somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রোল নম্বর ৫৮ : অসম্ভব সুন্দর লেখাটি পড়তে পড়তে চোখ ভিজে আসছিল·····

০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ সকাল ১০:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২০০৭ সাল। কলা ভবনে খ ইউনিটের ভাইভা চলছে। সেখানে প্রথম পরিচয়। আলাপে আলাপে দেখা গেল দু'জনের মধ্যে অনেক মিল। মাধ্যমিকে দুজনেরই রেজাণ্ট ৩.৭৫। উচ্চমাধ্যমিকেও একই_৪.৮০। আর কি আশ্চর্য্য বিশ্ববিদ্যালয়েও দুজনেই পেয়েছেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি। বরাদ্দ এফ. রহমান হল! অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, থাকতেনও তারা পাঁচতলায়। এতসব মিলের সঙ্গে মনের মিলও তুমুল হওয়ায় অচিরেই আবু বকর সিদ্দিক ও মোহাম্মদ ফারুক আহমেদ হয়ে উঠলেন হরিহরাত্দা।
আবু বকর মাঝে মধ্যেই বন্ধুকে বাড়িতে নিতে চাইতেন। নানা কারণে যাওয়া হয়ে ওঠেনি ফারুকের। তবে শেষপর্যন্ত তিনি বকরের বাড়িতে গিয়েছেন। বন্ধুর লাশ কাঁধে নিয়ে।
খুব সিরিয়াস : 'আগের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় হয়েছিল। পড়ালেখা ছাড়া কিছুই বুঝত না বকর। রুমে গেলেই বই হাতে টেবিলে দেখা যেত তাকে'_বলছিলেন ফারুক। 'খুব অসুস্থতা ছাড়া কখনো ক্লাস মিস করতে দেখেনি কেউ। বসতও ক্লাসের সামনের সারিতে।' আরেক বন্ধু সাজু বললেন, 'সময়মতো ক্লাসে আসা, নোট নেওয়া_সবকিছুতেই ও খুব সিরিয়াস। স্যারের কোনো লেকচার মিস করলে ছটফট করত, কখন অন্যদের কাছ থেকে লিখে নেবে। পড়াশোনায় এত আগ্রহের কারণে স্যাররাও তাঁকে খুব পছন্দ করতেন। তৌফিকুল হায়দার স্যার, বাছির স্যার তো খুবই স্নেহ করতেন।'
বইয়ের পোকা : পড়তে খুব ভালোবাসতেন আবু বকর। নতুন সেমিস্টারের শুরুতেই খোঁজ নিতেন এবার কোন কোন কোর্স পড়তে হবে, কী কী বই লাগবে। ফারুক বললেন, "শুধু একাডেমিক বিষয় বলে নয়, ইতিহাস পড়তে মন থেকেই সে ভালোবাসতো। ইরান ও মধ্য এশিয়ার ইতিহাস ছিল খুব পছন্দের বিষয়। সাহিত্যের প্রতিও ছিল খুব আগ্রহ।" এখনো কেউ যদি তার রুমে ঢুকে পড়েন তাহলে দেখবেন টেবিলে গল্পগুচ্ছ, বেগম রোকেয়া রচনা সমগ্র, শেক্সপিয়ার থরে থরে সাজানো।
হ্যালো, টিচার : এফ. রহমান হলের ৪০৪ নম্বর রুম। দেয়ালে টাঙানো লাল কাগজে লেখা_'লাইফ ইজ এ টেল, টোল্ড বাই অ্যান ইডিয়ট, ফুল অব ফিউরি সিগনিফাইং নাথিং...।' তাঁর টেবিলে আগের মতোই সাজানো আছে বই, টুপি, চার্জার। কিন্তু রুমটির 'টিচার'ই নেই। পরীক্ষার ফল, পড়ার আগ্রহ দেখে রুমমেটরা তাঁকে 'টিচার' নামেই ডাকতেন। ৪ ফেব্রুয়ারি ছিল তাঁর মিডটার্ম পরীক্ষা। ১ তারিখ রাতেও রুটিনমাফিক পড়া শেষ করে ঘুমাতে গেছেন। তখন কে জানত, মৃত্যু এসে স্থগিত করে দেবে তার সব পরীক্ষা!
জীবন এক যুদ্ধ : তাঁর কাছে বড় ছিল পরিবার। আর্থিক অসঙ্গতির পাশাপাশি পরিবারের স্বাচ্ছন্দ্য_সব মিলিয়ে মানসিকভাবে প্রচণ্ড চাপে থাকতেন আবু বকর। 'এই চাপে প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ত ও। ক্লাস-পরীক্ষা-পড়াশোনার বাইরে টিউশনি করতে গিয়ে হল থেকে মিরপুর আসা-যাওয়ায় প্রায়ই দুর্বল হয়ে পড়ত। তারপরও পরিবারের স্বপ্ন পূরণে গুনে গুনে দিন পার করছিল সে। বই কেনারও সামর্থ্য ছিল না।' বন্ধুর মুখ এভাবেই তুলে ধরেন ফারুক। বন্ধুদের অনেক বই এখনো পড়ে আছে তাঁর টেবিলে। একই বিছানার সঙ্গী শিহাব জানান, 'পুরো ফার্স্ট ইয়ার একটি শার্ট-প্যান্টে পার করেছে সে।'
