম্পর্কিত জগত, কিছু
শক্তি যা আমাদের এক পর্যায় থেকে
আরেক পর্যায়ে নিয়ে যায় বা বাধ্য করে।দ্বিতীয়
শ্রেণির সাথে সংশ্লিষ্ট
বিষয়গুলো অনেকটা অলৌকিক যেখানে অতিপ্রাকৃত
শক্তি, পূর্ববোধ এবং ভবিষ্যত
দ্রষ্টা বিদ্যমান।
সত্যি কথা বলতে কি তোমাদের অভিজ্ঞতাগুলো মূলত
একটি শ্রেণিতেই অধিক
মানানসই। আমি বলতে চাচ্ছি যে যেসব লোক ভূত
দেখে, কোনরকম পূর্ববোধ ছাড়াই
দেখে। আর যারা পূর্বাভাস পেয়ে যায়া তারা ভূত
দেখেনা। আমি জানিনা কেন এরকম
হয়। কিন্তু এখানে কিছু স্বতন্ত্র পক্ষপাতিত্বমূলক
মনোনয়ন বা অনুরাগ আছে
বলেই আমার ধারনা। অন্তত এটাই আমি গভীরতম
উপলব্ধি।
হ্যাঁ অবশ্যই কিছু লোক আছে যারা এই দুই শ্রেণির
কোনটাতেই পড়েনা। আমার
কথাই ধরা যাক। আমি আমার ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত
কোন ভূত দেখিনি অথবা কখনো ভূত
দেখার আশঙ্কাও সৃষ্টি হয়নি।একবার আমি কিছু
বন্ধুবান্ধবের সাথে লিফট
চড়ছিলাম, আমার বন্ধুরা দোহাই পাড়ে যে একটা ভূত
আমাদের সাথে লিফট-এ
উঠেছে।কিন্তু আমি কিছুই দেখিনি।
তারা দাবী করে ধূসর রঙয়ের এক মহিলা ঠিক
আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু আমার
জানামতে আমাদের সাথে কোন মহিলা
ছিলনা। লিফট-এ শুধু আমরা তিনজনই ছিলাম। কোন
হাসি-ঠাট্টা নয়। জ্ঞাতসারে
ঠাট্টা করার মত বন্ধু ওরা ছিলনা।
পুরো ব্যাপারটাই ছিল ভৌতিক, ছমছমে আর
রহস্যময়। কিন্তু মোটকথা একই রইল, আমার ভূত
দেখা হলো না।
কিন্তু একবার, হ্যাঁ, শুধু একবার আমি এমন এক ঘটনার
মুখামুখি হলাম যা
আমাকে রীতিমত ভয় পাইয়ে দিল।এটা দশ বছর
আগে ঘটেছিল এবং আমি কখনো কাওকে এ
সম্পর্কে বলিনি। আমার মনে হত
যদি আমি কারো সাথে এটা শেয়ার করি তাহলে
ব্যাপারটা আবার ঘটবে, আর আমি তা চাই না।
আমি পুরো ঘটনা চেপে গেলাম।
কিন্তু আজ তোমরা তোমাদের
ভুতূরে অভিজ্ঞতাগুলো আমার সাথে শেয়ার করেছ,
কাজেই আমাকে ত কিছু একটা বলতেই হয়, তাই না?
আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ঐ ঘটনা
আজ তোমাদের সাথে শেয়ার করেই রাত পার
করে দেব।
১৯৬০ সালের শেষের দিকে আমি হাইস্কুল পাশ
করি যখন ছাত্র আন্দোলন তুঙ্গে
ছিল। আমি ছিলাম কচ্ছপ স্বভাবের, ঝামেলা অপছন্দ
করতাম, তাই কলেজে যাওয়া
পুরোপুরি ছেড়ে দেই।পক্ষান্তরে আমি বিভিন্ন কাজ
করে পুরো জাপান চষে
বেড়ালাম। আমার মনে হত এটাই অর্থপূর্ণ
জীবনধারণের সবচে' ভালো পথ।পরিবার
ছেড়ে বিভিন্ন কাজ করে এক অস্থিতিশীল জীবন
বেছে নেয়া সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল
কি-না জানিনা, তবে এটুকু বলতে পারি আমার
সম্মুখে যদি আরেকবার ঐরকম জীবন
বেছে নেয়ার সুযোগ আসত, আমি নিশ্চিত ঐ সুযোগের
সদ্ব্যবহার করতাম।
দ্বিতীয় বছর কয়েক মাসের জন্য
আমি একটা স্কুলে নৈশপ্রহরীর চাকরি তে যোগ
দেই।ছোট শহরের ছোট একটা স্কুল। নৈশপ্রহরীর
চাকরি কিন্তু আহামরি কিছু
না।দিনের বেলায়
আমি প্রহরীকক্ষে ঘুমিয়ে থাকতাম। রাতে পুরো স্কুল
দু'বার
ঘুরে দেখতে হত। বাকি সময় কাটাতাম সঙ্গীত
ঘরে গান শুনে, লাইব্রেরী তে বই
পড়ে অথবা নিজের সাথে বাস্কেটবল খেলে।
স্কুলে একা নিশিযাপন কিন্তু আমার
খারাপ লাগত না, সত্যি।
আমি কি ভীত ছিলাম? নাহ। আঠারো ঊনিশ বছর
বয়সে কোন কিছুকেই তুমি ভয় পাবেনা।
স্কুলটা নতুন বানানো হয়েছিল আর ১৮-২০ টার
মতো কক্ষ ছিল। এটা কিন্তু খুব
বড় কিছু নয়। প্রতিটা রুমের সঙ্গে যুক্ত ছিল সঙ্গীত
ঘর এবং স্টুডিও।
তাছাড়া ছিল ক্যাফেটেরিয়া, সুইমিংপুল, জিম
এবং অডিটোরিয়াম। আমার কাজ হলো
সব দেখাশোনা করা। কাজের সুবিধার্থে আমি ২০
পয়েন্ট এর একটা চেকবুক বানিয়ে
ফেলি।প্রতিটা রুম দেখে নেয়ার পর ঐ রুমের নামের
পাশে ঠিকচিহ্ন ঠুকে দিতাম।
ভাবি, এতকিছু
না করে আমি হয়তোবা ফাঁকি দিতে পারতাম।
প্রহরীকক্ষে শুয়ে
শুয়ে ঠিক চিহ্ন ঠুকে রাখতে পারতাম।
আমি ফাঁকিবাজ ছিলাম না। আর ১৮/২০ টা
রুম দেখতে কতক্ষ্ণই বা লাগে? তাছাড়া কেউ গেট
ভেঙে ঢুকে পড়লে আমাকেই
প্রথমে আক্রমণ করবে।
তো আমি প্রতিরাতে দুবার করে স্কুল
ঘরে দেখতে থাকলাম।
আমার বামহাতে সবসময়
টর্চ থাকত আর ডানহাতে কাঠনির্মিত
জাপানি তলোয়ার। হাইস্কুলে থাকতে আমি
তলোয়ার চালানো শিখেছিলাম তাই
এটা নিয়ে ঘুরতে ভালোই লাগত। সত্যি কথা বলতে
ওটা দিয়ে কাওকে কুপোকাত করে দেবার
আত্মবিশ্বাস ও আমার ছিল। আক্রমণকারী
কোন সত্যিকারের তলোয়ারবিদ হলেও ভয় পেতাম
না।তখন আমি তরুন ছিলাম। যদি এখন
কেউ আমাকে এটা করতে বলে,
আমি কোনদিকে না তাকিগে ভোঁ দৌড় দেব
যাহোক সে রাতে ঝড়ো হাওয়া বইছিল। তখন অক্টোবর
মাস। বছরের ঐ সময়টাতে ঝড়
আসার কথা না।বাতাসের ধাক্কায় সুইমিংপুলের গেট
ভেঙে যায় আর খুব শব্দ করতে
থাকে। একবার ভাবলাম ওটা ঠিক করে আসি কিন্তু
খুবই অন্ধকার ছিল। আকাশে
চাঁদের চিহ্নও নেই।
রাত ন'টায় প্রতিটা কক্ষ ঘুরে দেখে আসলাম।
সবকিছু ঠিকঠাক। সকল দরজা
তালাবদ্ধ ছিল।অস্বাভাবিক কোন কিছুই
চোখে পড়েনি।আমি প্রহরীকক্ষে ফিরে যাই,