নির্জনতায় ভালোবাসা : চুপচাপ, লাজুক আবু বকর ক্লাস শেষে সোজা চলে আসতেন রুমে। বিভাগের বন্ধু সাজু জানালেন, 'আমাদের মতো আড্ডা দিত না সে। ঘনিষ্ঠ দুই-একজন ছাড়া কারো সঙ্গে তেমন কথা বলত না।' রেজা বলেন, 'সবসময় নিজেকে আড়াল করে রাখতে চাইত। হয়তো আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে অন্যদের সঙ্গে মিশতে চাইত না।' কিন্তু ভেতর ভেতর দারুণ রোমান্টিক ছিল। ফারুক জানান, "মাঝে মধ্যেই দেখতাম 'কুছ কুছ হোতা হ্যায়' গানটি শুনতে শুনতে খুব উদাস হয়ে যেত। কিছু জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দিত না।"
নানা ঘটনা এখন ফিরে ফিরে আসে ফারুকের স্মৃতিতে। সেই প্রথম বর্ষ থেকে এই সেদিন পর্যন্ত আবু বকরের নোট দিয়ে পরীক্ষায় পাস করেছেন তিনি। প্রতিবার পরীক্ষার আগের রাতে নোট নিতে বন্ধুর কাছে যেতেন ফারুক। 'জানের দোস্ত'ও এই স্বভাবের কারণে তার সঙ্গে খুব রাগারাগি করত। বলত, 'কাল পরীক্ষা। তুই এখন এসেছিস নোট নিতে। ছি! ছি!' বকাঝকা করে শেষ পর্যন্ত অবশ্য নোট দিয়ে পড়া বুঝিয়ে দিত।
গুরুর চোখে : প্রতিদিন ঠিক সময়ে ক্লাসে হাজির হওয়া, বন্ধুবৎসল ছেলেটিকে হারিয়ে শোকে স্তব্ধ ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ। এই বিভাগের শিক্ষক ড. ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, 'সহজ-সরল, মেধাবী একটি ছেলে যে এভাবে হঠাৎ চলে যাবে, এটা এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। এই মৃত্যু আমাদের হতবিহ্বল করে দিয়েছে।' আরেক শিক্ষক নুসরাত ফাতেমা বলেন, 'ক্লাসে সব সময়ই বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন করত। কোর্সের জন্য কী কী বই পড়তে হবে জানতে চাইত।'
২৮ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত মিডটার্ম পরীক্ষার খাতা দেখছিলেন সহযোগী অধ্যাপক নুসরাত ফাতেমা। রোল নম্বর ফিফটি এইটের খাতায় এসে তাঁর চোখ আটকে গেল। খুব মনোযোগ দিয়ে খাতাটি আবার দেখতে শুরু করলেন। লাল কালির একটি দাগও দিতে পারলেন না! খাতার মালিক যে খাতা দেখার আগেই চলে গেছেন বহুদূরে।
তাঁর বিদায়ের পর প্রথম ক্লাসের দিন বৃহস্পতিবার খাতাটি অন্য শিক্ষকদের দেখিয়ে কাঁদতে কাঁদতে নুসরাত ম্যাডাম বারবার বলছিলেন, 'দেখুন স্যার, কিভাবে এই খাতায় কম নম্বর দেওয়া যায়...'!

সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১০ দুপুর ২:১৩
২৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২২


ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিচার চাই? না ভাই, আমরা "উল্লাস" চাই

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৩৭





দীপু চন্দ্র দাস একটি পোশাক শিল্প কারখানায় চাকরি করতো। সম্প্রতি দীপু দাস তার যোগ্যতা বলে সুপার ভাইজার পদে প্রমোশন পেয়েছিলো।

জানা যায়, সুপারভাইজার পজিশনটির জন্য আরও তিনজন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×