রাত তিনটায় এলার্ম দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
রাতে এলার্মের শব্দ শুনে যখন ঘুম ভাঙে, আমার
অন্যরকম এক অনুভূতি হলো। যা
আগে কখনো হয় নি। এটা ভাষায় প্রকাশ করার
মতো নয়। আমার মনে হলোনা আমি
জেগে উঠেছি- আমার মনে হলো কিছু একটা আমার
জেগে উঠার ইচ্ছাকে দমন করছে।আমি
বলপূর্বক নিজেকে বিছানা থেকে টেনে তুলি।
সুইমিংপুলের ভাঙা গেট তখনো
ছান্দিক গতিতে শব্দ করে যাচ্ছিল।কিন্তু আগেরবার
থেকে ভিন্ন।সম্পূর্ণ
ভিন্ন শব্দ।অদ্ভুত কিছু নিশ্চয়ই ঘটেছে, আমার
বিতৃষ্ণা জেগে উঠে, উঠে যেতে
মন চায় না।আমি নিজেকে নিজের
কর্তব্যপরায়ণতা স্মরণ করিয়ে দিলাম।তুমি যদি
একবার কাজ ফাঁকি দেওয়ার চক্রে ঢুকে পড়
তাহলে এর থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে
না।আমি টর্চ আর তলোয়ার খুঁজে নিয়ে দ্রুত
বেরিয়ে পড়ি।
এটা সম্পূর্ণরূপে অস্বাভাবিক এক রাত ছিল।রাত
বৃদ্ধির সাথে সাথে বাতাস আরো
শক্তিশালী হয়ে উঠে। আমার মুখ চুলকানি শুরু
করায় সামনের দিকে তাকাতে
কষ্ট হয়।আমি প্রথমে জিম
এবং পর্যায়ক্রমে অডিটোরিয়াম আর সুইমিংপুল দেখে
আসার সিদ্ধান্ত নেই। সুইমিং পুলের ভাঙা গেটের
শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল একটা
পাগল একসাথে অনেকগুলো হ্যা এবং না বোধক শব্দ
করছে। প্রথমে কয়েকবার হ্যা
হ্যা হ্যা হ্যা...পরে আবার না না না না।
এটা ঠিকমতো বর্নণা করা আসলেই
কঠিন।
স্কুলের ভেতরেও সবকিছু সঠিক অবস্থানে ছিল।
আমি আমার চেকবুক অনুসারে
প্রতিটা কক্ষ দেখে নেওয়ার পর ঠিক চিহ্ন
ঠুকে রাখছিলাম।আমার অদ্ভুত
অনুভূতি ছাড়া সবকিছুই আগের মত।চেকবুক
অনুসারে সর্বশেষ কক্ষ, যা দেখার
বাকি ছিল সেটা হলো ক্যাফেটেরিয়ার
সামনে অবস্থিত বিল্ডিং য়ের পূর্বদিকের
চুল্লিঘর।এর মানে হলো আমাকে দীর্ঘ হলঘরের
ভেতর দিয়ে যেতে হবে।আকাশে চাঁদ
থাকলে হলঘরে কিছুটা আলো থাকে। কিন্তু ঐ
রাতে চাঁদ যেন নিজেকে লুকিয়ে
রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছিল।মেঘের টুকরোর
আড়াল থেকে ক্ষনিকের জন্য
বেরিয়ে আসে, আবার ঢুকে পড়ে।আমি টর্চ
জালিয়ে হলঘরের ভেতর দিয়ে দ্রুতপায়ে
হাটতে থাকি।আমার বাস্কেটবল জুতোর তলা মেঝের
উপর কিচমিচ শব্দ করে যাচ্ছিল।
ওটা ছিল তেল চিটচিটে শ্যাওলাপড়া মেঝে।
হলঘর ধরে স্কুলের প্রবেশপথে যেতেই আমি হতভম্ব।
আমার মনে হলো আমি অন্ধকারে
কিছু একটা দেখেছি।সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তলোয়ার
টা শক্ত করে ধরলাম। আমার জন্য
আরো অদ্ভুত জিনিশ অপেক্ষা করছিল।দেয়ালে টর্চের
আলো পড়তেই দেখি একটা আয়না।
এবং ওটাতে আমার প্রতিবিম্ব।
গতরাতে তো এখানে কোন আয়না ছিলনা।
তাহলে নিশ্চয়ই
এটা নতুন কেনা হয়েছে, আমি নিজেকে বললাম।
পুরোপুরি চমকে যাই আমি। এত বড়
আয়না!
আয়না দেখে আমার মন কিছুটা শান্ত হয়।
নিজেকে বোকা ভেবে হাসি পায়। এটা তো
স্রেফ একটা আয়না, এত ভয় পাওয়ার কি হলো হে?
তো এটাই আসল বিষয়। আয়না। আমি
কত বোকা আর নির্বোধ। নিজেকে এসব
শুনাতে শুনাতে টর্চ নিচু করে একটা
সিগারেট ধরালাম।সিগারেটের
ধোয়া বাতাসে ছেড়ে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের
উপর
একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিলাম।
বাইরে থেকে আসা একটা দূর্বল আলো আয়নায়
প্রতিফলিত হলো। আমার পেছন দিক থেকে ভাঙা গেট
তখনো শব্দ করে যাচ্ছে।
কিছুক্ষন পর মনে হলো, নাহ, ওটা আসলে আমি নই।
আমার মতো অবিকল হলেও
প্রতিবিম্ব টা আমার নয়।ওটা আমিই ছিলাম,
তবে অন্য 'আমি', যার কখনোই
অস্তিত্বলাভ করা উচিত নয়।
আমি জানিনা কিভাবে এটাকে ব্যখ্যা করতে হবে।
একটা বিষয় আমি ঠিকই অনুধাবন করতে পারলাম, ঐ
প্রতিবিম্ব আমাকে বিদ্রূপ
করছিল।ওটা এমনভাবে ঘৃণা প্রকাশ করছিল যেন
আমি একটা গাঢ় কালো নদীতে ভাসমান
হিমশৈল।
কিছুক্ষনের জন্য আয়নার সামনে মূর্তি হয়ে থাকি।
সিগারেট হাত থেকে পড়ে
যায়।আয়নার ভেতরের সিগারেট ও একইভাবে পড়ে।
আমরা দুজন একে অপরের দিকে চেয়ে
দাড়িয়ে থাকি।আমার
মনে হলো আমি কোনকিছুতে আটকা পড়েছি।কেউ আমার
হাত পা এত
শক্ত করে বেধে রেখেছে যে আমি নড়তে পারছি না।
অতঃপর তার হাত নড়ে উঠে, ডানহাতের আঙুল
দিয়ে সে তার থুতনি স্পর্শ করে।
তারপর, ধীরে ধীরে, হ্যা, ছারপোকার
মতো ওগুলো তার মুখের ওপর হামাগুড়ি দিয়ে
যেতে থাকে। আমি হঠাৎ উপলব্ধি করলাম যে আমিও
একই কাজ করছি।বিষয়টা পুরো
উল্টে গেল। আয়নার ভিতরের 'আমি'র প্রতিবিম্ব
হয়ে গেলাম আমি। সে আমাকে
নিয়ন্ত্রন করছে।
আমি আমার তাবৎ শক্তি দিয়ে ক্রুদ্ধ গর্জন
করে উঠি। যে বন্ধন আমাকে আটকে
রেখেছিল সেটা ভেঙে যায়।তলোয়ার
তুলে নিয়ে আমি সমস্ত শক্তি দিয়ে আয়নায় আঘাত
করি এবং প্রহরীকক্ষে ছুটে আসি।
পেছনে আয়না ভেঙে পড়ার শব্দ শুনতে পাই।
দ্রুত রুমে এসে আমি দরজা বন্ধ করে দেই আর তোষকের
নিচে শুয়ে পড়ি। মেঝেতে
পড়ে যাওয়া সিগারেট নিয়ে আমার চিন্তা হয়,
কিন্তু ওখানে ফিরে যাওয়ার কোন
উপায় ছিলনা।বাতাস যেন গর্জন করছিল সে রাতে,
সুইমিংপুলের ভাঙা গেট ভোর
হবার আগ পর্যন্ত 'হ্যা' এবং 'না' বোধক শব্দ
করে যায়। হ্যা, হ্যা, হ্যা,
হ্যা...না, না,না,না...
বোধকরি এতক্ষনে তোমরা গল্পের শেষটা ধরে ফেলেছ। ওটা কোন আয়না ছিলনা। অবশ্যই না।
সূর্য উঠার আগেই ঝড় থেমে যায়।এত সুন্দর
ঝলমলে দিন দেখে বুঝার উপায়ই নেই
যে গতরাতে এখানে টাইফুন আঘাত হেনেছে।আমি ঐ
স্থানে যাই, সিগারেট টা মেঝেতে
পড়া অবস্থাতেই ছিল, তলোয়ার টাও। কিন্তু কোন
আয়না ছিলনা।
আমি যা দেখেছি সেটা কোন ভূত নয়। সহজভাবেই
সেটা ছিলাম 'আমি'। আমি কখনোই
ভুলব না সে রাতে কি পরিমাণ আতঙ্কিত বোধ
করেছিলাম, আর, যখনই ঐ রাতের কথা
মনে পড়ে, এক গভীর চিন্তা আমার মাথায়
খেলে যায়। তা হলোঃ আমরা নিজেই এই
পৃথিবীর সবচে' ভয়ানক এবং রহস্যময় বস্তু।
তোমরা দেখে থাকবে আমার ঘরে কোন আয়না নেই।
আয়না ছাড়া শেভ করা কিন্তু সহজ
কাজ নয়, সত্যি বলছি।